ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাতালের পানির অধিক ব্যবহার- ৮০ ভাগই সেচ কাজে

নেমে যাচ্ছে পানির স্তর

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

নেমে যাচ্ছে পানির স্তর

সমুদ্র হক ॥ গত চার দশকেরও বেশি সময়ে দেশে পাতালের (ভূতল বা ভূগর্ভের) পানি ব্যবহার অস্বাভাবিক বেড়েছে। বর্তমানে সুপেয় পানি প্রাপ্তি ও চাষাবাদের সেচে পানির ৮০ শতাংশই মেটাতে হয় পাতালের উৎস থেকে। সাধারণ সেচনালায় এই পানির প্রায় অর্ধেক অপচয় হয়। অপরিকল্পিতভাবে গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে পানি উত্তোলনের ফলে আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে পাতালের পানি। প্রভাব পড়ছে প্রকৃতির ওপর। পাতালের পানি অপচয় রোধে সেচযন্ত্র স্থাপনে গত বছর সমন্বিত ক্ষুদ্র সেচ নীতিমালা-২০১৭’র খসড়া মন্ত্রিসভা বিভাগ থেকে অনুমোদন পায়। কৃষি বিভাগের এক সূত্র জানায়, প্রকৃতি, মৃত্তিকার অবস্থা পর্যালোচনা করে এই খসড়াকে আরও যুগোপযোগী করে তোলা হচ্ছে। আরেকদিকে ভূ-উপরিস্থ পানি (সারফেস ওয়াটার) ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কৃষকদের ভূ-উপরিস্থ পানির অধিকতর ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। শুকনো মৌসুমে বোরো আবাদে সেচের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপে পানি উত্তোলন বেড়ে যায়। যা উত্তোলন করা হয় পাতাল থেকে। বোরো আবাদটি সম্পূর্ণ সেচ নির্ভর। ষাটের দশকের মধ্যভাগে পাতালের পানির সেচ দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইরি) ধানের আবাদ শুরু হয়। এই আবাদ বেড়ে গেলে তা সেচ নির্ভর বোরো মৌসুমে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ব্রি) শুকনো মৌসুমে সেচ নির্ভর ধানের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে থাকে। বর্তমান যার পরিচিতি বোরো ধান। আধিক উৎপাদনের এই বোরো খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে রফতানি মুখী হয়েছে। এই ধান আবাদে গতি আনতে সত্তর দশকের মধ্যভাগে দেশে কোরিয়ার প্রকৌশলীরা এসে গভীর নলকূপ বসায়। এরপর ব্রিটেনের ম্যাকডোনাল্ড এ্যান্ড পার্টনার গভীর ও অগভীর উভয় ধরনের নলকূপ বসাতে থাকে। গভীর নলকূপ ইংরেজী ‘ডিপ টিউবওয়েল’ নামটি পারচিতি পায়। অগভীর নলকূপ পরিচিতি পায় শ্যালো টিউবওয়েল নামে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) সেচ বিভাগ সমবায় ভিত্তিতে গভীর নলকূপ বসানো কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) এক সূত্র জানায়, শুকনো মৌসুমের আবাদে সেচের ৮০ শতাংশ পানি সংগ্রহ করা হয় পাতালের উৎস থেকে। বাকি ২০ শতাংশ পানি মেলে ভূ-উপরিস্থ (সারফেস) থেকে। বিএডিসির গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ অনুযায়ী দেশের ৩৫ জেলার পাতালের পানির স্তর প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নেমে যাচ্ছে। যার মধ্যে উত্তরাঞ্চলের জেলা বেশি। পদ্মা ব্রহ্মপুত্র মেঘনা অববাহিকা বিস্তৃত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাতালের পানির স্তর প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার হারে নামছে। কৃষিতে যন্ত্র শৈলী প্রবেশের পর আধুনিক কৃষিতে পাতালের পানি ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে। এই ব্যবহার আর সীমিত করা যায়নি। আশির দশকের উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকা রাজশাহী নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রুক্ষè মাটিতে গভীর নলকূপ বসিয়ে এক ফসলি জমিকে বহুমুখী ফসলে রূপান্তরিত করা হয়। এরপর সারাদেশের কৃষক ডিপ ও শ্যালো যন্ত্রে পানি উত্তোলন করতে থাকে। গভীর ও অগভীর কোন টিউবওয়েলই দূরত্বের নিয়ম মেনে বসানো হয় না। ফলে দিনে দিনে পাতালের পানি নামতে থাকে। যে বৃষ্টিপাত হয় তাতে পাতালের পানি ঠিকমতো রিচার্জ হয় না। দেশে বর্তমানে অন্তত ৬৫ লাখ গভীর, অগভীর ও অন্যান্য নলকূপ ব্যবহার হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে পাতালের পানির স্তর নেমে গেলে অন্তত ১০ লাখ নলকূপ অকেজো থাকে। এ অবস্থায় নলকূপের পানি উত্তোলনের জন্য শ্যালো ইঞ্জিন মাটি খুঁড়ে অনেকটা নিচে বসাতে হয়। সত্তরের দশকের মধ্যেভাগে গভীর নলকূপের পানি পাতালে ৫০ ফুট (প্রায় ১৭ মিটার) নিচে মিলত। বর্তমানে গভীর নলকূপে পানি পেতে ড্রিলিং করে এলাকা ভেদে দেড় শ’ থেকে আড়াই শ’ ফুট (৫০ থেকে ৮৫ মিটার) নিচে যেতে হয়। অগভীর নলকূপ বা শ্যালো ইঞ্জিনের সেচে পানি মেলে ৩৫ থেকে ৪৫ ফুট (১২ থেকে ১৫ মিটার) নিচে। মৌসুমী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পানির যে রিচার্জ হচ্ছে তা পাতালের পানি উত্তোলনের চেয়ে কম।
×