ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. অরূপরতন চৌধুরী

অভিমত ॥ মাদক নির্মূলে কঠোর আইন ও কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৩১ অক্টোবর ২০১৮

অভিমত ॥ মাদক নির্মূলে কঠোর আইন ও কিছু কথা

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে দেশে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে অর্ধলাখের বেশি এবং মামলা হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। সুতরাং মাদকবিরোধী অভিযান যে চলমান তা বোঝাই যাচ্ছে। ২৭ অক্টোবর ২০১৮ জাতীয় সংসদ এ সমাজের অন্যতম সমস্যা মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন পাস হয়েছে। সংসদে পাসকৃত বিলে অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রেখে মাদক বহনের পরিমাণ অনুযায়ী সাজা কম-বেশির বিধান রাখা হয়েছে। নেশার জগতে এখন বাজারে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘ইয়াবা’। তরুণ-তরুণীদের ভাষায় ‘দ্য কুইন’। রাসায়নিক চরিত্র, শক্তি, কার্যকারিতা ও প্রতিক্রিয়া বিচারে এ্যামফিটামিন, মেথামফিটামিন কিংবা কোকেনের চেয়েও ইয়াবা শক্তিশালী উচ্চমাত্রার উত্তেজক মাদকদ্রব্য। দীর্ঘদিন ব্যবহারে hallucination তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে ফুসফুস, লিভার এবং কিডনি নষ্ট হয়। এ নেশায় আসক্ত ব্যক্তির চরম অবসাদ, হতাশা, বিষাদ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। ব্যবহারকারী তখন যে কোন রকম অপ্রত্যাশিত আচরণ করতে পারে, এ অবস্থায় মানুষ খুন করাও বিচিত্র কিছু নয়। এমনকি হতাশা থেকে মাদকাসক্তকে আত্মহত্যার দিকেও নিয়ে যেতে পারে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা শুরু থেকে ইয়াবাকে এক ধরনের যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট হিসেবে প্রচার করে। তখন এর নাম বলা হয় ক্রেজি মেডিসিন, হিটলারস ড্রাগ, টেস্টি ভায়াগ্রা প্রভৃতি। পরে তরুণীরা ব্যাপকভাবে ইয়াবা ব্যবহার শুরু করলে এর আরও একটি নাম যোগ হয় ‘দ্য কুইন’ মেয়েরা মনে করে এই ট্যাবলেট খেলে লাবণ্য বাড়ে, শরীর ঝরঝরে থাকে ও স্লিম হওয়া যায়। এটা যে নেশার ট্যাবলেট অনেকে তা জানে না। কিছু দিন খাওয়ার পর তার মনে হয় এই ট্যাবলেটের প্রতি এক ধরনের আসক্তি তৈরি হয়। সুতরাং ইয়াবা সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা থেকেই তরুণ-তরুণীরা ইয়াবার দিকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। অপ্রতিরোধ্য ইয়াবা চোরাচালান প্রতিনিয়ত আটক ও উদ্ধার হচ্ছে ইয়াবা, কিন্তু কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান। যতই ধরা পড়ুক ততই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হচ্ছে মিয়ানমারের এই ইয়াবা। চোরাপথে মরণ নেশার ইয়াবা যে এখনও আসছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী যতই ব্যবস্থা নিচ্ছে চোরাচালানীরা ততই যেন বেপরোয়া। ইয়াবা গডফাদাররা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু যারা আটক হচ্ছে এদের বেশির ভাগই ক্যারিয়ার। নতুন মাদক আইন পাস হয়ে কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত চোরাচালানিদের অপতৎপরতা রোধ কঠিন বলেই মনে হচ্ছে। মিয়ানমারের ৩৭টিরও বেশি কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার গন্তব্য বাংলাদেশ, সে কারণে এই ইয়াবা সীমান্ত দিয়ে এ দেশে আসতেই থাকবে। মাদকের মধ্যে ইয়াবা সবচেয়ে লাভজনক হওয়ায় এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসৎ সদস্য ও রাজনীতিবিদ যে জড়িয়ে আছে তা এখন সংবাদের শিরোনাম। কেউ কেউ ইতোমধ্যে ধরা পড়ে গ্রেফতারও হয়েছে। তবে এখনও ধরা পড়েননি এমন সংখ্যা বহু। নতুন মাদক এনপিএস-ট্রানজিট ছিল বাংলাদেশ এনপিএস-ইয়াবার চেয়েও ভয়ঙ্কর মাদক! ক্রেজি ড্রাগস ইয়াবার পর খাত (এনপিএস-নিউ সাইকোট্রফিক সাবটেনসেস) সেবনের কিছু সময়ের মধ্যেই মানব দেহে এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ইয়াবার চেয়েও ভয়ঙ্কর ড্রাগস এই খাত, অভিজাত এলাকার যুবক-যুবতীদের কাছে খাত এরই মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ইয়াবার বিকল্প হিসেবে অনেকে ‘খাত’ সেবন করছে। গ্রীন টির আমদানি যেহেতু বৈধ, তাই গ্রীন টির প্যাকেটে করে গ্রেফতার এড়িয়ে মাদক মাফিয়ারা নিরাপদে মাদকটি দেশে আনছে। মাদকগুলো গুলিয়ে অথবা চিবিয়ে সেবন করা হয়। পাশাপাশি ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রাণঘাতী মাদক ইয়াবার মতোই নতুন মাদক এনপিএস। আমাদের দেশে এখনও এর ব্যবহার খুব একটা নেই। তবে ইউরোপে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ইথিওপিয়া থেকে সরাসরি ইউরোপে আমদানি করা যায় না। এ কারণে বাংলাদেশ হয়ে এনসিএস চালান হয় ইউরোপে। ইতোমধ্যে একাধিকবার এনপিএস-এর চালান গ্রীন টি চালানের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৭৩২ কেজি এনপিএস জব্দ করা হয়েছে, যা সবই এসেছে ইথিওপিয়া থেকে, এর বাজার মূল্য ইয়াবার চাইতেও বেশি। প্রথম চালান ধরা পড়ে ৩১ আগস্ট ২০১৮। এ ঘটনায় দেশে নতুন মাদকের প্রবেশের বিষয় রীতিমতো আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এটি দেখতে অনেকটা গ্রিন টির মতো। মোড়কও অন্যসব কোম্পানির গ্রিন টির মতো, সম্প্রতি গ্রিন টির লেভেলে আমাদের বিমানবন্দরের কাস্টমস পার হচ্ছিল চালানগুলো। ইথিওপিয়া থেকে আসা মাদকগুলো গ্রিন টির ল্যাভেল লাগিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীরা। সহজেই বোঝা যায়Ñ এটি মাদক পাচারকারীরা বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে তথ্য থেকে জানা যায়, এরই মধ্যে পার্শ¦বর্তী ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশে ’খাত’ পাচার হয়েছে। গবেষকদের মতে ‘খাত’ জীবনী শক্তি ও কমিয়ে দেয়। ১৯৮০ সালে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একে মাদকদ্রব্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। গবেষণায় দেখা যায়, খাট ইয়াবার চেয়েও খারাপ। যারা খাট সেবন করে তাদের অনিদ্রা হয়, ক্ষুধামন্দা হয়, বোধবুদ্ধি লোপ পায়। রাতের পর রাত জেগে থাকলেও খাট সেবনকারীরা বুদ্ধিবৃত্তিক কোন কাজ করতে পারে না।’ ইয়াবা ব্যবসায় শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ইয়াবা (অ্যামফিটামিন), কোকেন, হেরোইন পরিবহন, কেনাবেচা, ব্যবসা, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্তান্তর, সরবরাহ ইত্যাদি অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবনের বিধান রেখে সংসদে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিল-২০১৮ পাস হয়েছে। সংসদে পাসকৃত বিলে মাদক বহনের পরিমাণ অনুযায়ী সাজা কমবেশির বিধান রাখা হয়েছে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনে অর্থ বিনিয়োগ, সরবরাহ, মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও একই ধরনের শাস্তির বিধান লাখা হয়েছে। এই প্রথম মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীর পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক/অর্থলগ্নিকারী, মদদদাতাদেরও কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা হয়েছে পাসকৃত বিল। এছাড়া বিলে কোকেন, কোকো মাদক চাষাবাদ, উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে ২৫ গ্রামের বেশি হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু ২৫ গ্রামের নিচে হলে কমপক্ষে ২ বছর ও সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ- বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ইয়াবা বহনের ক্ষেত্রে এ্যামফিটামিনের পরিমাণ ২০০ গ্রামের বেশি হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ- এবং অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু ১০০ গ্রাম হলে সর্বনিম্ন ৫ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-ের বিধান করা হয়েছে। তাছাড়া, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালালে আইনে এক বছরের কারাদ- ও অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে, পারমিট ব্যতীত কোন ব্যক্তি এ্যালকোহল পান করতে পারবে না এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে সিভিল সার্জন অথবা সরকারী মেডিক্যাল কলেজের কোন সহযোগী অধ্যাপকের লিখিত ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে এ্যালকোহল পান করার অনুমোদন দেয়া যাবে না। কখনও আইনানুযায়ী, মাদকাসক্ত ব্যক্তির ডোপ টেস্টে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেলে কমপক্ষে ৬ মাস ও সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদ- বিধান করা হয়েছে। এই আইনে শীশাকেও মাদকের আওতায় এনে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। মাদক সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে মোবাইল কোর্টেও এখতিয়ার বাড়ানো হয়েছে। পাসকৃত বিলে এই প্রথম মাদকসেবী ও মাদকব্যবসায়ীর পাশাপাশি মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক/অর্থলগ্নিকারী, মদদদাতাদেরও কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা হয়েছে। তাছাড়া কেউ যদি সজ্ঞানে কোন মাদকদ্রব্য অপরাধ সংঘটনের জন্য তার মালিকানাধীন অথবা দখলি কোন বাড়িঘর, জায়গাজমি, যানবাহন, যন্ত্রপাতি অথবা সাজসরঞ্জম কিংবা অর্থ সম্পদ ব্যবহারের অনুমতি দেন তাহলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদ-। এছাড়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত না এমন কোন ব্যক্তির কাছে অথবা তার জায়গায় যদি মাদকদ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহারযোগ্য কোন যন্ত্রপাতি, ওয়াশ অথবা অন্যান্য উপকরণ পাওয়া যায় সেটাও অপরাধ বলে গণ্য হবে। এর শাস্তি ন্যূনতম ২ বছরের কারাদ-, সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-। বাংলাদেশ মাদক নিয়ন্ত্রণ ও মাদক দমনে বর্তমান সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবিদার। আমাদের দেশে যেভাবে মাদক ব্যবহার, পাচার ও আসক্তি বেড়ে যাচ্ছিল ঠিক এমনই একটি অবস্থায় এই আইন একটি মাইল-ফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণে শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগ যেমন সফলতা নিয়ে আসে তেমনি মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা অপরিহার্য। সেই সঙ্গে পাঠ্য পুস্তকে এর অন্তর্ভুক্তি এবং বিভিন্ন সরকারী চাকরি ও পেশাগত কর্মক্ষেত্রে প্রার্থীদের বিশেষত গাড়ি চালকদের ডোপ টেস্ট এখন সময়ের দাবি। লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস [email protected]
×