ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ছায়ানটের আন্তর্জাতিক মর্যাদা

প্রকাশিত: ০৩:২৩, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

ছায়ানটের আন্তর্জাতিক মর্যাদা

ভারতের মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক টেগোর এ্যাওয়ার্ড ফর কালচারাল হারমোনি পেলো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। এটি দেশের জন্য মর্যাদাকর সুসংবাদ। কবিগুরুর সার্ধশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চালু এই আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মূল্যমান এক কোটি ভারতীয় রুপী। সেই সঙ্গে একটি মানপত্র এবং সূক্ষ্ম ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প স্মারক প্রদান করা হবে। একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন সাহস, সৃষ্টিশীলতা ও অঙ্গীকার পালনের ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে কিভাবে জাতির জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত ছায়ানট। প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত ও সাহিত্যচর্চায় ব্রতী থাকলেও কালে কালে সংগঠনটি হয়ে ওঠে বাঙালিত্বের চেতনা ও স্বপ্ন লালনকারী এক উজ্জীবনী অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। দেশে বাংলা নববর্ষ বরণে নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রমনার বটমূলে ছায়ানটের আকর্ষণীয় আয়োজন এখন ঐতিহ্যে পরিণত। গত বছর তার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলো। এটি ছিল আমাদের জন্য এক আশাজাগানিয়া গৌরবের মাহেন্দ্রক্ষণ। পঞ্চাশ পূর্তির আয়োজনটিও হয়েছিল বিশেষ বর্ণচ্ছটায় রঙিন। বহমান সংস্কৃতির ¯্রােতধারায় সংগঠন হলো প্রাণবন্ত-গতিময় সাম্পানের মতো, যার পালে নব নব হাওয়ার পরশ লাগানোর জন্য চাই তার নবায়ন ও নবজাগরণ। ছায়ানট সে সম্পর্কে সচেতন বলেই কালে কালে এটি হয়ে উঠেছে জাতির সাংস্কৃতিক বাতিঘর। নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি ড. সনজীদা খাতুনের জাতির অভিভাবকসুলভ দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য আমাদের জন্য এক পরম প্রাপ্তি। সংস্কৃতিচর্চায় দেশীয় ঐতিহ্য ও প্রকৃতিমুখী হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৬১ সালে ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করার ঐকান্তিক ইচ্ছায় পাকিস্তানী শাসনের প্রতিকূল পরিবেশে কিছু বাঙালী একত্র হয়েছিলেন নিজেদের সংস্কৃতির প্রধান ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষপূর্তির উৎসব পালনের জন্য। তমসাচ্ছন্ন পাকিস্তানী যুগে কঠোর সামরিক শাসনে পদানত স্বদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে ছায়ানট যাত্রা শুরু করে। চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, বিজ্ঞানী, সমাজব্রতী নানা ক্ষেত্রের মানুষের সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ হয়ে ওঠে ছায়ানট। স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় ব্যাপ্তি ও গভীরতা সাধনে ছায়ানট পালন করে বিশিষ্ট ভূমিকা। সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক বিকৃতি ও সংস্কৃতিহীনতা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ছায়ানট বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে চলেছে। রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নৃশংস আঘাত হানার বিষয়টি বাঙালী স্মরণে রাখবে চিরকাল। ওই অপশক্তি যথার্থভাবেই সংস্কৃতির প্রাণভোমরা তথা প্রগতিবাদী মহাশক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিল বলে তারা তাদের মোক্ষম আঘাতটি হেনেছিল বর্ষবরণের ওই আয়োজনে। এখনও সেই অপশক্তি অত্যন্ত সক্রিয়। একাত্তরে পরাজয়ের কষ্ট তাদের কিছুতেই ঘুচছে না। আবার একইসঙ্গে তাদের নেতাদের একে একে ফাঁসির মঞ্চে হারাতে হয়েছে বলে প্রতিশোধ গ্রহণে তারা মরিয়া। এই পরিস্থিতিতে ছায়ানটের মতো হৃদয়সংবেদী বুদ্ধিদীপ্ত সংগঠন আমাদের প্রয়োজন, যার সাংগঠনিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে পড়বে; নতুন দিনের আশাবাদ জাগাবে এবং অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তির জোগান দেবে। সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তিতে ছায়ানটকে জানাই আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন।
×