ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাপী উদারনীতি পিছু হটছে

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৩০ অক্টোবর ২০১৮

বিশ্বব্যাপী উদারনীতি পিছু হটছে

উদারতাবাদ বা উদারনীতি থেকে আধুনিক বিশ্বের জন্ম। অথচ এই আধুনিক বিশ্বই আজ উদারতাবাদের বিরুদ্ধে কোমড় বেঁধে দাঁড়াচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকা আজ উদার এলিট শ্রেণীর বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের দ্বারপ্রান্তে। কারণ এই উদার এলিট শ্রেণীকে স্বার্থপর ও ধান্দাবাজ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যারা সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানে অসমর্থ বা অনিচ্ছুক। অন্যত্র ২৫ বছর ধরে স্বাধীনতা ও মুক্ত বাজারমুখী পরিবর্তন উল্টোদিকে যাত্রা করেছে। শীঘ্রই যে চীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে সেখানেও দেখা যাচ্ছে যে, একনায়কতন্ত্র টিকে থাকতে পারে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গভীর উদ্বেগজনক। কারণ উদারনীতি থেকে যে আধুনিক মনমানসিকতা, চিন্তা চেতনার সৃষ্টি তার মূল কথা হলো ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মর্যাদা। মুক্তবাজার, সীমিত সরকার ও মানব প্রগতিতে বিশ্বাসের প্রতি সর্বজনীন অঙ্গীকার। সামাজিক বিতর্ক ও সংস্কারের মধ্য দিয়েই ঐসব কিছু অর্জিত হয়েছিল। দীর্ঘ পৌনে দু’শত বছরে বস্তুগত ক্ষেত্রে অনেক চমকপ্রদ পরিবর্তন ঘটে গেছে। ১৮৪০ এর দশকের দারিদ্র্য ও দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে আজকের জীবনের তুলনা করলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। গত ১৭৫ বছরে মানুষের বৈশ্বিক গড় আয়ু ৩০ বছরের কিছু বেশি থেকে বেড়ে আজ দাঁড়িয়েছে ৭০-এরও বেশি। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের ভাগ যেখানে ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ, আজ তা আট শতাংশে নেমে এসেছে। সাক্ষরতার হার ৫ গুণ বেড়ে ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। নাগরিক অধিকার ও আইনের শাসন মাত্র কয়েক দশক আগে যা ছিল, তার চেয়ে এখন অনেক শক্তিশালী। অনেক দেশে ব্যক্তিরা কিভাবে কার সঙ্গে বসবাস করবে, তা বেছে নেয়ার ব্যাপারে এখন স্বাধীন। এসবকিছুই যে উদারপন্থীদের কর্মকা-ের ফলে হয়েছে, স্পষ্টতই তা নয়। তবে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ফ্যাসিবাদ, কমিউনিজম ও অন্যান্য মতবাদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর উদারপন্থী সমাজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। কোন না কোন রূপ ও চেহারায় উদারগণতন্ত্র পাশ্চাত্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে বসে এবং সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সর্বত্র। তবে রাজনৈতিক দর্শনসমূহ অতীতের গৌরবকে পুঁজি করে টিকে থাকতে পারে না। এদেরকে উন্নততর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিতেই হয়। আর এখানেই উদার গণতন্ত্র এক অনাগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। পাশ্চাত্যের ভোটাররা উদার গণতন্ত্র তাদের স্বার্থে কাজ করে কিংবা এটা একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা, এ নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। গত বছর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৬ শতাংশ জার্মান, ২৪ শতাংশ কানাডীয় ও ৯ শতাংশ ফরাসী মনে করে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের বাবা-মায়েদের চেয়ে ভাল অবস্থায় থাকবে। ৩৫ বছরের কম বয়সের মাত্র এক-তৃতীয়ংশ আমেরিকান বলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাস করা তাদের জন্য অপরিহার্য। সামরিক শাসনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত এমন মানুষের সংখ্যা ১৯৯৫ সালে ছিল ৭ শতাংশ। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশে। ফ্রিডম হাউস নামক এক এনজিওর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী নাগরিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার গত ১২ বছরে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৭ সালে তা ৭১টি দেশে খর্ব হয়েছে এবং মাত্র ৩৫টি দেশে প্রসারিত হয়েছে। এই ¯্রােতের বিরুদ্ধে অনেকে আবার এখনও উদারপন্থী ধ্যানধারণার শক্তিতে বিশ্বাস করেন। তারা মনে করেন যে, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র করব্যবস্থা, কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, শিক্ষা ও অভিবাসননীতি ঢেলে সাজিয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারে। তা করার জন্য অর্থনীতিকে কর্পোরেট মনোপলিগুলোর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা থেকে মুক্ত করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উদারপন্থীরা নিজেদের জয় হয়েছে ভেবে এতই উল্লসিতবোধ করেছিল যে, তাদের দৃষ্টি থেকে নিজেদের অপরিহার্য মূল্যবোধগুলো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আজ উদারনীতির পুনরুত্থান তাদের মধ্য থেকেই শুরু হতে হবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে আমেরিকার স্বাধীনতা, ফরাসী বিপ্লব এবং শিল্প ও বাণিজ্যের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যে টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তারই জবাবে উদারনীতিবাদের আবির্ভাব ঘটে। তখন বিপ্লবীরা জোর দিয়ে বলেছিল উন্নততর বিশ্ব গড়ে তুলতে হলে আপনার সামনে যে সমাজটি আছে সেটি আগে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলতে হবে। অন্যদিকে রক্ষণশীলরা পুরনো ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে এবং কিছু পরিবর্তন সেটা শাসক শ্রেণীর কিংবা কর্তৃত্ববাদী কোন নেতার অধীনে ম্যানেজ করে নিতে সচেষ্ট থাকে। এই দুই পক্ষের বিপরীতে প্রকৃত উদারপন্থীরা বলে যে তৃণমূল থেকে সমাজের ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে পরিবর্তন ঘটতে পারে। বিপ্লবীদের থেকে তাদের পার্থক্য এইখানে যে তারা এমন ধারণা প্রত্যাখ্যান করে যে অন্য কারোর মতবাদ মেনে নিতে মানুষকে জোর করে বাধ্য করতে হবে। রক্ষণশীলদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য এইখানে যে তারা জোর দিয়ে বলে যে অভিজাততন্ত্র ও উত্তরাধিকারতন্ত্র হলো বস্তুতপক্ষে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং এরাই নির্যাতনের উৎস। সুতরাং এক অস্থির, অশান্ত ও বিক্ষুব্ধ বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে উদারপন্থী ভাবধারার যাত্রা শুরু হয়েছিল। অথচ গত কয়েক দশকে ক্ষমতায় থেকে উদারপন্থীরা এত বেশি আরাম আয়েশ ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে যে, তারা সংস্কারের তীব্র প্রয়োজনবোধটুকু হারিয়ে ফেলেছে। শাসক উদারপন্থী এলিটশ্রেণী নিজেদেরকে আত্মপ্রসাদের সঙ্গে বলে যে তারা এক সুস্থ মেধাতন্ত্র অর্থাৎ মেধার ভিত্তিতে নির্বাচিত গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং সেই সূত্রেই নিজেদের সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে অন্য কথা। এটা ঠিক যে মেধাতন্ত্র যখন তুঙ্গে ছিল সে সময় প্রতিযোগিতার চেতনা থেকে আসাধারণ সমৃদ্ধি এবং নতুন নতুন ধ্যানধারণার জন্ম হয়েছিল। দক্ষতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার নামে সরকারগুলো বাজারসমূহকে প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ কখনই অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিশ্বায়নের ফলে উদীয়মান দেশগুলোতে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তারপরও উদারপন্থী শাসন ব্যবস্থায় অনেক বৈষম্য করা হয়েছে। ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় অর্থলগ্নিকারীদের এই সঙ্কটের হিং¯্র ছোবল থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিয়োগকর্তাদের করদাতাদের টাকায় উদ্ধার করা হয়েছিল। সবদিক দিয়েই উদারপন্থী মেধাতন্ত্র শেষ হয়ে গেছে। এখন এসেছে বিত্তের আধিপত্য। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ১৯৯৯-২০১৩ সময়ে আমেরিকার সবচেয়ে নামী ও অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আয়ের দিক থেকে সমাজের নিচের ৫০ শতাংশ পরিবার থেকে যত না ছাত্র ভর্তি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভর্তি হয়েছে শীর্ষ ১ শতাংশ পরিবার থেকে। ১৯৮০-২০১৫ অধ্যায়ে আমেরিকায় মধ্যম আয় যত বেড়েছে তার ১৭গুণ বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফি। ৫০টি বৃহত্তম শহর এলাকায় থাকে বিশ্বের ৭ শতাংশ মানুষ। উৎপাদনের ৪০ শতাংশ এরাই করে থাকে। অথচ এরা সেই অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা পায় না। মেধাতন্ত্র এই বৈষম্য দূর করতে পারে না। উদারপন্থীরা ভুলে গেছে যে, তাদের ভাবধারার অন্যতম ভিত্তি হলো স্বাধীনতা। আজ উদারপন্থী মেধাতন্ত্র এই স্বাধীনতাকে নিজেদের একান্ত কুক্ষিগত করে নিয়ে তার ওপর অস্বস্তির সঙ্গে বসে আছে। শাসক শ্রেণীর লোকেরা একটা বুদ্বুদের মধ্যে বাস করছে। তারা একই কলেজে যায়, তাদের নিজেদের মধ্যেই বিয়ে হয়, তারা একই এলাকায় থাকে, একই অফিসে কাজ করে। অন্যদিকে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা বেশির ভাগ মানুষ ক্রমবর্ধমান বস্তুগত সমৃদ্ধি নিয়ে তুষ্ট থাকবে বলে আশা করা হয়। তথাপি ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর উৎপাদনে যে স্থবিরতা নামে এবং আর্থিক ক্ষেত্রে যে কৃচ্ছ্রতা অনুসরণ করা হয়, তাতে সাধারণ মানুষের বৈষয়িক সমৃদ্ধি দানের সেই প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ হয়ে যায়। মূলধারার উদারপন্থী দলগুলোর প্রতি আনুগত্য কমে আসার এটা একটা কারণ। ১৯৯০ সালে জার্মানিতে উদারপন্থী দলগুলো ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছিল। সর্বশেষ নির্বাচনে সেই দলগুলোই পেয়েছে ৪৫ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে চরম দক্ষিণপন্থী, চরম বামপন্থী ও গ্রীন দলগুলো ৪১.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। লোকে এখন জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি গোষ্ঠীগত পরিচিতির দিকে ফিরে যাচ্ছে। তার ফলে উদারনীতির দ্বিতীয় সূত্র অভিন্ন স্বার্থ খ-িত হয়ে পড়ছে। প্রতিটি গোষ্ঠীর রাজনীতির সঙ্গে বাকি গ্রুপগুলোর রাজনীতির সংঘাত বাধছে এতে বিভাজন ও বৈরিতা বাড়ছে। বাড়ছে মেরুকরণ। এতে অনেক সময় দেখা দিচ্ছে অচলাবস্থা, অনেক সময় সৃষ্টি হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার। মন্দের মন্দ হলো এর পরিণতিতে চরম দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদীদের হাত শক্তিশালী হচ্ছে। ভূরাজনীতিতেও উদারপন্থীদের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমে ব্রিটিশ নৌশক্তির আধিপত্য এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির উত্থানের পটভূমিতে উদারনীতিবাদের বিস্তার ঘটেছিল। পক্ষান্তরে আজ ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ও রাশিয়ার বাহুবলের বিস্তারের পেক্ষাপটে উদারনীতিবাদ পিছু হটছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উদারনীতি থেকে যেসব উদার প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল, উদারনীতির সবচেয়ে বড় প্রবক্তা আমেরিকা সেগুলোকে অবহেলা করছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সরকার সেগুলোকে আক্রমণও করছে। এইভাবে বিশ্বব্যাপী উদারনীতি আজ সঙ্কটে পড়েছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×