ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাজমুল হক

খাদ্যে ভেজাল ॥ প্রয়োজন ভেজালবিরোধী ঐক্য

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

খাদ্যে ভেজাল ॥ প্রয়োজন ভেজালবিরোধী ঐক্য

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবন ধারণের জন্য খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। বলা হয়ে থাকে স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের দরকার বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনে সহায়ক যা সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে কিন্তু আমরা যেসব খাবার গ্রহণ করছি- তা কি আসলেই নিরাপদ? নাকি তার অধিকাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভেজাল? নিরাপদ খাদ্য ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না এটা যেমন সত্যি, অনুরূপ একটি সত্যি কথা হলো ভেজাল খাদ্য আমাদের বেশিদিন টিকে থাকতে দেবে না। পূর্বে যে পরিমাণ খাদ্যে ভেজাল ছিল এখন তা মহামারী আকার ধারণ করছে। দেশে এমন কোন খাদ্য দ্রব্য নেই যেখানে ভেজালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজধানী ঢাকাসহ জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়ে সবাইকে ফাঁকি দিয়েই ভেজাল দ্রব্যের রমরমা ব্যবসা চলছে। যার দরুন ভেজাল এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নকল জিনিসের ভিড়ে আসল জিনিস চেনাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দেশে খাদ্যদ্রব্যে যে পরিমাণ ভেজাল মেশানো হচ্ছে তাতে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে যে, পরবর্তী কয়েক বছর পর কোন খাদ্যই ভেজালমুক্ত থাকবে না। বর্তমানে দিন দিন বাজার ব্যবস্থায় ভেজালের উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় ক্রমান্বয়ে আসল জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ এবং রাজনৈতিক বিবেচনা নির্ভর এদেশে আইনের শাসনের সঠিক ও সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকায় এক শ্রেণীর অসাধু ও অর্থলোভী ব্যবসায়ী অধিক লাভের আশায় জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের মাছে-ভাতে বাঙালী বলা হয়। অন্যকিছু খেলেও একমুঠো ভাতই যেন তৃপ্তির খোরাক যোগায়। কিন্তু সেই চালে লুকিয়ে আছে ভেজালের ছাপ। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, চাল স্বচ্ছ ও ঝকঝকে করতে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক। ব্রি- ২৮, ২৯, ৩৯ ও ৫০ জাতের ধানের খোসা ছাড়িয়ে তাতে ডিটারজেন্ট বা উচ্চমাত্রার ক্ষার মিশিয়ে নরম করার পর ছোট করে ফেলে এরপর তাতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করে সাদাতে পরিণত করে বাজারে মিনিকেট বলে উচ্চ দামে বিক্রির এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে শাকসবজিতে মেশানো হচ্ছে রাসায়নিক কীটনাশক। মাছে ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল ব্যবহার করে মাছকে বানাচ্ছে বিষ। বর্তমানে দেশে গরু মোটাতাজাকরণের নামে ক্ষতিকর পদার্থ খাওয়ানো হচ্ছে এদিক থেকেও আমরা নিরাপদ কোথায়? অধিক মুনাফা লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা মুরগির খাবারে টেনারির বর্জ্য, ভয়ঙ্কর বিষাক্ত রাসায়নিকযুক্ত চামড়ার ভুষি ব্যবহার করছে। মুরগির মাংস ও ডিম বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। আমরা জানি, ফলই বল। কিন্তু কতটুকু বল যোগাচ্ছে তা এবার জানা যাক। ফলগুলোতে সুরক্ষার জন্য নিয়মিত মেশানো হচ্ছে কার্বাইট। কাঁচা আম থেকে শুরু করে কোন ফলই যেন রেহাই পাচ্ছে না বিষাক্ত রাসায়নিক থেকে। আর তরমুজের ভেতরে সিরিঞ্জ দিয়ে প্রবেশ করানো হচ্ছে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট যার ফলে তরমুজের ভেতরের অংশ লাল টকটকে হয়। অন্যদিকে কলা পাকানো হচ্ছে ইথিলিন দিয়ে। এভাবে প্রত্যেকটি ফলেই কমবেশি ভেজাল বিদ্যমান। বেকারির পণ্য তৈরি করা হচ্ছে সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। ব্রেড, বিস্কুট, কেকসহ নানা লোভনীয় জিনিস তৈরিতে ব্যয় কমানোর জন্য আটা, ময়দা, ডালডা, তেল, পচা ডিমসহ নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে ওষুধ রফতানিতে সুনাম অর্জন করেছে। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নকল ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে। যে ওষুধ সেবন করলে রোগ নিরাময় হওয়ার কথা সেই ওষুধই কেড়ে নিচ্ছে লাখো মানুষের জীবন। তাহলে এই নীরব হত্যার দায় কে নেবে। সয়াবিনে মেশানো হচ্ছে ফলিক এসিড, ময়দাতে চক পাউডার এবং বিস্কুট, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিংকস, জুস, সেমাই, আচার, নুডলস ও মিষ্টিতে টেক্সটাইল রং মেশানো হচ্ছে। অপরদিকে পানিতে ক্যাডমিয়াম, গুঁড়া মসলাতে ভুষি, কাঠের গুঁড়া, বালু বা ইটের গুঁড়া ও বিষাক্ত রং মিশিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। ফাস্টফুড ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নিরাপদ খাদ্য ও সুষ্ঠু পরিবেশের কারণে রেস্টুরেন্টমুখী হচ্ছে সবাই। জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, আইসক্রিম, চিকেনফ্রাই, প্যাটিস, পাস্তা এবং কোমল পানীয়। এসব খাবার লোভনীয় ও মজাদার করতে মিশানো হচ্ছে উচ্চমাত্রার চর্বি উপাদান, ক্ষতিকর টেস্টিং সল্ট, মেয়নিজ বা চিজ। এতে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এরই মধ্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকার কারণে বিএসটিআই এনার্জি ড্রিংকস ও জুস কোম্পানিগুলোকে অনুমোদন দেয়নি। তবুও তারা তা উপেক্ষা করে পণ্য বাজারজাত করছে। প্রক্রিয়াজাত খাবারে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল, ফরমালিন, কার্বাইট, খাওয়ার অনুপযুক্ত টেক্সটাইল কালারগুলো ব্যবহারে শিশুসহ সবার স্বাস্থ্য আজ হুমকির মুখে। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে যে উপসর্গগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো-পেটব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথা ঘোরা, মল পাতলা বা হজম বিঘ্নিত মল, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া, দুর্বল হয়ে যাওয়া, পালস রেট কম বা বেশি হওয়া, ক্ষুধা মন্দা, কিডনির সমস্যা, এ্যাজমা, লিভার ফাংশনে আক্রান্ত হওয়া, এ্যালার্জি, চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেনস্ট্রোক, হার্টএটাক ও ক্যান্সার ইত্যাদি। সরকার জনগোষ্ঠীর খাদ্য-স্বাস্থ্য উন্নয়ন তথা খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ২০০ ধরনের মারাত্মক রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ রহিত করে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করেছেন। এছাড়াও ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ-২০০৯, পয়জনস এ্যাক্ট-১৯১৯, ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯ ও নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ ইত্যাদি আইন রয়েছে। অন্যদিকে ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্য অধিদফতর ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গঠন করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই আইন যথেষ্ট হয়নি। বিএসটিআইয়ের উন্নতমানের কোন পরীক্ষাগার নেই। উন্নতমানের যন্ত্রপাতি না থাকার কারণে খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল চিহ্নিত করতে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হন। অন্যদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ভেজালবিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সফল হচ্ছে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। তাই বিএসটিআইএ আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ উন্নতমানের পরীক্ষাগার নির্মাণ করতে এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরকে যথেষ্ট আইন প্রয়োগ করে ভেজালকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিএসটিআইকে এ ব্যাপারে নিতে হবে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা। দেশের প্রত্যেকটি কারখানা থেকে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের সময় বিএসটিআইকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাজারে ছাড়ার অনুমতি দিতে হবে। সর্বোপরি ভেজাল প্রতিরোধ করতে হলে শুধু সরকারের উপর নির্ভর করে না থেকে আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ থাকবে শহর থেকে শুরু করে দেশের মফস্বল অঞ্চলের মানুষদের খাদ্যে ভেজাল বিষয়ে সবাইকে অবহিত করুন। এতে করে সবাই সচেতন হতে পারবে এবং ভেজালবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে। আমি মনে করি, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে অন্তরায় হলো ভেজাল তাই আসুন সবাই মিলে ভেজালবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলি। আর সম্মিলিত কণ্ঠে বলি ‘ভেজালমুক্ত দেশই হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ।’ লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×