ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গী অর্থায়নে জামায়াত;###;আটক নেতাকর্মীদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী

জনকল্যাণ ও ইসলাম প্রচারের নামে বিদেশ থেকে অর্থ আনা হতো

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১ নভেম্বর ২০১৮

জনকল্যাণ ও ইসলাম প্রচারের নামে বিদেশ থেকে অর্থ আনা হতো

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশের চাষীদের কল্যাণের কথা বলে বিদেশ থেকে টাকা এনে জঙ্গীদের কল্যাণে ব্যয় করত জামায়াতে ইসলামী। তুরস্কসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে চাষীদের কল্যাণের পাশাপাশি ইসলামের প্রচার ও জনকল্যাণমূলক কাজের কথা বলে এসব অর্থ আনা হতো। তুরস্ক থেকে টাকা আনার মূল কাজটি করতেন ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মোস্তাক আহমেদ খাঁ। তিনি তুরস্কে থাকাকালে সেখান থেকে এবং বিদেশী জঙ্গী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা বাংলাদেশে পাঠাতেন। সর্বশেষ তিনি দেশে ফিরে আল কাওসার নামের একটি সংগঠন খুলে সেই সংগঠনের নামে বিদেশ থেকে অর্থ আনতেন। আল কাওসারের নামে আসা সেই টাকার একটি বড় অংশ জামায়াতে ইসলামীর এনজিওর মাধ্যমে জঙ্গী কর্মকা-ে ব্যয় করা হতো। জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর অন্যতম নেপথ্য কারিগর কারাবন্দী মোস্তাক আহমেদ খাঁকে জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগে ঢাকার রমনা থানায় দায়েরকৃত নতুন মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখানো হচ্ছে। এদিকে তিন দিনের রিমান্ডের প্রথম দিনেই এনজিওর মাধ্যমে জঙ্গী অর্থায়নকারী আট জামায়াত নেতাকর্মী বিদেশ থেকে আনা টাকা জঙ্গীবাদে ব্যয় করা হতো বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তারা অবলীলায় বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য আনা টাকা কিভাবে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটাতে জামায়াতে ইসলামী ব্যয় করেছে তাও জানিয়েছেন আদালতে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, গত ২৮ অক্টোবর এনজিওর মাধ্যমে জঙ্গীবাদে অর্থায়নের দায়ে গ্রেফতার আট জামায়াত নেতাকর্র্মী বিদেশ থেকে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও জনহিতকর কাজের কথা বলে টাকা এনে জঙ্গী অর্থায়নে ব্যয় করা হতো বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। গ্রেফতার মুহম্মদ ফজলুল হক রিকাবদার, হুমায়ুন কবীর, আশরাফুল হক, আসগর হোসাইন, শেখ শাহজাহান কবীর, মোঃ মনিরুল ইসলাম, মোঃ আব্দুর রউফ ও আল মামুন খন্দকার তিন দিনের রিমান্ডে ছিলেন। রিমান্ডের প্রথম দিনেই তারা বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল জানান, আসামিরা পুরো ঘটনাও বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, তারা রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং ২০১৪ সালে যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচার চলাকালে মামলার আসামি হিসেবে মৃত্যু হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফের সহযোগী। মাওলানা আবুল কালাম ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি নামের এনজিওটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯২ সালে সমাজসেবা অধিদফতর এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে এনজিও ব্যুরো এ্যাফেয়ার্স থেকে সেটি এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এনজিওটির যাবতীয় কার্যক্রম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলকে আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে লিখিতভাবে অবহিত করা হতো। এনজিওটি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর কৃষিবিদরা নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেড ও নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামের আরও দুটি সংগঠন গড়ে তোলে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করত জামায়াত। অর্থ সংগ্রহের মূল কাজ করতেন জঙ্গী অর্থায়ন ও মানিলন্ডারিং মামলায় কারাবন্দী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মোস্তাক আহম্মেদ খাঁ (২৮)। তার পিতার নাম মনোয়ার হোসেন খাঁ। বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানাধীন তকবাজখানী গ্রামে। তিনি মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দায়ের একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে। তাকে জঙ্গী অর্থায়নের দায়ে আট জনকে গ্রেফতারের পর রমনা থানায় দায়ের নতুন মামলায়ও শ্যোন এ্যারেস্ট দেখানো হচ্ছে। মোস্তাক আহমেদ ২০০৬ সালে অবৈধভাবে তুরস্কে গিয়ে সেখানকার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে প্রায় ছয় বছর পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা করার সময় তিনি পুরোপুরি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েন। ওই সময় তার সঙ্গে তুরস্কের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি বিদেশী জঙ্গী সংগঠনের হয়ে কাজ শুরু করেন। দেশে ফিরে তিনি আল কাওসার নামের একটি সংগঠন খুলে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন। ওই সংগঠনের নামে ইসলামী ব্যাংক হবিগঞ্জ শাখায় একটি এ্যাকাউন্ট খুলেন। বিদেশ থেকে আসা বিপুল অর্থের হিসাব লুকিয়ে রাখতে তিনি বিভিন্ন জনের নামে ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট খোলেন। সেসব এ্যাকাউন্টে বিদেশ থেকে আসা টাকা স্থানান্তর করে রাখতেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডির একটি দলের যৌথ অনুসন্ধানে মোস্তাক আহমেদের এ্যাকাউন্টে মাত্র দুই বছরে প্রায় ২ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন করার তথ্য বেরিয়ে আসে। এরমধ্যে ২০১৪-২০১৫ সালে দুই বারেই দেড় কোটি টাকার বেশি উত্তোলিত হয়। দেড় কোটি টাকার অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের পেট্রোলবোমা হামলায় ব্যয় হয়েছে তা প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংক বানিয়াচং শাখা, চট্টগ্রামের হালিশহর ও বন্দরটিলার বিভিন্ন ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য মিলে। সর্বশেষ ইসলামী ব্যাংক বানিয়াচং শাখায় মোস্তাক আহমেদের মালিকাধীন এম কে এন্টারপ্রাইজের নামে থাকা এ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডির অনুসন্ধানে। একই রকম অস্বাভাবিক লেনদেন দেখা যায় কাওসার মিয়া (২৬) নামের একজনের এ্যাকাউন্টে। পরে জানা যায়, কাওসার মিয়া কারাবন্দী মোস্তাক আহমেদ খাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। কাওসারের শাশুড়ি হামিদা খাতুনের (৫৮) এ্যাকাউন্টেও অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য মেলে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে মোস্তাক আহমেদ খাঁ, কাওসার মিয়া ও তার শাশুড়ি হামিদা খাতুনের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হয়। সেই মামলায় তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন করার অভিযোগ করা হয়। মোস্তাক আহমেদ খাঁ ও তার সহযোগীরা ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি বানিয়াচং থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়েরকৃত ২ নম্বর মামলারও আসামি। মামলার পর পুলিশের হাতে আটক হয়েছিল মোস্তাক আহমেদ। কিন্তু জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকার কোন উপযুক্ত প্রমাণাদি আদালতে দাখিল না হওয়ায় এবং নানা দুর্বলতার কারণে মোস্তাক পরবর্তীতে ছাড়া পেয়ে যান। মোস্তাকের বিরুদ্ধে একটি দ্রুত বিচার আইনের মামলাসহ মোট পাঁচটি নাশকতার মামলা আছে। সিআইডি কর্মকর্তা মোল্যা নজরুল বলছেন, ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতির এ্যাকাউন্টে ৬২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিদেশ থেকে অনুদান হিসেবে আসে। বিপুল এই টাকার অধিকাংশের যোগানদাতা মোস্তাক আহমেদ খাঁ। তিনি ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তুরস্কের ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী থেকে অর্থ এনে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় জঙ্গীবাদ বিস্তার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন করেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে মিরপুর ডিওএইচএসের ১১ নম্বর সড়কের ৭৫ নম্বর বাড়ির অফিস থেকে নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেডের কর্মচারী ইসমাইল হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ইসমাইলের ভাষ্য মোতাবেক, নব ধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মুহাম্মাদ মাসউদ জঙ্গীবাদে অর্থায়ন ও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গীবাদকে উৎসাহিত করত। পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে কক্সবাজার-২ (মহেশখালি-কুতুবদিয়া) আসনের জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ জড়িত। তার নির্দেশে ‘বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি’র এ্যাকাউন্ট থেকে ৪২ লাখ টাকা ‘নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেডে স্থানান্তর করা হয়। একইভাবে গত বছরের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি থেকে নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেডের এ্যাকাউন্টে আরও ১০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। বাংলাদেশ চাষী কল্যাণের নামে তারা অধিকাংশ বিদেশী অনুদান সংগ্রহ করলেও তা চাষীদের কল্যাণে ব্যয় করা হতো না। নিজেরাই ইচ্ছেমতো মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে কিছু অংশ ব্যয় করত। বাকি টাকা দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের প্রচারে ব্যয় করত। মোল্যা নজরুল জানান, জঙ্গীবাদে অর্থায়ন করার সঙ্গে জড়িত মুহাম্মদ আব্দুল করিম, গোলাম রাব্বানী, শেখ মোঃ জিল্লুর রহমান আজমী, শেখ মুহাম্মদ মাসউদ, ড. মোঃ সানাউল্লাহ, সিরাজুল হক, এস এম জাকির, নুরুল আমিন ফারুক ও জামায়াতে ইসলামীর কক্সবাজার-২ আসনের সাবেক জামায়াতের এমপি হামিদুর রহমান আযাদ পলাতক আছেন। তাদের গ্রেফতার করতে পারলেই জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
×