‘সেরাদের একনায়কত্ব’ বা ডিক্টেটরশিপ অব দ্য বেস্ট প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলেছিলেন প্লেটো। যারা এটা করবেন সেই শাসকগোষ্ঠী চূড়ান্তভাবে সাম্যবাদের অনুসারী হবেন। তাদের পারিবারিক জীবন বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু থাকবে না। তাহলে তারা অর্থনৈতিক সুবিধার লোভে ন্যায়পরায়ণতা ও শাসন কাজের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাবেন এবং তাতে সাধারণ মানুষ বা প্রজাদের মনে শাসকের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ জন্মাবে। এ বৈরী মনোভাব তাদের বিপ্লবের দিকে ঠেলে দিতে পারে যা একপর্যায়ে গণসমাজে ভাঙ্গন ধরায়। প্লেটো ‘আদর্শ রাষ্ট্রে’র শাসকদের এভাবে কল্পনা করেছিলেন।
প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছিলেন সে সময়ের এথেন্সের সামাজিক পটভূমিকে নির্ভর করে। তারপর বহু শতাব্দী পার হয়েছে। নানা ধরনের রাজনৈতিক দর্শনের মতবাদ পেরিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ আজকের রূপ পেয়েছে। শাসকগোষ্ঠী বা শ্রেণী গণসমাজে ভাঙ্গন ধরার আতঙ্ক মুক্ত নয় মোটেই। শাসক যদি প্ল্যাটফর্ম হয়, জনগণ তাহলে অডিয়েন্স। অডিয়েন্সকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার জাদুকাঠি প্ল্যাটফর্মের জানা আছে। সেখানে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে অডিয়েন্স ভাবলেশহীন তাকিয়ে দেখে। কেন এ ভাবলেশহীনতা? যা বোঝাচ্ছে তাই বুঝছে। তাহলে এই যে আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে এত গর্বিত হওয়া সেসব কি করে ঘটেছিল? যে প্রচ- শক্তি নিয়ে সাতচল্লিশের পর মধ্য শ্রেণী সমাজে তোলপাড় তুলে পাকিস্তানের নতুন উপনিবেশ ভাঙতে মনোযোগী হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে তা সম্ভব করেছিল সেই তীব্রতা ধীরে ধীরে মিইয়ে যায় স্বাধীন দেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। সুবিধাভোগী অংশ পক্ষ বেছে নিয়েছিল আগেই। পুরস্কার আর খেতাবের টোপে আইয়ুব আমল থেকেই অনেকে কুপোকাত হয়েছেন।
সা¤্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির জোরে ফুলেফেঁপে ওঠা সে সময়ের অবাঙালী পুঁজিপতিদের দেয়া নানা সুবিধা নিয়েছেন, খেতাব পদক পুরস্কারের মালা পরে গর্ব অনুভব করেছেন। স্বাধীনতার পর আরেক সামরিক শাসক পদকের প্রচলন করে মধ্যবিত্ত লেখক, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের অনেককেই অনুগত করতে পেরেছিলেন। বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে ছিল না। এখনও নেই। এই তো ক’দিন আগে প্রতিষ্ঠিত দু’জন কথাসাহিত্যিককে পদক দিল বেসরকারী এক ব্যাংক। যাদের নাম এ দেশের সাহিত্যমনা যে কোন মানুষ জানেন। এ পুরস্কার নিয়ে তারা ধন্য হলেন না ওই পুরস্কার ধন্য হলোÑ সেই সরল সিদ্ধান্ত নিতেও আমাদের ‘সচেতন’ মানুষদের হোঁচট খেতে হয়। এই দেয়া-নেয়ার আড়ালের সত্যটা যত বেশি আড়াল থাকবে এগিয়ে যাওয়ার গতি তত ধীর হবে।
এ ধরনের উপঢৌকনের ক্ষতির পরিমাণ চট করে বোঝা যায় না। এসব কৌশলের খেলা। প্রায়োগিক রূপে হয়ত বদল এসেছে। আশির দশকে অনুন্নত দেশগুলো নিয়ে যে খেলা শুরু হয়েছিল তার দেশীয় ফর্মে কোন্দলে জড়িত থেকে দেশীয় শাসকগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে রেষারেষিতে যুক্ত থেকেছে। ওদিকে লগ্নি পুঁজির সরবরাহকারীদের পুঁজির পরিসর কেবলই বেড়েছে এবং মধ্যশ্রেণীর সেই তেজীভাব ক্রমশ শীতল হয়েছে। সমাজের ভেতরে তরঙ্গ প্রবাহের মতো বেরিয়ে এসেছে নতুন এক গোষ্ঠী। বুলগেরীয় সাহিত্যিক গিওর্গি কারাস্্লাভোভ তাঁর ট্যাঙ্গো উপন্যাসে অসাধারণভাবে এ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। খানিকটা উদ্ধৃতিÑ ‘ফলমূল ও তরিতরকারির ব্যবসা করে রাতারাতি বড় লোক হয়ে ওঠা কায়েভ তার মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে এক পার্টির আয়োজন করেছে, সরকারী কৌঁসুলি ইয়োরগভ যতবার সোফিয়ার হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোড় ব্যক্তিটির নাম উচ্চারণ করছেন ততবারই তাঁর অন্তরের অন্তস্তল থেকে একটা প্রচ- বিতৃষ্ণা পাক দিয়ে উঠেছে। কায়েভ! এ দুনিয়ায় কেই বা চেনে তাকে? এ ধরনের সাবেকি আমলের ফেরিওয়ালাদের তিনি একেবারে সহ্য করতে পারেন না। ঘরে বোনা মোটা কাপড় পরে এরা বুলগেরিয়ার সুদূর পল্লী অঞ্চল থেকে রাজধানীতে কাজের খোঁজে আসে। রাত কাটায় বস্তিতে, অবিক্রীত তারিতরকারি খেয়ে ক্ষুধা মেটায়। তারপর ধীরে ধীরে ধৈর্যের সঙ্গে উপরতলায় ওঠার পথ অধিকার করে নেয়। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের স্বর্ণময় সূক্ষ্ম ছিদ্রপথটি খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তারা কঠোর পরিশ্রম আর সংগ্রাম করে যায়। তার পরই শুরু হয় প্রচুর ধন সঞ্চয়ের পালা। বিরাট বিরাট বাড়ি তৈরি করে, বিলাসবহুল প্রশস্ত ফ্ল্যাট কেনে, শহরের অভিজাত এলাকায় অবসর বিনোদনের জন্য প্রস্তুত করে মনোরম অট্টালিকা বা ভিলা। অতি ক্ষমতাসম্পন্ন যে মোটর গাড়ি তারা চড়ে তার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য আর রূপ মানুষের ক্ষুব্ধমনে ঈর্ষার সঞ্চার করে। ... এরা নিজেরা হিসাবপত্র খুব কমই জানে, বিদ্যা আঙ্গুলে গুনে হিসাব করা পর্যন্ত আর তাই ব্যবসার হিসাবপত্র রাখার জন্য তাদের চার্টার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখতে হয়। নিজেদের পক্ষে কোন চিঠিÑব্যবসা সংক্রান্ত চিঠিপত্র লেখা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ করে, নামমাত্র বেতনে বিদেশে বহু বছর ধরে পড়াশোনা করেছে এমন যুবকদের দায়িত্ব দেয় বৈদেশিক চিঠিপত্র আদান-প্রদানের। ধীরে ধীরে এরা বনেদি পুরুষানুক্রমে অভিজাত প্রতিষ্ঠানকে বাজার ছাড়া করছে, বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এদের সঙ্গে অর্থের প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে, রাজধানীর সব শ্রেষ্ঠ পরিবারের সঙ্গে লাখ লাখ টাকার যৌতুকের বিনিময়ে এরা আত্মীয়তা স্থাপন করছে।’
ঠিক যেন আমাদের সমাজের কথাই বলছেন কারাস্্লাভোভ। এ উপন্যাস তিনি লিখেছিলেন বুলগেরিয়ার স্বাধীনতার পটভূমিতে। গত শতকের মধ্য সত্তরে আমাদের দেশে অনূদিত হয়। সে সময় থেকে আমরা অনেক দূর এগিয়ে এলেও সমাজের বুনোট তৈরির সেই প্রায় শুরুর সময়ের ধারাবাহিকতা নিয়েই এসেছি। যার প্রতি পর্বে রয়েছে সুবিধাভোগীদের ক্ষমতার কাছে আনুগত্যের ইতিহাস। বিভিন্ন রূপে নানা আবরণে এই আনুগত্যকেই আরাধ্য করে তোলার কাজ সব সময়ই চলেছে। এখন তার গতিপ্রবাহ এত বিচিত্র ও কৌশলী যে সহজে তাকে চেনাও কঠিন। অডিয়েন্স কে যা নীরব দর্শকেই পরিণত করে কেবল। প্লেটো যে সাম্যবাদ দিয়ে গণসমাজ শান্ত রাখার কথা বলেছেন, সাম্যবাদ ছাড়াই তা এখন ভয়াবহ রকম শান্ত। চোখের সামনে কত কি ঘটছে, তবু প্রতিক্রিয়া নেই। এরিক ফ্রম বলেছেন, ‘প্রতিটি সমাজ তার প্রয়োজন অনুযায়ী চরিত্র তৈরি করে। এ সমাজ তার বিকাশের এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে বাস্তব সমাজ জীবন প্রতিস্থাপিত হয় কিছু বুলি আর পছন্দসই ইমেজ দিয়ে।’ আর এ বাস্তবতায় অডিয়েন্সের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনই একমাত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
শীর্ষ সংবাদ: