ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কুষ্টিয়ার চার আসনে নৌকার পালে হাওয়া, বিএনপি চায় দুর্গ পুনরুদ্ধার

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩০ অক্টোবর ২০১৮

কুষ্টিয়ার চার আসনে নৌকার পালে হাওয়া, বিএনপি চায় দুর্গ পুনরুদ্ধার

এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ কুষ্টিয়ার চারটি সংসদীয় আসনের দুটিতে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান থাকলেও অন্তর্কোন্দল প্রকট। অপর দুটি আসনের একটিতে উন্নয়নের ওপর ভর করে নৌকার পালে বইছে হাওয়া। অপরটিতে শরিক দল জাসদ (ইনু) রয়েছে মজবুত অবস্থানে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে প্রবীণদের পাশাপাশি এবার তরুণ ও নতুন মুখেরও আগমন ঘটেছে এখানে। তবে মনোনয়ন দৌড়ে অন্য দলের চেয়ে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরাই এগিয়ে রয়েছেন। চারটি আসনে দলের ২২ মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে সরব। এ কারণে শেষ পর্যন্ত কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগই হয়ে উঠতে পারে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এবার আগেভাগেই মাঠে নেমেছেন। তাদের কেউ কেউ নিজের প্রার্থিতা জানান দিতে এলাকায় গণসংযোগ, শোডাউন, সমাবেশসহ চালাচ্ছেন নির্বাচনী প্রচার। দলীয় হাইকমান্ডেও করছেন জোর তদ্বির। কুষ্টিয়ার চারটি সংসদীয় আসনই একসময় ছিল বিএনপির দুর্গ। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে বিএনপির সেই দুর্গ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এখানকার চারটি আসনই চলে যায় আওয়ামী লীগের ঘরে। এরপর থেকেই কুষ্টিয়ায় বিএনপির শক্তিশালী অবস্থান হয়ে পড়ে নড়বড়ে। ভোটারদের কেউ কেউ বলছেন, আসছে নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি চাইবে তাদের হারানো দুর্গ পুনরুদ্ধার। অপরদিকে দখলে থাকা আসনগুলো যেন হাতছাড়া না হয় তার জন্য আওয়ামী লীগ থাকবে মরিয়া। এদিকে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে মাঠে কাজ করে যাচ্ছে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের দাবি, ক্ষমতাসীন সরকারের ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগামী নির্বাচনে জনগণ নৌকায় ভোট দিয়ে আবারও শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় আনবে। অপরদিকে বিএনপি প্রার্থীদের দাবি, বিনা ভোটের লুটেরা সরকারকে জনগণ আর কখনই ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এদিকে নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং পুলিশী গ্রেফতার এড়াতে বিএনপি-জামায়াত মাঠে না থাকলেও রাখছে প্রস্তুতি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি ভোটে এলে কুষ্টিয়ার চারটি আসনেই নির্বাচন হবে প্রতিযোগিতামূলক। জমে উঠবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের লড়াই। কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর উপজেলা) ॥ দৌলতপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসন। এই উপজেলায় আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান থাকলেও রয়েছে চরম অন্তর্কোন্দল। ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত এখানে ছিল বিএনপির একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। আগামী নির্বাচন ঘিরে দলটির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী এখন মাঠে সরব। অপরদিকে দলীয় কোন্দলে জর্জরিত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলের বর্তমান ও সাবেক এমপি এবং তাদের কর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক ‘সাপে নেউলে’। এমপি রেজাউল হক চৌধুরী ও সাবেক এমপি আফাজ উদ্দিন আহম্মেদ একে অপরের চির প্রতিদ্বন্দ্বী। কেউ কারও ছায়া পর্যন্ত মাড়াতে নারাজ। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের ভোটে এ আসনে বিএনপির আহসানুল হক ওরফে পচা মোল্লা টানা জয়লাভ করেন। তার মৃত্যুর পর ২০০৩ সালের উপনির্বাচনে তার পুত্র বিএনপি নেতা রেজা আহমেদ বাচ্চু ওরফে বাচ্চু মোল্লা বিজয়ী হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আলতাফ হোসেনকে পরাজিত করে এখানে এমপি হন দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রবীণ নেতা আফাজ উদ্দিন আহমেদ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও তিনি দলীয় মনোনয়ন পান। কিন্তু দলের বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আলহাজ রেজাউল হক চৌধুরী দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নাটকীয়ভাবে বিজয়ী হন। তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান থাকলেও এখানে কোন্দলের কারণে বেশিরভাগ সময় আসনটি হাতছাড়া হয় এবং জাতীয় পার্টি অথবা বিএনপির দখলে চলে যায়। এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই আসনে দ্বিতীয়বারের মতো মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়ে মাঠে নেমেছেন বর্তমান এমপি প্রবীণ নেতা রেজাউল হক চৌধুরী। তিনি দলীয় নেতাকর্মীসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে এই আসনে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করতে চান। রেজাউল হক চৌধুরী বলেন, আমার সময়ে দৌলতপুর উপজেলায় রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তাই মনোনয়নের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। মাঠে কাজ করছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী আরেক বর্ষীয়ান নেতা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি আফাজ উদ্দিন আহমেদ। সাংগঠনিকভাবে এবার তার অবস্থান বেশ মজবুত। আফাজ উদ্দিন বলেন, আগামী নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন চাইব। তবে নেত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন তার পক্ষে আমি কাজ করব। এ দুই নেতার বাইরেও আওয়ামী লীগের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রশিদুল আলম, তরুণ নেতা মোফাজ্জেল হক, এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা সরোয়ার জাহান বাদশা, জেলা আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা হাসানুল আসকার হাসু ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুষ্টিয়া বিশেষ জজ আদালতের সরকারী কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট শরীফ উদ্দিন রিমন। এরা সবাই নৌকার মনোনয়ন পেতে দলীয় হাইকমান্ডে জোর তদ্বির করছেন। অপরদিকে দৌলতপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি রেজা আহমেদ বাচ্চু ওরফে বাচ্চু মোল্লা ও সাবেক সভাপতি আলতাফ হোসেনের নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে গ্রুপিং ও দ্বন্দ্ব-বিবাদ। তবে মাঠে না থাকলেও বাচ্চু মোল্লাকেই দলের একক প্রার্থী মনে করেন বেশিরভাগ নেতাকর্মী। বর্তমানে বাচ্চু মোল্লাই বিএনপির হাল ধরে রেখেছেন। এছাড়া উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলতাফ হোসেন, রমজান আলী বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন। তবে বিএনপি দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থী বাচ্চু মোল্লাসহ দলের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার এড়াতে বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। আবার মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী নাশকতার মামলায় গ্রেফতার হয়ে এখন জেলহাজতে। বাচ্চু মোল্লা জনকণ্ঠকে জানান, পুলিশী হয়রানি গ্রেফতার এড়াতে তার অন্তত ২ হাজার নেতাকর্মী বর্তমানে এলাকা ছাড়া। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত তার নিজের দুটিসহ ১১ ‘ভৌতিক মামলা’ দায়ের হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে। বড় দুই দলের বাইরে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সম্পাদক শাহরিয়ার জামিল জুয়েল এবং উপজেলা জাসদের (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শরিকুল ইসলাম নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা উপজেলা) ॥ মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলা নিয়ে গঠিত কুষ্টিয়া-২ আসন রাজনীতির মাঠে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন জোটের দুই হেভিওয়েট প্রার্থী জাসদ সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি ও আওয়ামী লীগের মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপির বাড়ি এই নির্বাচনী এলাকায়। শরিকদল জাসদের একমাত্র প্রার্থী হিসেবে এই আসনে হাসানুল হক ইনুর অবস্থান বেশ মজবুত। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জাসদ নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভাল নয়। একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে হানিফ এই আসনে প্রার্থী হলেও জোটের স্বার্থে তা ছেড়ে দিতে হয় শরিকদল জাসদকে এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে এখান থেকে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন হাসানুল হক ইনু। এ নিয়ে সে সময় আওয়ামী লীগে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন হাসানুল হক ইনু। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আওয়ামী লীগ ও জাসদের কোন্দল এখানে প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। তাই আগামী নির্বাচনে ইনুকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে নারাজ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। নৌকার প্রার্থী হলে তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চান মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের সম্ভব্য প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছেন। এ ছাড়াও নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে এই আসনে মিরপুরের আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট আবদুল হালিম ও ভেড়ামারার সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র আলহাজ শামিমুল ইসলাম ছানার নাম শোনা যাচ্ছে। এসব বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, বড় দলে ছোটখাটো বিবাদ থাকতেই পারে। এগুলো সাময়িক। তিনি বলেন, সবাই স্বাধীন। যার যার দল ইচ্ছে করলেই প্রার্থী দিতে পারে। আমরা জোটে আছি। আর নির্বাচন জোটগতভাবেই হবে। অপরদিকে আসনটি ফিরে পেতে তৎপর ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপি। কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী ও ঢাকা মহানগর মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন এই আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হতে কেন্দ্রে জোর লবিং করছেন বলে জানা গেছে। এখানে ২০ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) কেন্দ্রীয় নেতা আহসান হাবিব লিংকন জোটের প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এই আসনে বিজয়ী হন বিএনপির অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে মশাল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। আওয়ামী লীগের হানিফও ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের কাছে ধরাশায়ী হন। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জোটের প্রার্থী হিসেবে এ আসনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুই পাচ্ছেন নৌকার টিকেট এমনটিই এলাকায় চাউর রয়েছে। এলাকায় তিনি গণসংযোগেও এগিয়ে রয়েছেন। প্রতি মাসে কয়েকবার তথ্যমন্ত্রী এলাকায় আসছেন এবং ঘর গোছানোসহ দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে।
×