ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পপি দেবী থাপা

ঢাকার চাকা নিয়ে কুন্তল বাড়ৈ

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ৩০ অক্টোবর ২০১৮

ঢাকার চাকা নিয়ে কুন্তল বাড়ৈ

ঢাকার সড়ক ও সড়কে ঘুরে চলা চাকা অর্থাৎ যানবাহন কুন্তলের ছবির বিষয়। বলাবাহুল্য, এই নগরী আর তার জীবনযাত্রা কুন্তলের আগ্রহের কেন্দ্রে। চলতি পথে সড়কের দুর্বিষহ অবস্থা, যানবাহনের বেহাল দশা, নাগরিকের মূল্যবান সময়ের অপচয় আর ভয়াবহ আগামীর চিত্র ভাবায় কুন্তলকে। ভাবনার শুরুটা ২০১২ তে। তখনও পেইন্টিংয়ের ছাত্র। সে বছরই প্রথম কাজ ‘হুইল অব ঢাকা-১’। পরের বছর ২০১৩ তে ‘হুইল অব ঢাকা-৫’ নিয়ে অংশগ্রহণ করেন ন্যাশনাল আর্ট এক্সিবিশনে। ‘কাহাল’ আর্ট এক্সিবিশনে ব্রোঞ্জ পদক বিজয় ‘হুইল অব ঢাকা-৭ ও ৮’ নিয়ে। পেইন্টিং আর প্রিন্ট মেকিংয়ের সমন্বয়ে নতুন ধারার কাজ ‘হুইল অব ঢাকা-১৫’ নিয়ে অংশ নিয়েছেন ২১তম ন্যাশনাল আর্ট এক্সিবিশনে। কুন্তলের ‘হুইল অব ঢাকা’ সিরিজ দর্শকদের এই নগরের সড়কের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যত নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ১৭তম এশিয়ান আর্ট বিনিয়েলে ‘অনারেবল মেনশন এওয়ার্ড’ বিজয়ী কুন্তলের ‘ঢাকা রোড-৪’-এর সাদা-কালো সড়ক আর গাড়ি জানায় আগামীর সম্ভাবনা-শঙ্কার কথা। স্থবির, থমকে যাওয়া ঢাকার সড়ক নিয়ে তার আগামীর কাজ ‘ঢাকা লাইভ।’ কুন্তল বাড়ৈ। ছবির মাঝে জীবন খোঁজেন। শিল্প সৃষ্টিতেই মানব জন্মের অর্থ খুঁজে ফেরেন। জন্ম বরিশালের রাজিহার গ্রামে। বাবা দ্বীজেন্দ্র নাথ বাড়ৈ ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মা সবিতা বাড়ৈ গৃহিণী। তিন ভাই বোনের মাঝে মেজো কুন্তলের ছবির ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে এসএসসির সময় থেকে। অবশ্য আগে থেকেই ছবি আঁকতে ভাল লাগত তার। দুলাল নামে এলাকার এক বড় ভাই যিনি ঢাকাতে চারুকলায় পড়তেন, কুন্তলের ছবি দেখে চারুকলাতে ভর্তির পরামর্শ দেন। তার দেওয়া এ উৎসাহ আর্ট নিয়ে পড়ার প্রতি কুন্তলের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। অভিভাবকদের ইচ্ছা ছিল সে মেডিক্যাল অথবা অন্য কোন বিষয়ে পড়বে। অথচ চারুকলায় ভর্তির উদ্দেশে সেখানে কোচিং করেন কুন্তল। ঝমেলাটা পাকে পরীক্ষার সময় চারুকলা আর জগন্নাথের ভর্তি পরীক্ষা একই দিন হওয়ার কারণে। অভিভাবকদের ইচ্ছায় জগন্নাথের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় তাকে। চান্স পেয়ে পরিসংখ্যান নিয়ে ১ বছর পড়েন জগন্নাথে। কিন্তু মন পড়ে থাকে রং আর ক্যানভাসের পাতায়। তাই নতুন করে ভর্তি হন ইউনির্ভাসিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ-এ। সেখান থেকেই ২০১০ সালে বিএফএ এবং ২০১৩ সালে এমএফএ সম্পন্ন করেন। কুন্তলের বিশ্বাস ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি দূরে থাকার জন্য আমাদের শিল্পের আশ্রয় নিতেই হবে। ছোটবেলা থেকে যদি কেউ শিল্পমনা, সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে তবে তার জীবনবিমুখ বা বিপথে যাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। তিনি মনে করেন শিল্প এবং সংস্কৃতি হচ্ছে একটি সেনসেটিভ ও টাচি বিষয়। এর বিষয়বস্তুর মধ্যে কেন্দ্রীভূত হতে পারলে অন্য বিষয়ে মনোনিবেশ করার সুযোগ থাকে কম। তার মতে শিল্প, কালচার হচ্ছে সুন্দর জীবনের জন্য এক থেরাপি। কেউ যখন ক্রিয়েটিভ কিছু করে এবং কালচারাল কোন কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তার নিজেকে জানার, জীবনের প্রকৃত অর্থ খোঁজার তীব্রতা যায় বেড়ে। ক্রিয়েটিভ বিষয় মানুষকে নতুন কিছু আবিষ্কারের চিন্তায় মগ্ন করে তোলে। তার মতে চিত্রশালা এক বড় জগত। সমুদ্র দেখে ভাল লাগে কিন্তু এর ভিতরে ডুব দিয়ে অতল স্পর্শ করা খুবই কঠিন। চিত্রকর্মের বিষয়টাও তাই। মনন গঠনের জন্য এটা একটা ভাল দিক। জীবন মানে তো শুধু একটা চাকরি, খাওয়া কিংবা ঘুমান নয়। মানুষ হিসেবে কেউ যখন নিজেকে জানার চেষ্টা করবে, মেধাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে তখনই ভাল বিষয়ের সৃষ্টি হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়বে। সমাজ থেকে হানাহানি, রক্তপাত, আর মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি অনীহা দূর হয়ে সুন্দর এবং সভ্যতার আলোকে নতুন এক সমাজের সৃষ্টি হবে। আমাদের শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে হলে শুধু ঢাকাভিত্তিক নয়, জেলা পর্যায়ে সে অঞ্চলের শিল্পীদের শিল্প নিয়ে প্রদর্শনী ও বিশেষ কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। উঠিয়ে আনতে হবে তৃণমূল পর্যায়ের শিল্পী এবং শিল্প ভাবনাকে। এছাড়াও এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের শিল্পের মেলবন্ধনে নতুন কিছুর সৃষ্টি হতে পারে আমাদের এভাবেও ভাবতে হবে। শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কুন্তল জোর দেন একাডেমিক শিক্ষার ওপর। একাডেমিক শিক্ষা পেলেই যে কেউ প্রকৃত শিল্পী হয়ে উঠবেন এমন নয়, তবে শিল্পশিক্ষার ছোঁয়ায় অন্তত মানসিকভাবে সমৃদ্ধ হবেন সকলেই। কিছুটা হলেও শিল্পবোধ জন্ম নেবে তাদের মাঝে। তাই নার্সারি থেকেই পড়ার বিষয়বস্তু হিসেবে শিল্প সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসব সেক্টরগুলোতে যদি কাজ করা যায় তাহলে একটা ভাল অবস্থানে হয়তো আমরা পেীঁছাতে পারব। আর বর্তমানে তো বিশ্ব হতের মুঠোয়। যখন শিল্পের প্রতি কারও আগ্রহ জন্মাবে সে সার্চ করতে থাকবে। তার জানার দরজা খোলার চেষ্টা থাকবে। সমাজ সুন্দর করতে হলে শিল্পীকে তার শিল্প ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। যেতে হবে গ্রামাঞ্চলে, তৃণমূল পর্যায়ের স্কুল, কলেজে। উন্মুক্ত পরিবেশে তাদের নিজের মতো করে শিল্প সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশে এখনও এমন কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন অঞ্চল রয়েছে যেখানে সাধারণ শিক্ষাই বাধাপ্রাপ্ত সেখানে ছবি আঁকার ভাবনা অনেক দূরের। এই বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের শিল্প ভাবনাকে এর সঙ্গে ইনভলভ করতে হবে। শিল্পে ছোঁয়ায় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সম্ভব বলে কুন্তল বিশ্বাস করেন। বর্তমান সময়ে আমাদের শিল্পের অবস্থান নিয়ে কুন্তল বলেন, শিল্পকে এখন জাতীয় পর্যায়ে নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিচার করতে হবে। তিনি মনে করেন আর্ট নিয়ে যত বেশি ট্রাভেলিং করা হবে এবং অন্যান্য দেশের আর্টকে আমাদের এখানে আনা যাবে তখনই বোঝা যাবে আমাদের শিল্পের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে। কেননা শিল্পী যে পরিবেশ ও কালচারে বেড়ে উঠে তার শিল্পে তারই প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে অনেকেই ভাল কাজ করছেন। অনেক তরুণ উদীয়মান, মেধা সম্পন্ন শিল্পী আছেন। আর বিশ্বের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়েই চলছি। তবে আমাদের আরও ভাল গ্রুমিং দরকার। নিজেকে ভেঙ্গে ভাল কাজের জন্য তৈরি হতে আরও ভাল স্কুলিং দরকার। আর্ট সম্পর্কে যারা ভাল জানেন তারা যদি আমাদের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত থাকেন তাহলে জানার পরিসরটা আরও বেড়ে যেত। দরকার সঠিক দিক নির্দেশনা। যখন উদীয়মান মেধাবী শিল্পীদের সঙ্গে প্রপার গাইড যুক্ত হবে তখনই আমাদের শিল্পের একটি ভাল অবস্থান সম্ভব। কুন্তলের কাছে শিল্পীর জন্য কোন পুরস্কারই শেষ কথা নয়। পুরস্কারের আশায় নয় শিল্পী শিল্পসৃষ্টি করেন প্রাণের তাগিদে। তবে আমাদের এখানে তরুণদের দেয়া পুরস্কার নিয়ে কিছুটা কষ্ট আছে তার। পুরস্কার বা তার অর্থ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন অনেকে। সে তুলনায় কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে তেমন সচেষ্ট নন। তরুণদের টিকে থাকতে হলে তাদের ন্যূনতম সুযোগটুকু করে দিতে হবে। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ সুন্দর এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন কুন্তল।
×