ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ রেজাউল করিম

সমুদ্রপথে বাণিজ্য ও আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

সমুদ্রপথে বাণিজ্য ও আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্য গত ৫ বছরে প্রায় ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ অথর্বছরে দেশে ৫১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। রফতানি হয়েছে ৩৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এ হিসেবে বছরে গড়ে বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ছে চার দশমিক নয় শতাংশ হারে। যেহেতু এই ধারা অব্যাহত থাকবে তাই বৈদেশিক বাণিজ্যের বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের দরকার বন্দরকেন্দ্রিক অবকাঠামো। বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের পণ্য আমদানি-রফতানির জন্য সমুদ্রপথ, স্থলপথ এবং আকাশপথ রয়েছে। সমুদ্রপথে দুটি বন্দর, স্থলপথে ১১টি এবং আকাশপথে তিনটি বিমানবন্দর দিয়ে এসব পণ্য আনা-নেয়ার সুযোগ আছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যে পণ্য পরিবহনের মোট পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৬২ লাখ টন। পণ্য পরিবহনের হিসাবে দেখা যায়, সমুদ্র, স্থল ও আকাশপথের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয়েছে সমুদ্রপথে। বাকি সাড়ে ১৮ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয়েছে স্থলবন্দর ও বিমানবন্দর দিয়ে। বৈশ্বিক পণ্য পরিবহনেরও ৯০ শতাংশ পরিবহন হয় সমুদ্রপথে। তিন পথের মধ্যে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এখন তিনটি বন্দর রয়েছে। এই তিনটি হলো চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা। অবশ্য পায়রাবন্দরের কাজ এখনও শেষ হয়নি। ফলে এখন মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভর করতে হবে। আবার মংলাবন্দরে নাব্য কম থাকায় এবং ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় এই বন্দর দিয়ে পণ্য রফতানিও সেভাবে হচ্ছে না। তবে পদ্মা সেতু হলে মংলাবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন বাড়বে বলে আশা করা যায়। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, দুই বন্দরে গত অর্থবছর নয় কোটি ৪৭ লাখ টন পণ্য পরিবহন হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন হয়েছে সাড়ে আট কোটি টন, যা মোট পণ্যের ৯০ শতাংশ। মংলাবন্দর দিয়ে পরিবহন হয় ১০ শতাংশ বা ৯৭ লাখ টন। শিল্পকারখানার কাঁচামাল আমদানি এবং রফতানি পণ্য পরিবহন হয় মূলত কনটেইনারে। কনটেইনারে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনের বন্দরকেন্দ্রিক বিতরণ ব্যবস্থা ততটা সন্তোষজনক নয়। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে কনটেইনার পরিবহনের সূচনার পর থেকে দিন দিন চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চট্টগ্রাম দিয়ে ২৭ লাখ টিইইউএজ কনটেইনার পরিবহন হয়, যা সমুদ্রপথে মোট কনটেইনারের ৯৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। মংলাবন্দর দিয়ে পরিবহন হয় এক দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ৪২ হাজার ৯৮৯ টিইইউএজ। সমুদ্রবন্দর কেন্দ্রিক কনটেইনার পণ্য পরিবহনের সুষম বিতরণ ব্যবস্থা না থাকায় এখন সব চাপ পড়েছে চট্টগ্রামের ওপর। এর ফলে বন্দরে জাহাজ জট হচ্ছে। কনটেইনার জট বাড়ছে। যেভাবে পণ্য পরিবহন বাড়ছে তাতে দ্রুত নতুন টার্মিনাল নির্মাণ জরুরী হয়ে পড়ছে। সর্বশেষ অর্থবছরেই জেটিগুলোতে ৯৩ শতাংশ সময় জাহাজ অবস্থান করছে। অর্থাৎ নতুন জেটি নির্মাণের প্রয়োজনীতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশী ভারতে একদশক ধরে বড় বন্দরগুলোর কনটেইনার পরিবহনের মার্কেট শেয়ার কমেছে। নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করায় এককভাবে কার্যত চাপ নেই কোন বন্দরের ওপর। ভারতের ২৪টি কনটেইনার টার্মিনালে পণ্য পরিবহন ক্ষমতা দুই কোটি ৭০ লাখ টিইইউএজ কনটেইনার। সেখানে গত অর্থবছর (২০১৭-১৮) কনটেইনার পরিবহন হয়েছে এক কোটি ৫৩ লাখ টিইইউএস কনটেইনার। এর মধ্যে শুধু এপিএম টার্মিনাল মুম্বাই এবং আদানি মুন্দ্রা টার্মিনালে কনটেইনার পরিবহন ক্ষমতার সামান্য বেশি কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। সমুদ্রপথে ক্রমবধর্মান বাণিজ্যের কারণে সরকার বহু আগেই সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। ভূরাজনৈতিক কারণে সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অনিশ্চয়তার পর সরকার বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বে- টার্মিনাল নামে নতুন বন্দর নির্মাণ। এই তিনটিই বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের এখনই বে-টার্মিনাল নির্মাণে প্রথমে জোর দেয়া উচিত। কারণ বে-টার্মিনাল থেকে নৌ, সড়ক ও রেলপথে ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। অন্য দৃটি প্রস্তাবিত বন্দরে যেটি নেই। বে-টার্মিনাল চট্টগ্রাম শহরের বাইরে থাকায় শহরে কোন প্রভাব পড়বে না। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায়ও বে-টার্মিনালকে চমৎকার সাইট হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বড় প্রকল্পগুলো আসার আগেই বন্দরে এখন জট শুরু হয়েছে। ইন্টারিম পিরিয়ড সামাল দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পতেঙ্গায় তিন জেটির একটি টার্মিনাল নির্মাণ শুরু করেছে। মংলায়ও দুটি জেটি নির্মাণ হচ্ছে। এই দুটো ছোট প্রকল্প চালু হওয়ার পর আরও নতুন নতুন জেটির দরকার হবে। সেজন্য কনটেইনার ডেলিভারি পদ্ধতি আমূল পরিবর্তনে নজর দিতে হবে। পণ্য কীভাবে কত দ্রুত গন্তব্যস্থলে নেয়া যাচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে খরচের পরিমাণ। খরচ যত কম হবে রফতানিকারকরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তত এগিয়ে থাকবে। রফতানি পণ্যের বড় অংশই ঢাকা অঞ্চল থেকে হয়। ঢাকা থেকে রেলপথে মাত্র চার শতাংশ রফতানি পণ্য নেয়া হয় বন্দরে। খুবই নগণ্য পরিমাণ কনটেইনার নৌপথে নেয়া হচ্ছে এখন। বাকি সবই প্রথমে কারখানা থেকে কাভার্ড ভ্যানে চট্টগ্রামের ডিপোগুলোতে নেয়া হচ্ছে। এরপর সেখানে কনটেইনারে স্টাফিং করে বন্দরে পাঠানো হচ্ছে। সড়কপথের ওপর নির্ভরতার কারণ হলো রফতানি পণ্য প্রথমে কারখানা থেকে কাভার্ড ভ্যানে করে কনটেইনার ডিপোতে নিতে হয়। নৌ-টার্মিনাল ছাড়া সবগুলোই কনটেইনার ডিপো চট্টগ্রামে। আবার আমদানি করা কাঁচামাল বন্দর থেকে খালাস করে সহজে কাভার্ড ভ্যানে কারখানায় নেয়া যায়। রেলপথ ভিত্তিক একমাত্র আইসিডি ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। অথচ কারখানাগুলো মূল শহরের বাইরে। ফলে ঢাকার যানজট ফেলে শহরের প্রাণকেন্দ্রে পণ্য নিয়ে আসা কষ্টসাধ্য। বরং গাজীপুরের ধীরাশ্রমে প্রস্তাবিত রেলপথভিত্তিক আইসিডি করা গেলে রেলপথে পণ্য পরিবহন বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে পণ্য রফতানিবাবদ অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন রফতানি আয়ের লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। অর্থনৈতিক অঞ্চল আসার আগে এখনই দেশে কনটেইনার পরিবহনের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে প্রতিবছর ১৩ শতাংশ হারে (গত ৫ বছরের গড় হিসেবে)। অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে কয়েক শতাংশ বাড়তি হারে প্রবৃদ্ধি হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলায় সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠবে। সেখানে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এসব শিল্পকারখানার কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রফতানির জন্যও দরকার হবে বন্দর অবকাঠামো। ট্রানজিট পরিবহন বিশেষ করে ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনের বড় অংশই পরিবহন হবে চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর দিয়ে। ভবিষ্যতে এই চাপ মোকাবেলা করার জন্য দ্রুত অবকাঠামো নির্মাণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো লজিস্টিকস। কাঁচামাল আমদানি করে কারখানায় নেয়া, কারখানায় উৎপাদিত পণ্য পরিবহন করে জাহাজে তুলে দেয়ার জন্য অবকাঠামো ও প্রক্রিয়াগত সেবার সমন্বিত নেটওয়ার্ক লজিস্টিকসের আওতাভুক্ত। কম সময়ে এবং কম খরচে লজিস্টিকস সেবা পাওয়ার ওপর নির্ভর করে পণ্য রফতানিতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় কোন দেশ এগিয়ে থাকবে। বতর্মান সরকারের আমলে লজিস্টিকস খাতে বেশ উন্নয়ন হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আনা-নেয়ার প্রধান পথ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। নৌপথে কনটেইনার পরিবহন চালু হয়েছে। রেলের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। কাস্টমস খাতে অনলাইন শুল্কায়ন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তবে পরিবহন খাতে বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। বাংলাদেশে লজিস্টিক খাতেও বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ আছে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে গত দুই বছর ধরে জাহাজ জট লেগে আছে। বড় প্রকল্পগুলো আসার আগে এই জট কমবে না। সঠিক সময়ে কাজ হলেও অন্তত পাঁচ-ছয় বছর লাগবে বড় প্রকল্পগুলোর আলোর মুখ দেখতে। এ সময়ে পণ্য পরিবহনে যে প্রবৃদ্ধি হবে তা মোকাবেলা করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সে জন্য শিপার্স কাউন্সিলের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো। এক. চট্টগ্রাম বন্দরে গত পঁাঁচ বছরে গড়ে ১১.৮৬ শতাংশ হারে বাড়ছে কনটেইনার জাহাজ। এখন ১৯০ মিটার লম্বা এবং সাড়ে নয় মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো যায় বন্দরে। শিপিং কোম্পানিগুলো এই সুবিধার পূর্ণ ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত বড় ফিডার জাহাজ এই রুটে পরিচালনা করলে জাহাজের সংখ্যা দ্রুত বাড়বে না। এজন্য পূরনো ও জরাজীর্ণ কনটেইনার ফিডার জাহাজ এই রুট থেকে তুলে নিয়ে বেশি ধারণক্ষমতার জাহাজ নামানো হলে জাহাজপ্রতি কনটেইনার পরিবহন ক্ষমতা বাড়বে। দুই. শোর সাইডে জট নিরসনের জন্য দরকার নতুন নতুন ইয়ার্ড। বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি ব্যবস্থা বাইরে নিয়ে বন্দর ইয়ার্ডের জট কমানো যায়। ইয়ার্ডে কনটেইনারের সংখ্যা কমলে জাহাজ থেকে কনটেইনার হ্যান্ডলিংও দ্রুত হবে। রফতানির জন্য আলাদা ইয়ার্ড করা হলে আগে থেকেই বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার এনে রাখা যাবে। ডেলিভারি ব্যবস্থা বাইরে নেয়ার জন্য বতর্মানে বে-টার্মিনালের প্রস্তাবিত জমিতে ইয়ার্ড নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর। এটি ভাল উদ্যোগ। তবে সেখানে নেয়ার জন্য ডেডিকেটেড রোড বা রেললাইন লাগবে। এসব পথের নির্মাণকাজ এখনই শুরু করে দিতে হবে। তিন. দেশীয় অপারেটররা এতদিন কনেটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করে আসছে। এই খাতে বেসরকারীকরণ করা হয়নি। ২০০৮-০৯ সময়ে নিউমুরিং টার্মিনাল বিশ্বখ্যাত অপারেটরদের মাধ্যমে পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হলে বন্ধ হয়ে যায়। এখন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের তিনটি টার্মিনাল টুলপোর্ট হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। নতুন যেসব টার্মিনাল আসছে সেগুলোতে ল্যান্ডপোর্ট ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করতে হবে। লেখক : চেয়ারম্যান, শিপার্স কাউন্সিল অফ বাংলাদেশ
×