ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

‘জীবন মানুষের সবচাইতে প্রিয়!’

প্রকাশিত: ০৩:২৫, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

‘জীবন মানুষের সবচাইতে প্রিয়!’

রুশ লেখক নিকোলাই আলেক্সিভিচ অস্ত্রয়ভস্কি (যিনি ‘নিকোলাই অস্ত্রয়ভস্কি’ নামে সমধিক পরিচিত) ১৯৩০ সালে একটি উপন্যাস লিখেন, যা পরবর্তী সময়ে বাংলায় অনূদিত হয়েছে ‘ইস্পাত’ নামে। সে উপন্যাসে তিনি উল্লেখ করেছিলেন এক অপূর্ব মর্মকথা- ‘জীবন মানুষের সবচাইতে প্রিয়। এই জীবন সে পায় মাত্র একবার বাঁচবার জন্য। এমনভাবে বাঁচতে হবে তাকে যাতে বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবন যাপন করার জন্য পরে যন্ত্রণাভরা অনুশোচনায় ভুগতে না হয়। যাতে বিগত জীবনের গ্লানিভরা হীনতার জন্য লজ্জার দগ্ধানি তাকে সইতে না হয়। এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর মুহূর্তে সে যেন বলতে পারে : আমার সমস্ত জীবন, সমস্ত শক্তি আমি ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্য- মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামের আদর্শ।’ এখনও এই বক্তব্য দুনিয়ার অনেক দেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের জন্য তো বটেই। সামনের দিনে এদেশের মানুষ যে মানবিক আদর্শের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে তা শত সহস্র বছরে অর্জিত মানবতা চিন্তার ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা। বঙ্গবন্ধুর জীবন লক্ষ্যহীন আদর্শের ছিল না। তাঁর নিজের লেখা জীবনচরিত পড়লেই বুঝা যায় তিনি একটি লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছিলেন- যা ছিল স্বপ্নে মোড়ানো অবিশ্বাস্য এক মানবিক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। সেই সোনার বাংলার মূল উপজীব্য ছিল এদেশের মানুষের মুক্তি। পরাধীনতার অপসংস্কৃতির অপশাসন ও শোষণ থেকে মুক্তির পর তিনি স্বপ্নজাল বুনেছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তির। যার ভার পড়েছে এখন তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপরে। মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে এখন বঙ্গবন্ধু কন্যা জাতিকে এমন এক বাস্তবতায় ফিরিয়ে এনেছেন যখন বাঙালী জাতিকে ভাবতে হচ্ছে নিজের করে দেশটাকে সাজিয়ে নেবার নতুন স্বপ্ন চিন্তার। বাংলাদেশের সৃজনশীল কর্মক্ষম তরুণ সমাজ এখন ভাবছে নতুন যে মানবিক বাংলাদেশ আমরা গড়তে যাচ্ছি সেখানে আমাদের করণীয় কি? সে জেনেছে ১৯৭১ সালের একই বয়সে তাঁর পিতা, পিতামহ বা ভাই-বোনেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাঁর আগে মুক্তি সংগ্রামে আন্দোলিত হয়েছে ও ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৪৭ বছর। সেই অকুতোভয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধার বয়স এখন ষাটের কোঠা ছাড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সংগঠিত এই বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব পালন করেছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের তরুণরাই। স্বাধীন দেশের দুঃখজনক অধ্যায়ের প্রতিবাদও করেছে এই প্রজন্মই। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় প্রজন্মের ওপর এখন দায়িত্ব পড়েছে তাই সব দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণের। সব ধর্মে একটি সরল মর্মবাণী রয়েছে যা হলো সৃষ্টিকর্তা মানুষের কোন জাত-ধর্ম বিচার করেন না, তিনি বিচার করেন মানুষের কর্ম। যদি তাই-ই হয় তাহলে মানুষের কর্ম কি? খুব স্বাভাবিক উত্তর, অন্যের হিত সাধন। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের মানুষ নিঃস্বার্থ হিতার্থে এত পরিমাণ জীবন দিয়েছে যেÑ এমন দৃষ্টান্ত অতুলনীয়। আমার ধারণা এটাই এদেশের মানুষের প্রধান কর্ম। কৌম সমাজ রাজতন্ত্রে মিলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত নিঃস্বার্থ হিতবাদী সমাজই বাংলায় বিদ্যমান ছিল। রাজন্যের স্বার্থ মূলত আমাদের সামন্ত করেছে কিন্তু সমাজের নিম্নস্তরের যারা প্রকৃত মানুষ তারা সে সবের বাধা হয়েই ছিল। যে কারণে সকল বিদ্রোহ হয়েছে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের প্রত্যয়ে। এর প্রধান কারণ বঞ্চনা। নিজেদের সংস্কৃতি আর সমাজের মালিকানা হাতছাড়া হয়ে যখন উপরের শ্রেণীর হাতে গেল, উপনিবেশও এসে গেড়ে বসল, তখন নানারকম বঞ্চনা আর দুঃখের জন্ম নিল- যার চূড়ান্ত পরিণতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, কারণ নিজেদের একটা স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। বঞ্চনামুক্ত সে স্বাধীনতার নেতৃত্ব তাই লক্ষ্য স্থির করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা বঙ্গবন্ধুর জন্য অনিবার্য ছিল। এখন বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়েছে তার উন্নতির প্রধান নেতৃত্বশক্তি যদি হন শেখ হাসিনা, তাঁর লক্ষ্য এগিয়ে নেবার দায়িত্ব তরুণ সমাজের। এখানে আদর্শহীন কূপম-ূকতার কোন স্থান নেই। শেখ হাসিনা তাঁর সকল নির্দেশনায় বাংলাদেশকে এমন এক ইতিবাচক বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দিয়েছেন সেখান থেকে ফিরে যাবার কোন উপায় নেই। ফলে তরুণ সমাজের হাতে এখন ইতিহাস, সত্য আর বাংলার লৌকিক সংস্কৃতির চাবি- যা হাতে নিয়ে তাকে খুলতে হবে স্বজাতির মুক্ত সমাজের বদ্ধ অর্গল। তরুণ সমাজ জানে উন্নয়ন মানে বড়লোক হওয়া নয় যে, আমার কাড়ি কাড়ি টাকা থাকবে, গাড়ি-বাড়ি আর সুরম্য দালান হবে আর আমি সমাজে হর্তাকর্তা হয়ে থাকব। জ্ঞান সমাজে টাকার মূল্য খুবই সামান্য। এই সাধারণ সত্য জেনে নিয়ে শেখ হাসিনার পরের কাজগুলো এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ প্রস্তুত। আমাদের খোঁজ নিতে হবে কে তিনবেলা ঠিকমতো খেয়েছে, কে খায়নি, কী তার বাধা? সে বাধা দূর করতে আমাদের করণীয় কি? কোথায় কোন বাড়িতে আমার বোন মনের কষ্ট লুকিয়ে চোখের জলে নিরুপায় দিন কাটায় সে খোঁজ মানবিক বাংলাদেশের কাজ। কোন মা কেঁদে ভাসিয়ে তার সন্তানের মঙ্গল কামনায় নীরবে ঘরের কোণে নিঃসঙ্গ প্রার্থনায় রত। দেখতে হবে সেই অমঙ্গলের ছোঁয়া থেকে তার সন্তানের জন্য আমাদের কিছু করণীয় আছে কী-না। কৃষকের ফসল আর তার সুবাস বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে কিনা, ঋণের ভারে জর্জরিত গ্রাম সমাজকে কেমন করে নব্য ফড়িয়াদের কাছ থেকে বের করে আনা যায়, মানুষ নিরাপদ কিনা, মানুষের অন্তর্গত জীবন নিরাপদ কিনা, কে তাকে সামনে যেতে বাধা দেয় তার প্রতিকার খুঁজে বের করা– এসব দায়িত্বই শেখ হাসিনা তুলে দিয়েছেন এ কালের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। আর সে লক্ষ্যে আগাতে হবে, তা হলেই বলা সম্ভব হবে, ‘আমার সমস্ত জীবন, সমস্ত শক্তি আমি ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্য।’ আমাদের মনে থাকতে হবে ‘মুক্তির সংগ্রাম’ কিন্তু পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যায়নি। এই সংগ্রাম নিয়ত বহমান আর বাংলাদেশের মানুষ সে সংগ্রামে নিরন্তর নিয়োজিত। আমাদের এও মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন মানে এক অবস্থান থেকে আর এক অবস্থানে রূপান্তর- আর সেটাও এক মুক্তি সংগ্রাম। আর বিবেচনা করতে হবে, এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় বা এই সংগ্রামে আমার ভূমিকা কি ছিল আর মানুষের কল্যাণে তা কতখানি কার্যকর হয়েছে? এই দুর্ভাগা দেশের নিয়তি হলো সে আমল থেকে এখন পর্যন্ত বর্গীরা এসে সব লুট করে নেয়। আদর্শ সমাজে লুটেরাদের কোন স্থান নেই। বাংলাদেশের তরুণরা সে আদর্শ ধারণ করে আছে যাতে সে সেখানে প্রতিরোধ তৈরি করে দিতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে এখন বৈষম্য দূরের শিক্ষা, দীক্ষা ও প্রতিশ্রুতি আছে। শুধু রাজনৈতিক অনুচিন্তায় নয়, মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা বা লিঙ্গ বৈষম্য, পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা, শ্রম বিভাজন ও প্রথা- সব মিলিয়ে তরুণদের সচেতন সংস্কারকের ভূমিকা দেখলে এই চিন্তা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের তরুণ সমাজ একটি নতুন সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকারে শেখ হাসিনার মানবিক সমাজ দর্শনে অনুপ্রাণিত, শুধু একে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে চালিত করাই প্রধান কাজ। মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনচক্রে তার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ দেশপ্রেম ও তার পরিচয়। আর তাই তার নিজের জীবনই হয়ে উঠে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। সে জীবনকে যদি সে একটি মাত্র আদর্শে নিয়োজিত করতে পারে তাহলে মুক্তির সংগ্রামে সে জয়ী হতে বাধ্য। ইতিহাসও তা-ই বলে, বাঙালী কখনই কোন যুদ্ধে হারেনি। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×