ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

শতবর্ষে বলশেভিক বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৩০ অক্টোবর ২০১৮

শতবর্ষে বলশেভিক বিপ্লব

১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর (পুরনো বর্ষপঞ্জির হিসেবে) আর নতুন গ্রেগোরিয়ান নিয়মে ৭ নবেম্বর ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক রুশ বিপ্লব টানা ৭৬ বছর সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়। পরবর্তী ২৪ বছরের ইতিহাস অন্য ধারার আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট? যা পুরো ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সমর্পিত। তবে সে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। বৈশ্বিক আঙ্গিকে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লব তৎকালীন সময়ের এক যুগান্তকারী ঘটনা। তারও প্রায় অর্ধশত বছর আগে বস্তুবাদী সমাজ নির্দেশক কার্ল মার্কস কোন দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার রূপরেখা নির্ণয় করতে গিয়ে শ্রেণীহীন সমাজ কাঠামোর এক ঐতিহাসিক নিয়মকে সর্বসাধারণের সামনে উন্মোচিত করেন। অনেক গবেষণা আর উপাত্ত সংগ্রহ করে আজীবন সুহৃদ এঙ্গেলসকে নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, প্রতিটি সমাজের বৈষয়িক প্রতিবেশ সেই সমাজের নির্দিষ্ট কাঠামোকে কেন্দ্র করে শুধু আবর্তিতই হয় না, বরং ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রমিক ধারায় তা সুসংহতও হয়। পুঁজিবাদের ধ্রুপদী যুগে কার্ল মার্কসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সমাজ নিরীক্ষকের ভূমিকায় নামা সেও এক অনিবার্য গতি। বস্তু আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সমাজকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি সুদৃঢ়ভাবে অভিমত ব্যক্ত করলেন, চেতনা কখনও সচেতন অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এই সচেতনতা মানুষের বাস্তব জীবন প্রক্রিয়া। নিজ অস্তিত্বের প্রয়োজনে মানুষ চারপাশে যে বৈষয়িক প্রতিবেশ গড়ে তোলে, সেটাই কোন সমাজ কাঠামোর মূল ভিত্তি। উৎপাদন শক্তি আর সম্পর্কের সমন্বয়ে যে ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, সেটাই পুরো কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় সেই সমাজের ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে আরম্ভ করে প্রতিদিনের যাপিত জীবনের সার্বিক কার্যক্রম। এই সামগ্রিক ব্যবস্থা আবার ঐতিহাসিক নিয়মে এগিয়ে যায়, বিকশিতই শুধু নয়, কোন এক পর্যায়ে বিলুপ্তির পথেও ধাবিত হয়। পাঁচটি সমাজ কাঠামোর অবক্ষয় তুলে ধরতে গিয়ে সর্বশেষ ব্যবস্থা সমাজতন্ত্র, যা একসময় সাম্যবাদের জন্ম দেবে তার রূপরেখা নির্ণয় করেন। বিশ্ব তোলপাড় করা এই শ্রেণীহীন সর্বজনীন মালিকানাভিত্তিক তত্ত্বে সবচাইতে প্রলুব্ধ আর উৎসাহিত হতে থাকে উদীয়মান সময়ের প্রজন্মরা। সোভিয়েত রাশিয়ার মহান বিপ্লবী নেতা লেনিনও ছিলেন মার্কসীয় দর্শনের অনুসারী আর একজন সমাজ নির্ণায়ক বলিষ্ঠ যোদ্ধা। যার নেতৃত্বে সম্পন্ন হয় ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের প্রস্তুতি, সম্ভাবনা, এগিয়ে যাওয়া, পর্যায়ক্রমে পরিণত লাভ করা এক ঐতিহাসিক মহাযজ্ঞ। এই বিপ্লবের ফলে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার নবোত্থান ছিল মার্কসীয় অর্থনীতি সমর্থিত এক সমতাভিত্তিক সমাজের নতুন অভিযোজন। বিশ্ব প্রথমবারের মতো দেখল এক অন্য রকম সামাজিক অবয়ব, যা এক সময় তাত্ত্বিকভাবে গ্রথিত ছিল বুদ্ধিবৃত্তির জগতে আর অসংখ্য গ্রন্থের সাজানো সারিতে। বিপ্লবটা হয় ১৯১৭ সালে। শুরুটা তারও আগে। জার শাসিত সোভিয়েত রাশিয়া ছিল ‘ইউরোপের পশ্চাৎপদ একটি দেশ।’ অত্যাচার, অবিচার এবং শোষণের মাত্রায় সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর জীবন হয়ে ওঠে অসহনীয়, দুর্বিষহ এবং অধিকার ও স্বাধীনতাহীনতায় জর্জরিত। এই পর্বত প্রমাণ সামাজিক অভিশাপ থেকে বের হয়ে আসতে প্রয়োজন ছিল যুগোপযোগী নেতৃত্বই শুধু নয়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দেশাত্মবোধের এক অনমনীয় ব্যক্তিত্বেরও। এক সুসংহত, সুশৃঙ্খল, সংগঠিত পার্টি যার ঐতিহাসিক ভূমিকায় সমাজ কাঠোমোর অভ্যন্তরে গেড়ে বসা সমস্ত মহাদুর্যোগ কেটে যেতে সময় নেবে না। সেই লক্ষ্যে লেনিন বলশেভিক পার্টিকে মার্কসীয় তত্ত্বে জাগিয়ে তুলতে তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োগ করেন। জার শাসনের ব্যভিচারে ভেতরের অরাজক পরিস্থিতিতেও বলশেভিক পার্টি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শিক চেতনায় সংহত হয়ে জনমত তৈরিতেও পিছিয়ে থাকেনি। বৃহৎ জমিদারতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাশিয়ার জার শাসনের মর্মমূলে ছিল অসাম্য-বৈষম্যের এক তীব্র কষাঘাত। শুধুই কি সোভিয়েত রাশিয়া? সে সময় সারা পৃথিবী ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উন্মত্ততার হিংস্র থাবায় ক্ষত-বিক্ষত, জর্জরিত। সুতরাং সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লব অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অভিযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার আগেই ছড়িয়ে পড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দাবানল, যা প্রতিটি দেশের জন্য ছিল এক সর্বগ্রাসী মহাসঙ্কট। বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের নব আবিষ্কারের প্রতিকূল আগ্রাসন ১৯১৪ সাল থেকে দুনিয়াজোড়া যে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসাও অত সহজ ছিল না। দেশ থেকে দেশান্তরে সশস্ত্র অভিযানের অনভিপ্রেত এই সংগ্রামী পথযাত্রায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল একেবারে আলাদা। ফলে শুরু হওয়া যুদ্ধের উন্মত্ততায় লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে থাকে। দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের আবশ্যিক দায়বদ্ধতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দাবানল লেনিনকে বিব্রত করলেও দমাতে পারেনি। তারই অনিবার্য পরিণতিতে যুদ্ধের ভয়াবহতা থামার আগেই ১৯১৭ সালের ৭ নবেম্বর লেনিন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ায় অভ্যুত্থান ঘটান। হিংসায় উন্মত্ত বিশ্বের মাঝপথে এই ধরনের একটি ঐতিহাসিক বিপ্লব কিভাবে নবোত্থিত রাশিয়াকে মহিমান্বিত করেছিল সেও এক অন্যমাত্রার সামাজিক অগ্রযাত্রা। শুধুই কি লেনিন একা এই অনন্য বিপ্লবকে চালিত করেছিলেন? তার অকৃত্রিম সহযোদ্ধারাও যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে সংগ্রামী গতিধারাকে নিরন্তর করেছিলেন, সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ও ইতিহাসের সাক্ষী। ট্রটস্কি, স্তালিন ও বুথারিনের মতো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বরাও সার্বক্ষণিক লেনিনকে সাহচর্য দিয়ে যান। লেনিনের মৃত্যুর পর যে স্তালিনকে নবাগঠিত রাশিয়ার সমাজ বিনির্মাণের স্থপতির মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। কৃষিনির্ভর জার শাসনামলে শ্রমজীবী কৃষকদের যে দুরবস্থা সেখান থেকে নতুন রাশিয়াকে আলোর জগতে নিয়ে আসা স্তালিনের অবিস্মরণীয় কীর্তি। কারণ বিপ্লবের পর লেনিন বেশি দিন বাঁচেনওনি। মার্কস বর্ণিত নতুন সমাজ কাঠামোর আবশ্যিক উপাদান পুরনো ব্যবস্থায় তৈরি হতে না পারলে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয় না। ফলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ ভেতর থেকে বিকাশ না হওয়ায় জার সরকার প্রবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার সত্যিকারের কোন রদবদল করা যায়নি। বরং বিপ্লব পূর্ববর্তী অবস্থার তুলনায় বর্তমান সোভিয়েত রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক চেহারার অসঙ্গতি দৃশ্যমান হতে থাকে। ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক পুঁজিবাদী দেশ নতুন রাশিয়ার ওপর সশস্ত্র হামলাও চালাতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে সার্বিক পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে যায়। সঙ্গত কারণে প্রায় ৩ বছর রাশিয়ায় চলে গৃহযুদ্ধের মতো অভ্যন্তরীণ কোন্দল। ইতোমধ্যে ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সংগ্রামী অভিযাত্রা স্তিমিত হয়ে আসলেও এর রেশ কাটতে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হয় তাবত বিশ্ববাসীকে। আর রাশিয়াকে তো আরও বেশি করে এই অনাকাক্সিক্ষত ধারার শিকার হতে হয়। ১৯২৪ সালে বিপ্লবের কর্ণধার লেনিনের মৃত্যু নতুন এই দেশটিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারেনি। কারণ আর এক সংগ্রামী নেতৃত্ব স্তালিন এই সদ্য এগিয়ে যাওয়া দেশটির হাল ধরেন। মাত্র ২ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯২৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার অস্থিতিশীল আর বিপন্ন সমাজ কাঠামো বলশেভিক পার্টির আদর্শিক পরিক্রমায় যে মার্কসীয় অর্থনীতিকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছিল, তা অনেকটাই স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছে। পশ্চাৎপদ কৃষি অর্থনীতির সমস্যা জর্জরিত কাঠামোই শুধু নয়, প্রযুক্তি বিদ্যায় প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থার শিকারে শিল্পোদ্যোগে অব্যাহত পিছিয়ে পড়া একটি দেশ মাত্র ১ দশকে কতখানি এগিয়ে যায়, তা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার। আর এই বিস্ময় ও অভূতপূর্ব আনন্দের বর্ণনা আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাশিয়ার চিঠিতে। ১৯৩০ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসেন রাশিয়া ভ্রমণে। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার নতুন অবস্থা কতখানি কবিকে মুগ্ধ আর বিমোহিত করেছিল, তার যথার্থ বর্ণনা আছে তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠিতে।’ হিসাব মতে ১৩ বছর হলেও যুদ্ধ ও বিপ্লবোত্তর রাশিয়াকে তার প্রত্যাশিত আর আকাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছাতে আরও কিছু সময় লেগেছিল। তার পরেও নিজ চোখে দেখার বাস্তব অভিজ্ঞতায় রবীন্দ্রনাথ যে রাশিয়ার বর্ণনা দিয়েছেন, সেখান থেকে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না নতুন অভিযাত্রায় পা দেয়া এই দেশটি কত তাড়াতাড়ি পুরো জাতিকে সমতাভিত্তিক কাঠামোর এক বিশেষ জায়গায় পৌঁছে দেয়। বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করা কবির মনে হয়েছিল রাশিয়া একেবারে অন্য ধাঁচের। সবার থেকে আলাদা। মূল প্রভেদ বৈষম্যহীন সমাজে সর্বমানুষকে তার যোগ্যতা এবং অধিকারের মাপকাঠিতে একটি সমান অবস্থায় নিয়ে আসা। ‘রাশিয়ার চিঠি শুরু করেন কবি সংখ্যাগরিষ্ঠ অসহায়, নির্বিত্ত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্যবিড়ম্বিত করুণ আর্তি দিয়ে, যা প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষের সহজ এবং স্বাভাবিক চিত্র। আর এখানেই বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার সামাজিক সমতার ভিত্তিতে সাধারণ জনগণের বৈষয়িক এবং অবস্থানগত পর্যায়, তার মর্মমূলে যে সাম্যের বাণী, সেটাই তাঁকে নিয়ে যায় এক বিশেষ মুগ্ধতার জায়গায়। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মানবোধ, অধিকার চেতনাই নয়, তার চেয়েও বেশি মনুষ্যত্ব, মানবিকতা সব মিলিয়ে একেবারে মূল শেকড় থেকে রাশিয়া তার জনগোষ্ঠীর জন্য যে নতুন সমাজ ব্যবস্থার দ্বার খুলে দেয়, সেখানে অসাম্য-বৈষম্যের কোন বালাই নেই। মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করাÑ সেও এক অতুলনীয় সামাজিক প্রক্রিয়া। এবং সঙ্গে আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকেও প্রতি দিনের জীবনের সঙ্গে একীভূত করা নব্য সোভিয়েত রাশিয়ার এক অনন্য কর্মযোগ। বিস্মিত আর বিমোহিতচিত্তে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, শিক্ষাই সর্বোত্তম শক্তি এবং প্রধানতম মাধ্যম, যাকে অবলম্বন করে সর্বসাধারণ নিজেকেই সমৃদ্ধ করেনি, দেশকেও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই দূরদর্শী এবং সমাজ সচেতন রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিক ভবিষ্যদ্বাণীও ছিল। সরাসরি কবির বক্তব্য উল্লেখ করছিÑএর মধ্যে যে গলদ কিছুরই নেই তা বলিনে; গুরুতর গলদ আছে। সে জন্য এদের একদিন বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে। কিন্তু ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কথনও টেকে নাÑ সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে যদি বিদ্যার তত্ত্ব না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।’ কবিগুরুর এই সারগর্ভ অভিমতের কয়েক দশক পার হতে না হতেই সোভিয়েত রাশিয়া তার বৈপ্লবিক চরিত্র হারাতে বসে। সর্বজনীন সমতার ভিত্তিতে পুরো ব্যবস্থার ভিত সংহত হয়েছিল তা নড়বড়ে হতেও সময় লাগেনি। কারণ এই বৃহত্তর বিপ্লবের ওপর নানাজনের হরেক রকম তত্ত্বও মতবাদ আছে। পশ্চিমা ইতিহাসবিদগণ এই বিপ্লবকে দুর্ঘটনাজনিত একটি শৃঙ্খলের ফলাফল হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। বিপ্লবের সমর্থক গোষ্ঠীরা সোভিয়েত রাশিয়ার এই অনাকাক্সিক্ষত পতনকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থার অসঙ্গতি, মালিকানা সত্ত্বের অপপ্রয়োগ, পশ্চিমা দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদ, সংশোধনবাদের করাল নিষ্পেশনÑসব মিলিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনেক প্রতিকূল নির্দেশনাকে চিহ্নিত করেন। গত শতকের ৬০ আর ৭০-এর দশকে সোভিয়েত রাশিয়ায় যে চরম নৈরাজ্য বিপ্লবের মহান আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, সেখান থেকেও অবধারিতভাবে বলা যায়, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া তার গৌরবান্বিত মর্যাদা থেকে ছিটকে পড়তে ভেতর থেকে বিভিন্নভাবে তৈরি হচ্ছিল। বলা হয়, লেনিন পরবর্তী যুগ থেকে উদীয়মান রাশিয়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে সময় নেয়নি। ফলে বৈষম্যহীন অর্থনীতি সঙ্কটের মুখে পড়ে। তারপরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়ায়, সেটাও পঞ্চাশের দশকের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। লেখক : সাংবাদিক
×