ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অনুপমা চক্রবর্তী

অভিমত ॥ কেমন করে পত্র লিখিরে...

প্রকাশিত: ০৩:২৫, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

অভিমত ॥ কেমন করে পত্র লিখিরে...

মানুষের আচরণ, ভাষা, পোশাক-আশাক সবকিছুই যেন এক লক্ষ্যহীন গন্তব্যের আড়ালে ভেসে চলেছে। ভাবনার সময়টুকুও যার অন্তে মিলে না। শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে সদা প্রস্তুত এ জাগতিক মন। মানবমনের এই অনুভূতিগুলোই মূল্যহীন সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশে সহজ সরল কিছু বিষয়ে নীরবতায় হার মানিয়ে দিচ্ছে জীবনের সুখ-আনন্দের ছোটখাটো খুঁনসুটিগুলোকে। এক্ষেত্রে নিকট অতীত যোগাযোগের একটি ঐতিহাসিক মাধ্যম ‘চিঠি’ লেখালেখির কথা মনে পড়ে যায়। এ জীবনে একটিও চিঠি লিখেননি এমন অস্থিমজ্জার নর-নারী খুব কম আছেন। তন্মধ্যে প্রেমের চিঠি বাদ দিয়ে বাঙালীর প্রেমের ইতিহাস একেবারেই যেখানে বেমানান। একটি খাম কেনার আয়োজন থেকে শুরু করে নীল-হলুদ রঙের কাগজ, হাতের লেখা, কলমের কালি, প্রিয় মানুষের হাতের ছোঁয়ার একান্ত সৌরভ সব মিলিয়ে যে অফুরন্ত আন্তরিকতা, অকৃত্রিমতা, স্বতঃস্ফূর্ততা ও প্রাণময়তার প্রকাশ তার প্রামাণ্য দলিলই যেন এই চিঠি। তাইতো চিঠি অনেক সময় গদ্য সাহিত্যের পদবাচ্যকেও হার মানিয়ে দিয়েছে, রেখে গেছে ভবিষ্যতের কাছে এক অবিস্মরণীয় আত্মজীবনী; যা যুগে যুগে হয়েছে সৃষ্টিশীলতা বিকাশের পাশাপাশি শান্তিকামী মানুষের পথ নির্দেশক। আবার ব্যাকরণের একটি প্রধান অংশ চিঠিপত্র অধ্যায়েও বিশেষ অলঙ্কারে বিভূষিত যেখানে অভিধানের কাটখোট্টা শব্দগুলো পেয়েছে নিঃসঙ্গ হৃদয়ের বিরহকাতর অনুভূতিতে স্নিগ্ধ কোমল রূপ। তাইতো একদিকে কবিগুরুর শেষের কবিতা- ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও’ প্রেমের চিঠি আবেদনকে করেছে কালজয়ী, অন্যদিকে অনিমেষ মাধবীলতার চিঠি তারুণ্যের দ্রোহ প্রেমের চিরসঙ্গরূপে মোহাচ্ছনভাব। চিঠি কালের সাক্ষী; যার মূল্য অপরিশোধযোগ্য। অ-মূল্যে পাওয়া গেলেও সে যেন অমূল্যই। দিনের আধুনিকায়নে সময় বাঁচাতে চিঠি হয়তো লেখা হ্রাস পেয়েছে তবে একথা অনস্বীকার্য যে, যাকে চোখ দিয়ে না দেখেও দেখা যায়, নাক দিয়ে গন্ধ নেয়া যায়, হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়, প্রিয় মানুষটির হাতের ছোঁয়া পাওয়া যায় এবং প্রায় সবকটি ইন্দ্রীয় দিয়ে সুখ অনুভব করা যায় তার তুলনা কখনোই এসএমএস, ই-মেইল, টুইটার কিংবা হোয়াটস এ্যাপে হতে পারে না। আর তাই হয়তো চিঠি পাঠিয়ে আবেগতাড়িত চিঠির প্রতীক্ষায় থাকেননি এমন মানুষ পাওয়া সত্যিই নজিরবিহীন। যেখানে প্রত্যাশিত হৃদয়ের বহুল স্বপ্নের ক্লান্তিহীন শিহরণের হাজারো বুনন খেলে যায়। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে আধুনিক প্রযুক্তির উত্থানে চিঠির পরিবর্তে ই-মেইল এবং বিভিন্ন মোবাইল এ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বার্তা অপরের কাছে প্রেরণের ধারণাকে পুঁজি করে আধুনিকতায় আনা হয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যেখানে অনলাইনভিত্তিক এসব মাধ্যমগুলোর ব্যাপক প্রসারে আমরা প্রতিনিয়ত চিরকুট, ইন্টারনেটে বার্তা বা মেসেজ কিছু না কিছু অনবরত লিখে যাই তবে সেখানে মনের সংযোগ নেই বলেই চলে। উল্লেখ্য, যোগাযোগের স্বার্থেই একসময় এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য চিঠির সূত্রপাত হয়েছিল। বহু বছর পর আনুষ্ঠানিকতা পেলেও প্রথম লিখিত চিঠির ইতিহাস পাওয়া যায় ফারাও সাম্রাজ্যের প্রাচীন মিসরে। তখন ফারাও রাজারা দূত মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করতেন, যার প্রমাণ দলিল মিসরীয় অনেক নথি। তবে নজির আছে মধ্যযুগে পায়রার পায়ে বেঁধেও চিঠি প্রেরণ করা হতো। পদ্ধতিটি সময়সাপেক্ষ ও ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় পরবর্তীতে বিবর্তনের পথ ধরে এই ডাক বিভাগের উৎপত্তি। ‘রয়েল মেইল’ নামে যা প্রথম চালু ১৫১৬ সালে ব্রিটিশ রাজা হেনরি অষ্টম এর রাজত্বকালে। এরপর ভালো সার্ভিসের জন্য ‘মাস্টার অব পোস্ট’ পদটির সূচনা হলেও ১৭১০ সালে সেটি পরিবর্তিত হয়ে আবার ‘পোস্ট মাস্টার জেনারেল’ নামে অলংকৃত হয়। এরই ক্রমবর্ধমান ধারায় ১৮৩৯ সালে পোস্ট মাস্টারদের ইউনিফর্ম এবং ১৮৫২ সালে পিলার পোস্টবক্স ও পোস্টবক্সের উৎপত্তি। যেগুলো দৃশ্যমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাড়ির দেয়ালে এবং রাস্তার পাশে অলিগলিতে। এছাড়াও সুদূর অতীতে প্রাচীন এই সভ্যতা নিয়ে চায়না, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, লন্ডন, ইউক্রেন, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গড়েছে ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস। সবচেয়ে গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করেছে উন্নত দেশগুলো, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া সর্বস্তরে স্বীকৃত তবুও বর্তমান শীর্ষস্থানীয় মর্যাদায় একইভাবে এই প্রাচীন ঐতিহ্যের স্থিরচিত্র। আর তাইতো আমেরিকার মতো প্রযুক্তিনির্ভর দেশ পোস্টাল সার্ভিসকে সমাদৃত করেছে বিভিন্ন দেশের ১৫১ লাখেরও বেশি ঠিকানায় যেখানে আড়াই লক্ষাধিক চিঠির আদান-প্রদান হয়। শুধু তাই নয়, জাপানের পোস্ট অফিস বিশ্ব অর্থনীতি সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। কোরিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, কানাডিয়ান ও জার্মানি পোস্ট অফিস দেশের অর্থনীতিতে বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করে চলেছে। গ্রাহকদের ব্যাংকিং সেবা, উপহার সামগ্রী, বিভিন্ন উৎসবের শুভেচ্ছা কার্ড থেকে ব্যক্তিগত সব ধরনের চিঠি-নথিসহ প্রয়োজনীয় পার্সেল আদান-প্রদান করার মাধ্যমে এই পোস্ট অফিসগুলো তাদের মূল ঐতিহ্যকে শুধু ধরে রাখেনি, বরং ইতিহাসের দ্বার উন্মোচন করে সভ্যতার ধারক ও বাহক রূপে নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতি উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে বিভিন্ন কারণে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মুখথুবড়ে পড়ছে আমাদের ডাকবিভাগ। যার সূচনা ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্ত এলাকায় ৫০টি মাঠ পর্যায়ের ডাকঘর চালুর মাধ্যমে। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন সংস্থার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলে প্রতিবছর ৯ অক্টোবর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও দিবসটি পালিত হয়। উল্লেখ্য, চিঠির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ডাকটিকিটের প্রবর্তন হয় ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই। এ সময় মুজিবনগর সচিবালয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন এবং লন্ডনের ‘হাউস অব কমন্স’ এ একযোগে বিশেষ ধরনের আটটি ডাকটিকিট চালু হয় যা বিশ্বব্যাপী দেশের সুনির্দিষ্ট পরিচিতি প্রদান করে থাকে। প্রসঙ্গত, গল্পগাথা হলেও আমাদের চিরবাস্তব অতীত, একসময়ের গ্রামবাংলার সবুজ পথ প্রান্তরে সুকান্তের রানার মুখর পদচারণার ধ্বনি। যেখানে লম্বা একটি লাঠির মাথায় হারিকেন আর ঘণ্টা বেঁধে ছুটে চলা রানার এখন কল্পকথা মাত্র। শুধু রয়ে গেছে জনসেবার জন্য স্থাপিত সেই ডাকঘরগুলো। যা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে অযতেœ নষ্ট হচ্ছে, মরিচা ধরেছে ডাকবাক্সের তালাগুলোতে, এমনকি রাস্তার পাশের পোস্টবক্সগুলো যেন এক সুসজ্জিত আবর্জনার ধ্বংসস্তূপ। দৃষ্টির আড়ালে থাকলেও এখন বেশ সুস্পষ্টই যে, জেলা এবং উপজেলা ডাকঘর ব্যতীত অন্য সবকটিতে বেশ নাজুক অবস্থা। এতে করে চিঠি লিখতে চাইলেও পোস্ট কোথায় করবে তা নিয়ে পড়ছে মানুষ নানা দ্বিধায়। এভাবেই যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে ব্যর্থ হয়ে সেবা দীনতায় গত দেড় দশকে ডাক বিভাগে চিঠি বিলির সংখ্যা কমেছে ২০ কোটিরও বেশি। যেখানে সরকারকে গুনতে হচ্ছে প্রতিবছরই গড়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকার লোকসান। এমতাবস্থায়, প্রাচীন এই ঐতিহ্য যখন বিলুপ্তির পথে, তখন অনেকেই পরম মমতায় আগলে রেখেছেন প্রিয়জনের পুরনো প্রিয় চিঠি। তাদের মতে, ‘শুধু আবেগ, অনুভূতি আর ভালবাসা নয়; চিঠির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সভ্য সমাজ বিনির্মাণের অনেক ইতিহাসও।’ যার ইতিহাস মেলে প্রখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে লেখা চিঠি নিয়ে রচিত গ্রন্থ ‘আনআর্নড ভিক্টরি’, দশ বছরের মেয়ে ইন্দিরার কাছে লেখা বাবা জওহর লাল নেহরুর চিঠি নিয়ে প্রকাশিত ২টি গ্রন্থ ‘লেটার ফ্রম এ ফাদার টু হিজ ডটার’ ও ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টরি’ এবং রবি ঠাকুরের চিঠিপত্র প্রবন্ধসহ আরও নানা বিস্ময়কর লেখনি যেখানে মানুষের জীবন, প্রকৃতি, রাজনীতি ও সমাজনীতি উঠে এসেছে সোজাসাপটা ভাষায়। এভাবেই ব্যক্তিগত চিঠিও কখনও কখনও পরবর্তীকালের জন্য হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যম। অনস্বীকার্য যে, দ্রুত যোগাযোগের জন্য প্রযুক্তির তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কিন্তু চিঠির রয়েছে যে স্থায়িত্ব তাতে মনের আঙ্গিকের নানা বিচিত্রতা উঠে আসে; যা সত্যিই তুলনাহীন। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যক্তিত্ব বিল গেটস ও স্টিভ জবসের সম্পর্কের একটি স্মরণীয় স্মৃতি দৃষ্টান্তস্বরূপ চলে আসে। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস একবার মাইক্রোসফট থেকে সরে এসে তার গেটস ফাউন্ডেশনের কাজে মনোনিবেশ করলে সম্পর্কের উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায় নিকটতম ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী স্টিভ জবসের সঙ্গে। এসময় গেটস আপেলের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে স্টিভ জবসের অবদানকে প্রশংসিত করার পাশাপাশি তার পরিবার এবং বাচ্চাদের প্রতি শুভ কামনা প্রকাশ করে একটি চিঠি দেন। পরবর্তীতে জবসের মৃত্যুর পর স্ত্রী লরেন বেদনা ভারাক্রান্ত স্বরে গেটসকে জানান, গেটসের লেখা সেই চিঠিটি প্রায় পড়তেন জবস, এমনকি যতœ সহকারে শেষদিন পর্যন্ত সেটির স্থান হয়েছিল তার বিছানার পাশে। সুতরাং দেখা যায় যে, প্রযুক্তি যাদের হাতে সৃষ্টি তারাও কিন্তু চিঠির অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। তাই প্রযুক্তিকে দোষারোপ করে নয় বরং ব্যক্তি অভ্যাসের পরিবর্তন আনয়ন করাটা খুব জরুরী আমাদের। এছাড়া অতীতের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রযুক্তি ও আধুনিকতার মিশেলে পোস্ট অফিসগুলোর নবনির্মাণও অত্যাবশ্যক। তবেই আশাজনকভাবে চিঠি তার ইতিহাসের ১০০ বছর আগের স্মৃতির দেখা পাবে আর আমরা পাব বিশ্ব দরবারে নিজস্ব সংস্কৃৃতির পূর্ণ বিকাশ। লেখক : গবেষক
×