ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সামুদ্রিক নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৯ অক্টোবর ২০১৮

সামুদ্রিক নিরাপত্তা

সাগরজুড়ে সম্পদের সমাহার ব্যাপক। কিন্তু এই সম্পদকে যথাযথভাবে মানুষের কাজে লাগানোর ক্ষেত্রটি সহজ নয়। তদুপরি রয়েছে সম্পদ রক্ষায় নিরাপত্তার প্রশ্নটি। এমনিতে দেশের টেকসই উন্নয়নে সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগানো জরুরী হয়ে পড়েছে। এজন্য সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। কারণ, দেশের সমুদ্রসীমা ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে। দেশের সমুদ্রসীমা প্রভূত সম্পদের আধার। এখানে যেমন অধিক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে ব্যাপক জ্ঞান লাভের সুযোগও রয়েছে। তেল, গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি মৎস্য আহরণ, জাহাজ নির্মাণ শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা অপার। উপকূলের সম্পদ আহরণ ও নিরাপত্তা রক্ষার কাজটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী তাদের জীবন-জীবিকার জন্য সমুদ্র সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। তাই দেশের সমুদ্রসীমাকে সর্বাগ্রে নিরাপদ করা জরুরী। এক্ষেত্রে এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে আগামীতে এ অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তা আরও জোরদার করার উপায় উদ্ভাবনের বিকল্প নেই। কোন দেশের একার চেষ্টায় সমুদ্রপথের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী জাহাজের নিরাপদ চলাচল অপরিহার্য। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় নব্বই শতাংশ সমুদ্রপথেই হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকায় মাদক পাচার, অবৈধ অস্ত্র পাচার, মানবপাচার, অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণ, জলদস্যুতা, সশস্ত্র ডাকাতি এবং আরও বিভিন্ন ধরনের অবৈধ কার্যকলাপ প্রায়ই সংঘটিত হয়ে থাকে। এসব অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে শুধু দেশীয় নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অপরাধীরাও জড়িত থাকে। অপরাধীরা অনেক সময় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে থাকে। কাজেই কোন একক দেশের পক্ষে এদের দমন করা সম্ভব নয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলেই এসব কর্মকা- দমন করা সম্ভব এবং তা অপরিহার্য। পৃথিবীর সত্তর শতাংশ মানুষ সমুদ্র উপকূলের একশ’ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করে। মানবসভ্যতায় সমুদ্রের গুরুত্ব এ থেকেই অনুধাবন করা যায়। বাংলাদেশ সৌভাগ্যবান এজন্য যে, বাংলাদেশ নামক বদ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল। তিন বিভাগের ১২টি জেলার অবস্থান সমুদ্র তীরে। এসব জেলার জনগণের জীবন-জীবিকা অনেকটাই সমুদ্রনির্ভর। এ কারণেই সমুদ্রে নিরাপত্তা বিধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলবর্তী দেশ হিসেবে বঙ্গোপসাগরে এ দেশের মানুষের নানাবিধ স্বার্থ জড়িত। বঙ্গোপসাগরের অপর দুই অংশীদার ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানা নির্ধারিত না থাকায় বিগত চার দশকে বাংলাদেশ সমুদ্র তলদেশের সম্পদ আহরণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জেলে সম্প্রদায় মৎস্য আহরণে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এদেশের মৎস্যসম্পদ অন্য দেশের জেলেরা অবাধে শিকার করেছে। কোন প্রতিকার করা যায়নি। খনিজ ও অন্যান্য সম্পদে ছিল না অধিকার। সমুদ্রে ও সমুদ্রসম্পদে জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৪ সালে ‘দি টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স এ্যান্ড মেরিটাইম জোন্স এ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তিও সই হয়। ২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকার ‘আনক্লজ’ অনুসমর্থন করে এবং এর মধ্য দিয়ে সমুদ্রে ন্যায্য অধিকারের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরে সিসমিক জরিপ সম্পাদিত হয়। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরেও বাংলাদেশের মহীসোপানের দাবি পেশ করে। দীর্ঘ শুনানির পর ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনবিষয়ক ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয়। ফলে মহীসোপানে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। একইভাবে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়। ফলে প্রায় সাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার ওপর বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিশাল জলরাশির তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে তা আহরণ করা গেলে দেশ উন্নয়নের পথে আরও এগিয়ে যাবে। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা বহাল রেখে সম্পদ আহরণ দুষ্কর। এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিরাপত্তার ঝুঁকিসমূহ মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা। বাংলাদেশ সেই পদক্ষেপ নিচ্ছে।
×