ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রহস্য লতা লজ্জাবতী

নতুন বউয়ের চেয়েও বেশি লজ্জা, সামান্য স্পর্শে কাতর

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১ নভেম্বর ২০১৮

নতুন বউয়ের চেয়েও বেশি লজ্জা, সামান্য স্পর্শে কাতর

মোরসালিন মিজান ॥ এখন নতুন বউয়েরও অতো লাজ নেই। লম্বা ঘুমটা টেনে কোথাও চুপটি করে বসে থাকবে? সেদিন ফুরিয়েছে। বিয়ের আসরে আমন্ত্রিত হয়ে আসা অতিথিরা যেমন, কনে প্রায় তা-ই। তবে লজ্জাবতী আছে তার মতোই। কবিগুরু লিখেছিলেনÑ নাই কি রে তীর, নাই কি রে তোর তরী?/কেবলি কি ঢেউ আছে তোর?/হায় রে লাজে মরি...। এই লাজের পুরোটাই নিজের মধ্যে ধারণ করেছে লজ্জাবতী গাছ। একটু ছুঁয়ে দিলে যেন খুন হয়ে যায়। গুটিয়ে নেয় নিজেকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ কারণে আর সব তরু লতা থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। সারা বছরই এর অস্তিত্ব চোখে পড়ে। তবে এখন এই হেমন্তে আরও সতেজ। আরও সবুজ। ফুলসহ দৃশ্যমান হচ্ছে। সতর্ক হয়ে পা ফেলুন। ছুঁয়ে দেখুন আলতো করে। দেখুন কত লজ্জা। খুব লজ্জা বলেই যে গাছের লজ্জাবতী নাম, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইংরেজী নামটি মিমোশা। মিমোশা অনেক নারীরও নাম। অকারণ লজ্জা থেকে নারীরা মোটামুটি বের হয়ে আসছে। লজ্জাবতীর সে সুযোগ নেই। মানুষের ছুঁয়ে দেয়া নয় শুধু, যে কোন ধরনের স্পর্শে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। পাতা যৌগিক। দুই সারি পত্রক বিদ্যমান। সামান্য স্পর্শ পেলে একটি আরেকটির গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যায়। মৃত লতা পাতার মতো মাটির ওপর শুয়ে পড়ে। নিস্তেজ হয়ে যায়। আর সন্ধ্যার পর আপনি গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী। অবশ্য উদ্ভিদ বিজ্ঞানের কথা অন্য। লজ্জাবতীর লজ্জাকে তারা স্বীকার করতে নারাজ। শেরেবাংলা কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক পরিমল কান্তি বিশ্বাস জানান, লজ্জাবতী গাছের পাতার গোঁড়ার অংশের কোষগুলো পানিতে পূর্ণ থাকে। এ কারণে সেগুলো বেশ ফোলা দেখায়। কিন্তু ডাটাগুলো হয় সরল ও সোজা। আঙুল দিয়ে পাতা সামান্য ছুঁয়ে দিলে গাছের পুরো শরীরে মৃদু তড়িত প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে পাতার গোঁড়ার ফোলা অংশ থেকে পানি বেরিয়ে বোঁটার দিকে নেমে যায়। আর পাতার কোষগুলোর জলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে তা কুঁচকে আসে। নুয়ে পড়ে। গবেষণা বলছে, লজ্জাবতী প্রায় ৪শ’ প্রজাতির গুল্ম ও লতার একটি গণ (জেনাস)। এটি লেগিউম জাতীয় ফ্যাবায়েসি পরিবারের এবং মিমোসয়ডিয়া উপ-পরিবারের সদস্য উদ্ভিদ। লজ্জাবতীর সবচেয়ে পরিচিত প্রজাতিটির নাম মিমোশা পুডিয়া। আদি নিবাস মধ্য আমেরিকা। বাংলাদেশেরও খুব পরিচিত লতা। প্রায় সকল লজ্জাবতীর কা- সরু কাঠির মতো। অনেক শাখা প্রশাখা। সুন্দর ফুলও ফুটে আছে এখন। গোলাপি এবং সাদা রঙের ফুলের সৌন্দর্য দারুণ উপভোগ্য। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশে লজ্জাবতীর দুটি জাত রয়েছে। একটি দেশীয়। অন্যটি থাই লজ্জাবতী। দেশীয় লজ্জাবতীর বৃদ্ধি কম। এটি ৩ থেকে ৭ ফুট লম্বা হয়। গায়ে সূক্ষ্ম কাঁটার অস্তিত্ব দেখা যায়। অন্যদিকে থাই লজ্জাবতী গাছে কোন কাঁটা হয় না। এটি দ্রুত বাড়ে। গাছ প্রায় ৩ থেকে ১০ ফুট লম্বা হয়। গাছ নরম ও রসালো বলে দ্রুত পচে যায়। ফলে এ জাতীয় লজ্জাবতী থেকে প্রচুর জৈব সার পাওয়া যায়। এই জৈব সার থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারে অন্য গাছ। থাই লজ্জাবতীতে ২.০৩ থেকে ২.৬ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.১৭৫ থেকে ০.২৩ ভাগ ফসফরাস এবং ১.২৩৭ থেকে ১.৭৪১ ভাগ পর্যন্ত পটাশিয়াম থাকে। এসব কারণে জমিতে জৈব সারের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ভাবা হয় থাই লজ্জাবতীকে। বাংলাদেশেও লজ্জাবতী থেকে জৈব সার তৈরি ও ব্যবহারের কাজ শুরু হয়েছে। সে যাই হোক, গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের জন্য। এমনিতে প্রাণ খুব শক্ত। আগাছার মতো হওয়ায় অনেকে পায়ে মাড়িয়ে যান। কিন্তু গাছটি সহজে মরে না। বরং নিশ্চিহ্ন অবস্থা থেকেও যৌবনে ফিরতে জানে। জন্মাতে পারে প্রতিকূল পরিবেশেও। কোন রোগ বা পোকা একে কাবু করতে পারে না। তার মানে এই নয় যে, গাছটির প্রতি নির্মম আচরণ করলেও কোন ক্ষতি নেই। ক্ষতি আছে। মূলত এ কারণেই গাছের সংখ্যা কমছে। এবং এ কারণেই যতœ নিতে হবে গাছটির।
×