ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি থেকে খালেদা ও তারেকের নেতৃত্ব কেন বাতিল হবে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১ নভেম্বর ২০১৮

বিএনপি থেকে খালেদা ও তারেকের নেতৃত্ব কেন বাতিল হবে না

বিকাশ দত্ত ॥ দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবার বিএনপি গঠনতন্ত্রে আনা সংশোধনী নিয়ে হাইকোর্টের এক আদেশের ফলে গঠনতান্ত্রিক কারণেই বিএনপির নেতৃত্বে থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েছেন। এবার আইনী প্রক্রিয়াতেই খালেদা জিয়া-তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্বে থাকার অনুপোযুক্ত হয়ে পড়েছেন। বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা সংশোধন করে তাদের নেতৃত্বে টিকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আইনের আওতায় টিকল না। দুর্নীতির দায়ে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা দণ্ডিত হবার কারণে তারা আগামীতে দলের নেতৃত্ব দিতে ও নির্বাচন করতে পারবেন না। এমনই আভাস দিয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল সাবেক আইনমন্ত্রী,আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতিসহ আইন বিশেষজ্ঞগণ। বুধবার বিএনপির গঠনতন্ত্রের ‘কমিটির সদস্য পদের অযোগ্যতা’ শীর্ষক ৭ ধারায় নিয়ে সংশোধিত অংশগ্রহণ না করার জন্য ইসিকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রুলে দণ্ডিতরা পদে থাকতে পারবেন না বিএনপির গঠনতন্ত্র থেকে এমন বিধান বাদ দেয়া কেন বেআইনী হবে না এবং সংবিধান ৬৬ (২) (ঘ)-এর পরিপন্থী হবে না তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে স্থানীয় সরকার সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুর কাফরুলের বাসিন্দা জনৈক মোজাম্মেল হোসেনের আবেদন এক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার জন্য ইসিকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বুধবার বিচারপতি মোঃ আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিতে বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। রিটকারীর পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন মেহেদী। এ আদেশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জনকণ্ঠকে বলেন, এটা এক ধরনের প্রতারণা। কোন অপরাধ করে দ-িত হলে রাতারাতি গঠনতন্ত্রই চেঞ্জ করে ফেললাম। এটা ঠিক নয়। এটা জাতির সঙ্গে প্রতারণা। আদালতের আদেশের ফলে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আর দলের নেতৃত্বে থাকার যোগ্য নয়। একই সঙ্গে তারা নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। কারণ খালেদা জিয়ার দুটি দুর্নীতি মামলায় ৭ ও ১০ বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। সংবিধান অনুয়ায়ী ‘ফৌজদারি মামলায় দ-প্র্রাপ্ত হলে, সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক বার (বাধা) রয়েছে। ন্যূনতম ২ বছর দ-প্রাপ্ত হলে এবং তার পর ৫ বছর অতিবাহিত না হলে সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।’ এর আগে ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছে। ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের কারাদ- প্রদান করেছে। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছর সশ্রম কারাদ- বহাল রয়েছে। পাশাপাশি গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানকে যাবজ্জীন কারাদ-,অর্থপাচার মামলায় নিম্ন আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদ- ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। বর্তমানে তারেক রহমান তিনটি মামলায় দ-িত। বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধনীর মাধ্যমে মূলত বিএনপির গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারা বাদ দেয়া হয়, যেখানে বলা ছিল, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি বিএনপির নেতা বা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। বিএনপি চেয়ারপার্র্র্সন খালেদা জিয়ার স্বাক্ষরে ওই সংশোধিত গঠনতন্ত্র ইসির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় দুর্নীতি মামলার সাজায় তার কারাগারে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে। এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আদালতের আদেশের ফলে বিশেষ করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আর নেতৃত্বে থাকতে পারবেন না। নির্বাচনও করতে পারবে না। এখন আদালতের এই আদেশের বিষয়ে দলের পক্ষে যে কেউ আপীল করতে পারে। চলতি বছরের শুরুতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার (সিইসি) কাছে সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দেয়। বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৭ নম্বর ধারায় ‘কমিটির সদস্য পদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা আছে, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যে কোন পর্যায়ের যে কোন নির্বাহী কমিটির সদস্য পদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।’ তারা হলেন: (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দ-িত ব্যক্তি। (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, দুর্নীতির মামলায় খালেদার জিয়া ১০ ও ৭ বছরের সাজা হয়েছে। এবং তারেক রহমানের গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। এর বাইরেও দুটি মামলায় তার সাজা হয়েছে। খালেদা জিয়ার সাজার বিরদ্ধে আপীল করার জন্য আপীল বিভাগে অনুমতি (লিভ) নিতে হবে। সেই লিভ পিটিশনের শুনানি হবে। সেই শুনানিতে যদি আপীল বিভাগ মনে করে লিভ দেয়ার মতো উপাদান রয়েছে, তবেই আপীল বিভাগ আপীল করার জন্য লিভ প্রদান করবে। এটা একটা দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপার। যা কোনক্রমেই নির্বাচনের আগে সম্ভব হবে নয়। এ অবস্থায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান উভয়ই দ-িত অপরাধী। সুতরাং, তারা দলীয় নেতৃত্বে দিতে পারে না। হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছে সেটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। অন্যদিক আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, গঠনতন্ত্র থেকে দুর্নীতিবাজ বিরোধী বিধান তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপি তার রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা প্রকাশ করেছে। যে দল গঠনতন্ত্র সংশোধন করে দুর্নীতিবাজদের ঐ দলে রাজনীতি করার বৈধতা দেয়, সে দল দেশে দুর্নীতি বিস্তারের রাজনীতি করবে তাই-ই প্রমাণ করল। যেহেতু দেশের আদালত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে বিচারিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে; তাই বিএনপির গঠনতন্ত্র বিষয়েও আদালতের আদেশ দেশবাসীকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে প্রেরণা যোগাবে। এ আদেশে গঠনতন্ত্র সংশোধন স্থগিত হয়ে যাওয়ায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান গঠনতান্ত্রিক কারণেই বিএনপির নেতৃত্বে থাকার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে তারা নির্বাচনও করতে পারবেন না। বিএপির গঠনতন্ত্রের ৭ ধারায় যা ছিল তা বিএনপি আঁচ করতে পেরেই সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। গঠনতন্ত্রে ৭ ধারায় ছিল, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি বিএনপির কোন পর্যায়ের কমিটির সদস্য কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হবেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অন্যান্য মামলা থাকায় বিএনপি গঠনতন্ত্র সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ জানুয়ারি সপ্তম ধারা বিলুপ্ত করে বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির কাউন্সিলে এসব সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।
×