ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্গীতাঙ্গনে স্থবিরতা

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৯ অক্টোবর ২০১৮

 সঙ্গীতাঙ্গনে স্থবিরতা

গৌতম পান্ডে ॥ প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও অনেকটাই হতাশায় নিমজ্জিত বাংলা সঙ্গীত অঙ্গনের মানুষরা। শোনার মাধ্যম দ্রুত বদলে যাওয়ায় শ্রোতারাও বিভ্রান্ত। গানের বোঝা বইতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। শিল্পী থেকে শুরু করে গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রী, অডিও কোম্পানি সবার মধ্যে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা। স্থিতিশীল নেই গানের বাজার। আর বাজার নিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতিও নেই। একটা সময় ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। মূলত নব্বইয়ের দশক থেকে এই শতকের শুরু পর্যন্ত ক্যাসেটে গানের এ্যালবাম প্রকাশ করা হতো। এরপর সিডি প্লেয়ারে গান শোনা শুরু হলে দ্রুত হারিয়ে যায় ক্যাসেট। কিন্তু বর্তমানে এ সবকিছুকে ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে অনলাইনে গানের প্রকাশনা। ইউটিউব, ফেসবুকের মাধ্যমে শ্রোতারা যে কোন সময় যে কোন স্থান থেকে উপভোগ করতে পারছেন সেইসব গান। সেই সঙ্গে বিভিন্ন মোবাইল এ্যাপ্লি কেশন্সের কারণে বদলে যাচ্ছে শ্রোতাদের গান শোনার অভ্যাস। অনেকেই একে বলছেন ডিজিটাল গানের যুগ। একটা সময় জনপ্রিয় কোন শিল্পীর ক্যাসেট ও সিডি লাখ লাখ কপি বিক্রি হতো। কিন্তু এখন আর তা নেই। ইউটিউবে গান প্রকাশ হচ্ছে। যার ফলে সেটা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও নেই। রাজধানীর অনেক সিডির দোকান বন্ধ হয়ে সেখানে হয়েছে পোশাকের দোকান। এর ওপর আবার ওয়েলকাম টিউন থেকে আয়ের পরিমাণ কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। যার ফলে কোম্পানিগুলো শুধু গানে বিনিয়োগ করছে খুব কম। এ বছর কোরবানির ঈদের পর এই গতি আরও কমে গেছে। এখন অনেকটাই স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে সঙ্গীতাঙ্গনে। অন্যদিকে ইউটিউবে যার ভিউ যত বেশি তার দিকেই ঝুঁকছে কোম্পানিগুলো। কারণ ইউটিউবই এখন সবচাইতে বড় মাধ্যম গান থেকে আয়ের। এর ফলে ভিউনির্ভর শিল্পীদেরই প্রাধান্য বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার ফলে মূলধারার শিল্পীদের বড় একটা অংশের ভেতর হতাশা আরও বেশি ভর করেছে। কারণ তাদের কাজ কমে গেছে। এমতাবস্থায় সার্বিকভাবেই সঙ্গীতাঙ্গনে হতাশার কালো ছায়া বিরাজ করছে। এখান থেকে কবে নাগাদ বের হওয়া যাবে সে বিষয়টিও নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো গানের বদলে ঝুঁকছে নাটক কিংবা ওয়েব সিরিজ নির্মাণের দিকে। গানের চাইতে ইউটিউবে নাটক কিংবা ওয়েব সিরিজের কাটতি বেশি বলে অনেক সঙ্গীত কোম্পানি এখন নাটকে বিনিয়োগ করছে। কোন কোন সময় নাটক কিংবা ওয়েব সিরিজে ব্যবহার করা হচ্ছে গান। সেক্ষেত্রে গানটি পরে ভিডিওসহ আলাদা প্রকাশ করা যাচ্ছে। কিন্তু এর ফলে কাজ কমছে শিল্পীদের। কারণ কোম্পানি একটি কাজে বিনিয়োগ করে তিনটি অডিও-ভিডিও পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে মুনাফাটাও বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পীর বাইরে অন্য কোন শিল্পীর গান করে ঝুকিও নিতে চাচ্ছে না কোম্পানিগুলো। সবমিলিয়ে এখন একটি তথৈবচ অবস্থা বিরাজ করছে সঙ্গীতাঙ্গনে। এ প্রসঙ্গে সঙ্গীতশিল্পী ফাহমিদা নবী বলেন, সত্যি বলতে আমিও এসব বিষয় নিয়ে বিরক্ত। ভাল শিল্পীদের মূল্যায়নটা সেভাবে হচ্ছে না। যার ফলে দেশের সঙ্গীতের ভবিষ্যত নিয়ে আমি শঙ্কিত। এক্ষেত্রে তারকা শিল্পী ছাড়াও আরও বিপাকে পড়ছে নতুন শিল্পীরা। কারণ তারা কোন ধরনের সাপোর্টই পাচ্ছে না। অনেকে মেধা থাকা সত্ত্বেও অর্থ খরচ করে গান করতে পারছে না। যার ফলে অনেক মেধাবী সঙ্গীতাঙ্গনে প্রবেশের আগেই হারিয়ে যাচ্ছে। অথবা তাদের মধ্যে সঙ্গীতাঙ্গন সম্পর্কে একটি বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবারই এগিয়ে আসা উচিত। আর কোম্পানি যেহেতু বিনিয়োগ করছে তাই তারকা শিল্পীদের পাশাপাশি নতুন শিল্পীদের নিয়েও ভাবা উচিত। শুধু কাটতি নিয়ে ভাবলে তো আর চলবে না। সঙ্গীতাঙ্গনে যার যার জায়গা থেকে কমিটেড হতে হবে। তা নাহলে পিছিয়ে যাব। কাজ হচ্ছে কিন্তু এগুলো নিয়ন্ত্রণের অভাবটাও বাড়ছে। প্রকৃত শিল্পীকে খুঁজে বের করতে হবে। জনপ্রিয় গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়জী এ প্রসঙ্গে বলেন, আগে গানের সংখ্যা কম ছিল এখন সে তুলনায় অনেক বেশি। তখন রেডিও এবং ক্যাসেটনির্ভর ছিল গান শোনার উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। এখন ডিজিটাল হয়েছে। সবাই ইউটিউবে গান শোনে। সঙ্গে সঙ্গে গান এখন দেখার বিষয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিউজিক ভিডিও বলি যাকে, তার মাধ্যমে গান শোনার পাশাপাশি বিভিন্ন দৃশ্য বা মোমেন্ট উপভোগ করে দর্শক। তবে আগের গানের আবেদন বেশি ছিল। যে গানে সবাইকে মানবিক করে তোলে সেই গানের খুবই দরকার। তিনি বলেন, এখন ডিজিটালি গান প্রকাশ হচ্ছে ঠিক আছে। তবে আমি মনে করি একটা নিয়মের মধ্যে সবকিছু চলা উচিত। কিন্তু কোন নিয়মই দেখতে পাই না। আর যে সমস্যাগুলো আছে তা একসঙ্গে বসে সমাধান করা উচিত। প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে অডিও কোম্পানি, শিল্পী ও সঙ্গীত সংশ্লিষ্টরা বসে আলোচনা করা উচিত। আমার মনে হয় সবার চেষ্টা থাকলে যে কোন সমস্যাই মোকাবেলা করা সম্ভব। সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজারভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজহারুল ইসলাম জানান, এখন অডিও ইন্ডাস্ট্রির প্রকৃত অবস্থাটা খুব খারাপ। কারণ গান থেকে আয়ের অঙ্ক উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। এ অবস্থায় নতুন গানে খুব বেশি বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। গান আমরা প্রকাশ করছি। কিন্তু তার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়। সবমিলিয়ে অডিও ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা সত্যিই নাজুক। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের। আশা করছি হয়তো কোন সমাধান বের হয়ে আসবে। তবে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে সঙ্গীতের এই হতাশা দূর করতে আলোচনার কোন বিকল্প নেই।
×