ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

৭ বছর জেল খালেদার ॥ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩০ অক্টোবর ২০১৮

৭ বছর জেল খালেদার ॥ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়

বিকাশ দত্ত ॥ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অন্য তিন আসামিকেও সাত বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করেছে আদালত। খালেদা জিয়াসহ প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদ-ের আদেশ দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া ট্রাস্টের নামে কেনা কাকরাইলে ৪২ কাঠা জমি বাজেয়াফত করে তা রাষ্ট্রের অনুকূলে নেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিআইডব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু থেকেই পলাতক। দ- দেয়ার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে বসানো পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে পিনপতন নীরবতার মধ্যে বিচারক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এটিই সর্বোচ্চ শাস্তি। একই সঙ্গে দ-বিধির ১০৯ ধারায় আসামিদের শাস্তি দেয়া হয়। বিচারক রায়ে ১৫টি বিবেচ্য বিষয় ছাড়াও পর্যবেক্ষণে বলে ছেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থেকে অপরাধমূলকভাবে ব্যক্তিগত ট্রাস্টের অনুকূলে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি (খালেদা জিয়া) যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা কখনও কাম্য হতে পারে না। ভবিষ্যতে যাতে ওই পদে (প্রধানমন্ত্রী) দায়িত্বে থেকে কেউ যাতে আর অপরাধ না করে তাই এ মামলায় অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা দেয়া উচিত বলে আদালত মনে করছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে সংক্ষিপ্ত এ রায় দেয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন না খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাও। তবে কারাগারে থাকা দুই আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং মনিরুল ইসলাম খান রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদ- দিয়েছে একই আদালত। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আদালত এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। রায়ে দুদকের আইনজীবী সন্তোষ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে না থাকলেও তারা এ রায়ে খুশি হতে পারেননি। তারা এটাকে একতরফা রায় বলে উল্লেখ করেছেন। বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে বিচারক এজলাসে উপস্থিত হয়ে বিচারকার্য শুরু করেন। শুরুতে দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, এ আদালতে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। উচ্চ আদালতের পর আপীল বিভাগে আজ (সোমবার) বিচারকার্য স্থগিতের আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এ আদালতে আপনার রায় বিচারের আদেশ হিসেবে বহাল থাকবে। আমি রায় পাঠ করে শোনানোর আবেদন জানাচ্ছি। এরপর বিচারক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান সংক্ষিপ্ত রায় পাঠ করা শুরু করেন। এ সময় তিনি আড়াই বছর ধরে চলমান এ বিচারকার্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণী পাঠ করেন। আড়াই অরাজনৈতিক এক ব্যক্তিকে ট্রাস্টি হিসেবে যোগ করা হয়েছে। তাছাড়া সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছিল আরেকজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে। তখন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর এ ট্রাস্টের সঙ্গে তার দুই ছেলে ছাড়া যারা কাগজ-কলমে জড়িত ছিল তারা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তি। খালেদা জিয়া সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করিয়েছেন। এক্ষেত্রে হারিছ চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেছেন তার ব্যক্তিগত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না। তাছাড়া সোনালী ব্যাংকের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে টাকাগুলো জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের এ্যাকাউন্টে যোগ করা হয়েছে তাও অবৈধ ছিল। তাছাড়া এ টাকার কোন প্রমাণ বা দলিল নেই। ব্যাংক হিসাবে খালেদা জিয়ার ট্রাস্টি হিসেবে একক স্বাক্ষর ছিল। এ সব কাজে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলামও ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের ঠিকানা খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত আবাসস্থলের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। কোন ট্রাস্টের ঠিকানা এরকম হতে পারে না। উনি উনার ব্যক্তিগত বাসাতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন। আদালত আরও বলেন, প্রসিকিউশনে দাখিলকৃত তথ্য প্রমাণে আসামিদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাস্ট গঠনের একটি উদ্দেশ্যেও তারা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ট্রাস্টের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করে খালেদা জিয়া বিভিন্ন ফান্ড থেকে টাকা জমা করেছেন। আদালত ১৫টি বিষয় বিবেচনা নিয়ে এই রায় দেন। এর আগে সকালে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে কারা আদালতে বিচার চলবে সংক্রান্ত আদেশের বিরুদ্ধে করা আবেদন খারিজ করেছে আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপীল বিভাগের বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেন। এ আদেশের ফলে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করতে আর কোন বাধা নেই বলে জানিয়েছে আইনজীবীরা। আপীলের আদেশের পর বিচারিক আদালত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। দুর্নীতি মামলায় দ্বিতীয় রায় ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আট মাসের মাথায় দ্বিতীয় দুর্নীতি মামলায় দ-িত হলেন। কারা কর্তৃপক্ষ বারবার খালেদাকে আদালত কক্ষে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার অনুপস্থিতিতেই এ মামলার শেষ দিকের কার্যক্রম চালিয়ে নেয় আদালত। রায়ের সময়ও তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। সর্বশেষ ৫ সেপ্টেম্বর তিনি আদালতে এসে বলেছিলেন, বিচারক যত খুশি সাজা দিতে পারেন, তিনি আর আসবেন না। বর্তমানে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বিচারক আখতারুজ্জামান তার ছয় শতাধিক পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সময় নিয়ে আদালতে পড়ে শোনান। ১৫টি বিবেচ্য বিষয় বিবেচনা করে তিনি আসামিদের সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণ ॥ বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, পরবর্তীতে কেউ যাতে এরকম কাজে উৎসাহিত না হন, সেজন্য তাকে (খালেদা জিয়া) কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার বলে আদালত মনে করে। একইভাবে তাকে সহযোগিতা করার জন্য অপর আসামিদের কঠোর সাজা হওয়া দরকার বলে আদালত মনে করে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকে এ ধরনের অবৈধ অর্থ উপার্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলীয় ফান্ড ও বিভিন্ন ব্যক্তির থেকে টাকা নিয়ে এবং বিভিন্ন আসামির সহায়তা নিয়ে এমন কাজ আর কেউ যাতে না করে। আদালত এ সময় বার্তা দিয়ে বলেছেন, যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের জন্য এবং যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের জন্যও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এ জন্য এ ধরনের অপরাধ থেকে তাদের দূরে থাকার জন্য আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। আপীল বিভাগের আদেশ ॥ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে কারা আদালতে বিচার চলবে সংক্রান্ত আদেশের বিরুদ্ধে করা আবেদন খারিজ করেছে আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপীল বিভাগের বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেন। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করতে আর কোন বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। আপীল বিভাগের আদেশের পর রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থিত ঢাকার ৫ নম্বর অস্থায়ী বিশেষ জজ ড. মোঃ আখতারুজ্জামান রায় ঘোষণা করেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া আদালতে না যাওয়ায় তার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে বলে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক আখতারুজ্জামান আদেশ দেন। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে- আদালতের এমন আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করা হয়। সে রিভিশন আবেদন গত ১৪ অক্টোবর খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এরপর ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে ২৫ অক্টোবর চেম্বার আদালতে আপীল আবেদন করে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। রায় হতে বাধা নেই ॥ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচারিক কার্যক্রম চলা নিয়ে তার লিভ টু আপীল খারিজ হওয়ার পর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানিয়েছেন, বিচারিক আদালতে সোমবার রায় হতে কোন বাধা নেই। তিনি বলেন, এটা নিয়ে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। সেখানে সরাসরি খারিজ হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে তিনি আপীল বিভাগে এসেছিলেন। রবিবার শুনানি হয়েছিল। সোমবার আদেশের জন্য ছিল। আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ খারিজ করে দিয়েছেন। হাইকোর্টের অর্ডার বহাল থাকল। ফলে সোমবার বিচারিক আদালতে যে রায়ের জন্য দিন ধার্য ছিল সেই রায় প্রকাশে প্রচারে কোন আইনগত বাধা নেই। দুদকের আইনজীবীর সন্তোষ প্রকাশ ॥ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াসহ চার আসামিকে ৭ বছর করে সশ্রম কারাদ- দেয়ার আদেশে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দুদকের আইনজীবী। দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এ মামলায় আদালত খালেদা জিয়াকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন। আমরা এতে সন্তোষ প্রকাশ করছি। কারণ মামলা পরিচালনাকারী হিসেবে আমি অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি। রায়ের পর মনে হয়েছে যেন প্রখর রোদের মধ্যে গোবি মরুভূমি পার হয়েছি। আজকের রায় ঘোষণার দিন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। এর মাধ্যমে উচ্চতর ও বিচারিক আদালতের নির্দেশের প্রতি তারা অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন। প্রসিকিউশন পক্ষের ৩২টি দাখিলকৃত সাক্ষ্যের আলোকে ১৯৪৭ সালের আইনের ৫-এর ২ এবং ১০৯ ধারার আলোকে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছিল।
×