ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৭:২১, ৩১ অক্টোবর ২০১৮

চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে

বিশ্বের এই মুহূর্তের দুই মহাপরাক্রান্ত দেশ চীন ও আমেরিকার মধ্যে সখ্য, সহযোগিতা ও পরস্পর নির্ভরশীলতার দিন শেষ হয়েছে। তারা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। দুদেশের মধ্যে রচিত হয়েছে যোজন ব্যাপক দূরত্ব যা সহজে ঘুচবার নয়। দুই ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থার অধিকারী চীন ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক রচিত হয় ১৯৭০-এর দশকের প্রথমদিকে যখন প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ও পরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন সফরে যান। তারপর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েছে। দুদেশ পরস্পরের কাছাকাছি এসেছে। এই ঘনিষ্ঠতা তুঙ্গে উঠে ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে যখন আমেরিকা চীনকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হতে সাহায্য করেছিল। তারপর থেকে শুরু হয় সম্পর্ক অবনতির পালা। এখন তো তারা পরস্পরের ঘোর শত্রু। চীনের অর্থনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি, প্রযুক্তির বিকাশ এবং সামরিক শক্তির ব্যাপক প্রসার আমেরিকাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এবং আমেরিকা চীনকে তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে। ওদিকে চীনেরও মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক আগে থেকেই চীন স্ট্র্যাটেজিস্টদের সন্দেহ যে আমেরিকা চীনের উত্থানকে গোপনে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। সম্ভবত সে কারণেই চীন তার শক্তি সামর্থ্যকে গোপন করে এবং সময়ক্ষেপণ করে সংঘাতকে যথাসম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করেছে। ২০০৮ সালের মন্দা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকাকে পিছনে ঠেলে দেয় এবং চীনকে আরও বর্ধিষ্ণু হবার সুযোগ তৈরি করে। আমেরিকার আশঙ্কা সময়টা এখন চীনের পক্ষে। চীনের অর্থনীতি আমেরিকার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি গতিতে বাড়ছে। এই রাষ্ট্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও বায়োটেকের মতো উন্নত প্রযুক্তির পিছনে বিপুল অঙ্গের অর্থ চালছে। চীন দক্ষিণ চীন সাগরে নিজের একাধিপত্যের প্রতি যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে দুঃসাহসিক না বলে উপায় নেই। কেউ পছন্দ করুক আর নাই করুন পরাশক্তিরা পরস্পরের প্রতি কেমন আচরণ করবে তার নতুন নিয়মকানুন এখন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের সঙ্গে একটা সংঘাতের সম্পর্ক শুরু হয়ে যায়। ট্রাম্পের লক্ষ্য বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সেই লড়াইয়ের প্রধানতম টার্গেট চীন। ট্রাম্প নিজেই গত আগস্ট মাসে বলেছেন, ‘আমি যখন ক্ষমতায় আসি তখন আমরা এমন এক পথে অগ্রসর হচ্ছিলাম যার পরিণতিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যেত। সেটা আর হতে দেয়া হচ্ছে না।’ ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে ঐকমত্য আছে যে চীনের কৌশলই হলো আমেরিকাকে পিছনে ঠেলে দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া এবং নিজের ইচ্ছাকে বাইরের দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়। অতএব আমেরিকার দিক থেকে প্রবলভাবে এর বিরোধিতা করা। পেন্টাগণ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর প্রধানরা এরই অংশ হিসেবে চীনকে আমেরিকার নিরাপত্তার প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি বলে চিহ্নিত করেছে। চীনের প্রতি আমেরিকার নতুন মনোভঙ্গিকে কার্যত ¯œায়ুযুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর বলা যেতে পারে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেন, চীন আমেরিকাকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে হটিয়ে দিতে চাইছে যাতে ওয়াশিংটন তার মিত্রদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে না পারে। তা হতে দেয়া হবে না। ট্রাম্প প্রশাসন এখন সকল ফ্রন্টে কঠোরভাবে পাল্টা লড়াই চালাতে এবং তাতে জয়লাভ করতে বদ্ধপরিকর। এটা ¯্রফে শুল্ক যুদ্ধ বা বাকযুদ্ধ নয়। চলতি অক্টোবরের প্রথমদিকে চীনের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তাকে প্রলুব্ধ করে বেলজিয়ামে নেয়া হয় এবং সেখান থেকে তাকে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে তিনি আমেরিকার এরোস্পেস কোম্পানিগুলোর ব্যবসার গোপন তথ্যাবলী চুরি করেছিলেন। এই প্রথম একজন চীনা নাগরিককে গোয়েন্দাবৃত্তির দায়ে আমেরিকায় নেয়া হলো। এর কদিন আগে আমেরিকার প্যাসিফিক ফ্লিটের মুখপাত্রের ভাষায় চীনের এক ডেস্ট্রয়ার চীন সাগরে বেশ কিছু আক্রমণাত্মক ভঙ্গি প্রদর্শন করে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস ডেকাটুরের ৪০ মিনিটের কাছাকাছি চলে আসে। তাছাড়া গভীর সমুদ্রে চীন প্রতিযোগিতার এক নতুন উৎসতেও পরিণত হয়েছে। আফ্রিকার জিবুতিতে স্থাপিত হয়েছে চীনের প্রথম বৈদেশিক নৌঘাঁটি। সেখান থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত চীনের যুদ্ধ জাহাজগুলোর ক্রমবর্ধমান তৎপরতা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এপ্রিলে তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ নৌমহড়ায় অসংখ্য যুদ্ধজাহজ অংশ নেয়। এ ঘটনা স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্র ও তার এ অঞ্চলের মিত্রদের মনে গভীর চিন্তার ছায়া ফেলে। ২০১৪ সাল থেকে চীন এত বেশি যুদ্ধজাহাজ নামিয়েছে যে বহন ক্ষমতার দিক দিয়ে সেগুলো ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইতালি, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন ও তাইওয়ানের নৌবাহিনীর সামগ্রিক বহন ক্ষমতার চেয়েও বেশি। চীনের যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে তাদের শত্রুজাহাজ ডুবিয়ে দেয়ার ক্ষমতা। জল, স্থল ও আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য চীনের জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সংখ্যার দিক দিয়ে আমেরিকার চাইতে বেশি এবং অধিকতর উন্নতও বটে। কোন কোনটির পাল্লা মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার চেয়েও বেশি। একই কথা অন্য কিছু অস্ত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই বিষয়গুলোই মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কারণ স্যাটেলাইট ড্যাটা ও সেন্সরের সহায়তায় এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দিয়ে চীন গোলযোগস্থলে মার্কিন রণতরীগুলোকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। আগামী দিনগুলোতে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব আরও তীব্র থেকে তীব্রতর নেবে বলেই মনে করার কারণ আছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×