ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

ভোগ্যপণ্য রফতানিতে নতুন রেকর্ড

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

ভোগ্যপণ্য রফতানিতে নতুন রেকর্ড

বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে উৎপাদিত মুগডাল ক্রমে কৃষকের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এসব অঞ্চলের মুগডাল জাপানী মানুষের খাদ্য তালিকার শীর্ষে জায়গা করে নিচ্ছে। আর এ কারণে বাড়ছে মুগডালের চাষ। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় ছাড়াও এ কাজে এগিয়ে এসেছে কয়েকটি সরকারী-বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। কৃষক ও মুগডালের জাত নির্বাচনসহ উৎপাদন থেকে শুরু করে রফতানি, সব কাজেই সহায়তা করছে এসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। ফলে মুগডালের চাষ করে কৃষকরা লাভ করছে অর্থনৈতিক সফলতা। বিশেষজ্ঞদের মতে-ডাল বাংলাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর খাদ্যতালিকায় উদ্ভিদ উৎস থেকে পাওয়া পূর্ণ আমিষ সমৃদ্ধ অন্যতম খাদ্য। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ছাড়াও শর্করা, চর্বি ও খনিজ উপাদান রয়েছে। মুগ, মসুর, মাষকলাই, ছোলা, মটর প্রভৃতি যে কোন ডালই মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং উপকারী। তবে নিরামিষ ভোজীদের জন্য মুগডাল আরও জনপ্রিয় একটি খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে এ্যামাইনো এসিড ও উচ্চমাত্রার প্রোটিন রয়েছে, যা শরীরে আমিষের ঘাটতি পূরণ করে। মুগডালের প্রধান উপকার হলো-এটি হজমে সহায়তা করে এবং শরীরের পরিপাকনালীর মধ্যে যে বিষাক্ত পদার্থ আছে তা বের করে দেয়, ফলে হজমশক্তি বাড়ে। কাজেই নিরামিষ ভোজীরা প্রতিদিনের ডায়েটে এ খাবারটি রাখে। এছাড়া এতে লেসিথিন নামে এমন এক ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা যকৃতে চর্বি জমাতে বাধা দেয়। মুগডালে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় ক্ষুধা কম লাগে। এতে এমন একটি উপাদান রয়েছে যা কান্সারের কোষগুলো ধ্বংস করতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য হজমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং বিভিন্ন রোগের হাত থেকে বাঁচায়। মুগের এতগুণাবলী থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে বাংলাদেশে ৬ লাখ হেক্টর জমিতে ৫ লাখ টন ডাল উৎপাদিত হয়। যা চাহিদার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ পূরণ করে। বাকিটা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে- গত কয়েক বছরে মুগডালের আবাদ অনেক বেড়েছে। এর প্রধানতম দুটি কারণের একটি হচ্ছে- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা প্রায় একইসঙ্গে পাকে এবং ফলনও ভাল। উদ্ভাবিত জাতগুলো হলো : বারিমুগ-৫, বারিমুগ-৬, বিনামুগ-৫, বিনামুগ-৭, বিনামুগ-৮ এবং বিইউমুগ-৪। জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো- গাছের উচ্চতা খাট থেকে মাঝারি অর্থাৎ ৩৫-৪০ সে.মি.। জীবনকাল কম অর্থাৎ বীজ বপন থেকে পরিপক্ব পর্যন্ত সময় লাগে ৬৫-৭০ দিন। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ১.৮ টন এবং ভাইরাস সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। মুগডালের উৎপাদন বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে উৎপাদন বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- জাপানে রফতানি। গত কয়েক বছর ধরেই এসব অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ মুগডাল জাপানে রফতানি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাপানীরা বরাবরই খাদ্য সচেতন। তারা প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ফসলে অধিক গুরুত্ব দেয়। এরই সূত্রে জাপানীরা মুগডাল দিয়ে এক ধরনের অঙ্কুর তৈরি করে। যা সবজি এবং স্যুপে খাবার হিসাবে ব্যবহার হয়। মুগাঙ্কুর সালাদ হিসাবেও খাওয়া হয়। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। জাপানীরা তাই মুগাঙ্কুর তৈরির জন্য বেছে নিয়েছে বাংলাদেশের মুগডাল। চলতি বছরে কেবলমাত্র দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী থেকে জাপানে ৭০০ টন মুগডাল রফতানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর একটি অংশ এরই মধ্যে জাপানে রফতানি হয়েছে। পটুয়াখালী থেকে ২০১৩ সালে ১০৪ টন এবং ২০১৪ সালে ১০৭ টন মুগডাল জাপানে রফতানি করা হয়। জাপান-বাংলাদেশ সোশ্যাল বিজনেসের আওতায় একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান মুগডাল রফতানি করছে। সংস্থাটি প্রথমে কৃষক ও প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মুগডাল সংগ্রহ করে। তারপর সেটা প্রক্রিয়াজাত করে জাপানে পাঠানো হয়। পটুয়াখালী জেলা বরাবরই মুগডাল চাষে এগিয়ে। দেশে যে পরিমাণ মুগডাল উৎপাদন হয়- তার ৬০ শতাংশ ডাল উৎপাদন হয় পটুয়াখালীতে। এ বছর জেলায় ৭২ হেক্টর জমিতে মুগডালের চাষ হয়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে মুগডাল চাষ সহজ। খরচ কম। জাপানে রফতানি হচ্ছে। দাম বেশি পাচ্ছে। লাভও বেশি হচ্ছে। তাই মুগডাল চাষে চাষীদের আগ্রহ বাড়ছে। মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পটুয়াখালী অঞ্চলে বারি-৬ জাতের মুগডালের আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। মুগডাল চাষকে আরও সহজ করতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ডাল বীজ বপন যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। এ যন্ত্র ব্যবহার করে জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে ডালের বীজ বপন করা হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ কমার পাশাপাশি ফলনও বেশি পাচ্ছে। প্রথমবারের মতো এবার ভোলা থেকেও জাপানে মুগডাল রফতানি হচ্ছে। ভোলায় এ বছর ২৫ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে মুগডালের চাষ হয়েছে। হেক্টর প্রতি গড় ফলন হয়েছে দেড় টন, যেটাকে বাম্পার ফলন বলা যায়। আবাদ করা মুগের মধ্যে বেশি হয়েছে উন্নত জাতের বারি মুগ-৬। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ায় কৃষকরা উপকৃত হয়েছে। কৃষকরা বিনামূল্যে উন্নত জাতের বীজ, প্রশিক্ষণ এবং কম সুদে ঋণ পেয়েছে। ডাল বিক্রির ক্ষেত্রে সহায়তা দেয়ায় কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পেয়েছে। এরইমধ্যে ভোলা থেকে জাপানে রফতানির উদ্দেশ্যে ৩০ টন মুগডাল কেনা হয়েছে। স্থানীয় একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা জাপানে রফতানির উদ্যোগ নেয়ায় বরগুনা জেলাতেও বেড়েছে মুগডালের চাষ। এবার ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে মুগ ডাল চাষ হয়েছে। যা আগের বছরের থেকে পরিমাণে ১০ হাজার হেক্টর বেশি। কেবলমাত্র রফতানির কারণে বরগুনায় প্রথমবারের মতো বারি-৬ নামের মুগডালের চাষ হয়েছে। প্রথমবারেই বাম্পার ফলন হয়েছে। যেখানে অন্যান্য জাতের মুগডালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা, সেখানে বারি-৬ নামের এ মুগডালের কেজি বিক্রি হয়েছে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বাড়তি দরে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। রফতানির সুবাদে দক্ষিণের ন্যায় পশ্চিমের জেলাগুলোতেও মুগ ডালের চাষ বাড়ছে। এবার যশোর জেলায় ১ হাজার ৪৪৫ হেক্টরে, ঝিনাইদহ ৪ হাজার ৮৯১ হেক্টরে, মাগুরায় ৬৫২ হেক্টরে, কুষ্টিয়ায় ৫০৫ হেক্টরে, চুয়াডাঙ্গায় ৩ হাজার ৮৫০ হেক্টরে ও মেহেরপুরে ৫৯ হেক্টরে গ্রীষ্মকালীন বারি মুগ-৬ এর চাষ হয়েছে। এ মুগের ফলন ভাল। এবার হেক্টর প্রতি গড় ফলন হয়েছে এক দশমিক ৬১ টন। আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ) এর অর্থায়নে রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশন (আরআরএফ) রফতানির জন্য কৃষকদের উন্নত মানের মুগডাল চাষে সহায়তা দিয়েছে। জেলাগুলো থেকে জাপানী সংস্থা গ্রামীণ ইউগ্নেনা এবার ২৮ টন মুগডাল কিনে সরাসরি রফতানি করছে। এছাড়া অপর একটি প্রতিষ্ঠান ঝিনাইদহ ও টুয়াডাঙ্গার তিনটি উপজেলা থেকে মোট ৫০ টন মুগডাল কিনেছে। এক সময়ে পটুয়াখালীসহ দক্ষিণ অঞ্চলের কৃষকরা শুধু আমন ধান আবদ করত। কিন্তু বর্তমানে চাষাবাদের নতুন নতুন কৌশল ও জাত উদ্ভাবিত হওয়ায় কৃষকরা এখন দুই থেকে তিনটি ফসল আবাদ করতে পারছে। এমনই একটি ফসল মুগডাল। বর্তমান বছরে এ অঞ্চলের কৃষকরা বারি মুগ-৬ জাতের ডাল আবাদ করে ভাল ফলন পেয়েছে। এর ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ অঞ্চলের কৃষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে। কৃষকরাও হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। ক্রমে শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে আমাদের কৃষি অর্থনীতি।
×