ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জিম্বাবুইয়ের অসহায় আত্মসমর্পণ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

  জিম্বাবুইয়ের অসহায় আত্মসমর্পণ

মিথুন আশরাফ ॥ এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জেতা হয়ে গেছে। টানা দুই ম্যাচ জিতেই সিরিজ জয় হয়েছে। শুক্রবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে জিতে জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করল বাংলাদেশ। সৌম্য সরকার ও ইমরুল কায়েসের দ্বিতীয় উইকেটে গড়া রেকর্ড জুটিতে ৭ উইকেটে জিতে সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে শেষ করল বাংলাদেশ। ইমরুল ১১৫ ও সৌম্য ১১৭ রান করেন। তাদের জোড়া সেঞ্চুরিতে উড়ে গেল জিম্বাবুইয়ে। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচটিতে টস জিতে আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। তৃতীয় ম্যাচে যখন টস জিতেন মাশরাফি তখন স্বাভাবিকভাবেই ফিল্ডিং নেয়ার চিন্তা হবেই। চট্টগ্রামে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ‘শিশির’ পড়াও শুরু হয়। স্কোর যত দ্রুত থামানো যায় ততই জেতার সম্ভাবনা জাগে। দ্বিতীয় ইনিংসে যারা ব্যাটিং করেন তারাই যে লাভবান হন। বোলাররা যে তখন ঠিকমতো বল গ্রিপে নিতে পারেন না। ঠিকমত বল করতে পারেন না। কিন্তু আগে ব্যাটিং করার সুযোগটি এবার ভালভাবেই কাজে লাগিয়েছে জিম্বাবুইয়ে। শন উইলিয়ামসতো ক্যারিয়ারসেরা অপরাজিত ১২৯ রানের ইনিংস খেলেন। তার এই ইনিংসের সঙ্গে ব্রেন্ডন টেইলরের ৭৫ ও সিকান্দার রাজার ৪০ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ২৮৬ রান করে জিম্বাবুইয়ে বড় স্কোরই গড়ে। বাংলাদেশ বোলাররা এদিন নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। শুরুতে পাঁচ পেসার বল করেন যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবার ঘটে এমন ঘটনা। আবু হায়দার রনি, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, অভিষিক্ত আরিফুল হক, মাশরাফি ও সৌম্য সরকার বোলিং করার পর দুই স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপু, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ বোলিং করেন। কিন্তু বোলাররা দ্যুতি ছড়াতে পারেননি। তবে জিম্বাবুইয়ে যে রানই করেছে তাও বাংলাদেশের কাছে খুব বেশি হয়ে ধরা দেয়নি। সৌম্য ও ইমরুলের জোড়া সেঞ্চুরি ও দ্বিতীয় উইকেটে গড়া ২২০ রানের জুটিতেই ৩ উইকেট হারিয়ে ৪২.১ ওভারে ২৮৮ রান করে জিতে যায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইনিংস শুরু হতেই ধাক্কা মিলে। রানের খাতা খোলার আগেই জার্ভিসের করা প্রথম বলেই লিটন কুমার দাস আউট হয়ে যান। রিভিউ নিয়েও এলবিডাবলিউ থেকে বাঁচতে পারেননি। একটি রিভিউ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এরপর ইমরুল কায়েস ও সৌম্য সরকার মিলে দেখান ঝলক। লিটন প্রথম বলে আউট হওয়াতে যেন ওয়ানডাউনে নামলেও সৌম্যের শুরুটা ওপেনিংয়েই হলো। তাতে তৃতীয় ওয়ানডের দলে ফিরে একাদশে থেকেই ছড়ালেন জৌলুস। জাতীয় ক্রিকেট লীগে (এনসিএল) টানা রানের মধ্যে ছিলেন জাতীয় দলেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। ইমরুলের সঙ্গে ১০০ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। দেখতে দেখতে ১৫০ রানের পর ২০০ রানের জুটিও হয়ে যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটিও গড়া হয়। এর আগে এ বছর জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তামিম-সাকিব মিলে দ্বিতীয় উইকেটে ২০৭ রানের জুটি গড়েছিলেন। যা সর্বোচ্চ রানের জুটি ছিল। এবার ইমরুল-সৌম্য মিলে সেই রেকর্ডকেও পেছনে ফেলে দিলেন। ২২০ রানের জুটি গড়লেন। আর ৫ রান হলে যে কোন উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটির ইতিহাস গড়ার কৃতিত্ব ইমরুল-সৌম্যের হতো। গত বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে সাকিব-মাহমুদুল্লাহ মিলে ২২৪ রানের জুটি গড়েছিলেন, যা এখন পর্যন্ত যে কোন উইকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ জুটি হয়ে আছে। সৌম্যের আউটে তা সম্ভব হলো না। তবে দ্বিতীয় সেরা জুটি ঠিকই হলো। সৌম্যতো ২০১৫ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরির (১২৭*) পর, তিন বছর পর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিও তুলে নিয়েছেন। ৮১ বলেই সেঞ্চুরি করে ফেলেন সৌম্য। তৃতীয় ওয়ানডেতে খেলার সুযোগ পেয়েই তা কাজে লাগান। শেষ পর্যন্ত ৯২ বলে ৯ চার ও ৬ ছক্কায় ১১৭ রান করে মাসাকাদজার বলে আউট হন সৌম্য। তবে স্বস্তি নিয়েই মাঠ ছাড়েন। ইমরুলের সঙ্গে সৌম্যের জুটি ২২০ রান পর্যন্তই যেতে পারে। সৌম্য সুযোগ পেয়ে এবার ভালভাবেই নিজেকে মেলে ধরলেন। ইমরুলতো টানা তিন ওয়ানডেতেই ঝলক দেখালেন। প্রথম ওয়ানডেতে ক্যারিয়ারসেরা ১৪৪ রান করেছেন। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ১০ রানের জন্য সেঞ্চুরি হাতছাড়া করেছেন। তৃতীয় ওয়ানডেতে সেই ভুল হয়নি। ৯৯ বলে ১০০ রান পূরণ করে ফেলেন। এক সিরিজে দুই সেঞ্চুরি করেন ইমরুল। চতুর্থ ওয়ানডে সেঞ্চুরি হয়ে যায় ইমরুলের। দ্বিপক্ষীয় সিরিজ বা টুর্নামেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে একই সিরিজ বা টুর্নামেন্টে দুটি সেঞ্চুরি করেন ইমরুল। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে এবং এ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে দুটি সেঞ্চুরি আছে তামিম ইকবালের। আর ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ দুটি সেঞ্চুরি করেন। এবার ইমরুল এক সিরিজে দুই সেঞ্চুরি করলেন। তবে দ্বিপক্ষীয় কোন সিরিজে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করার কৃতিত্ব গড়েন ইমরুলই। তিনি ৩ ম্যাচে ১১৬.৩৩ গড়ে ৩৪৯ রান করেন। শেষ পর্যন্ত দলের ২৭৪ রানের সময় ১১২ বলে ১০ চার ও ২ ছক্কায় ১১৫ রান করে আউট হন ইমরুল। এর আগে ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে এক ম্যাচে তামিম ও মুশফিক এবং গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ সেঞ্চুরি করেন। এবার ইমরুল ও সৌম্য করলেন। শেষে গিয়ে ২৮ রানে অপরাজিত থাকা মুশফিকুর রহীম ছক্কা হাঁকিয়ে খেলা শেষ করেন। মোহাম্মদ মিঠুনকে (৭*) নিয়ে জয়ের হাসি মুখে জড়িয়ে মাঠ ছাড়েন। টানা দুই ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন ফজলে মাহমুদ রাব্বি। দুই ম্যাচেই রানের খাতা খোলার আগে সাজঘরে ফিরেছেন। তৃতীয় ম্যাচে তাই আর একাদশেই জায়গা হয়নি। রাব্বির পরিবর্তে সুযোগ পান হঠাৎ তৃতীয় ওয়ানডের জন্য ডাক পাওয়া সৌম্য সরকার। সেই সঙ্গে মেহেদী হাসান মিরাজকে বিশ্রামে রেখে আরিফুল হককে অভিষেক করানো হয়। আর মুস্তাফিজুর রহমানকে বিশ্রাম দিয়ে পেসার আবু হায়দার রনিকে খেলানো হয়। শুরুতে রনি ও আরিফুল দুর্দান্ত বোলিং করেন। হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকেতো দাঁড়াতেই দেননি রনি। শুরুতেই আউট করে দেন। সঙ্গে সাইফউদ্দিন ঝুওয়াওকে ফিরিয়ে দিলে ৬ রানেই ২ উইকেট হারিয়ে বসে জিম্বাবুইয়ে। কিন্তু এরপর থেকেই আর সেই ঝলকানি বোলারদের দেখা মেলেনি। টেইলর ও উইলিয়ামসন মিলে দলকে দেখতে দেখতে ১৩৮ রানে নিয়ে যান। দুইজন মিলে ১৩২ রানের জুটিও গড়েন। এই জুটি জিম্বাবুইয়েকে বড় সংগ্রহের আশা জাগায়। দলের ১৩৮ রানের সময় অপুর ঘূর্ণির ফাঁদে পড়ে টেইলর আউট হলেও উইলিয়ামসন ঠিকই উইকেট আঁকড়ে থাকেন। এরপর এক এক করে বড় জুটি হতেই থাকে। চতুর্থ উইকেটে সিকান্দার রাজাকে নিয়ে ৮৪ রানের জুটি গড়েন উইলিয়ামসন। এর মধ্যে ৭৩ বলে ৫০ রানও করে ফেলেন উইলিয়ামসন। দেখতে দেখতে সেঞ্চুরির কাছাকাছিও চলে যান। দলকেও ২০০ রানে নিয়ে যান। যেই দলের রান ২২২ রানে পৌঁছায় অপুর স্পিন জাদুতে সিকান্দারও আউট হন। উইলিয়ামসন-সিকান্দার জুটিরও অবসান ঘটে। পঞ্চম উইকেটে গিয়েও বড় জুটিরই দেখা মেলে। এবার পিটার মুরকে নিয়ে ৬২ রানের জুটি গড়েন উইলিয়ামসন। এর মধ্যে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিও করে ফেলেন উইলিয়ামসন। ১২৪ বলে সেঞ্চুরি করেন। দেখতে দেখতে ক্যারিয়ারসেরা ইনিংসও করে ফেলেন তিনি। দলের ২৮৪ রানের সময় ইনিংস শেষ হওয়ার ৪ বল বাকি থাকতে রানআউট হয়ে যান মুর (২৮)। ততক্ষণে দলের স্কোরবোর্ড ফুলেফেপে যায়। শেষ চার বলে আর ২ রান করতে পারে জিম্বাবুইয়ে। একেকজন ব্যাটসম্যান আসেন উইলিয়ামসনের সঙ্গে বড় জুটি গড়ে ফিরে যান। কিন্তু উইলিয়ামসন ঠিকই উইকেটে পড়ে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ১৪৩ বলে ১০ চার ও ১ ছক্কায় ১২৯ রান করে অপরাজিতও থাকেন উইলিয়ামসন। তার এই অসাধারণ ইনিংসে জিম্বাবুইয়েও জয়ের আশা দেখে। কিন্তু ইমরুল ও সৌম্য মিলে এমনই ব্যাটিং ভেল্কি দেখালেন যে পাত্তাই পেল না জিম্বাবুইয়ে। দুই দলের মধ্যকার সর্বশেষ ২০১৫ সালে দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজ হয়েছিল। সেই তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৪ সালের শেষদিকে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। যে সিরিজটি বাংলাদেশের নতুন পথ তৈরি করে দিয়েছিল। এরপর টানা জয়ের ধারাবাহিকতাতেই থাকে বাংলাদেশ। এবার জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে আবার দুই বছর পর দেশের মাটিতে সিরিজ খেলতে নামে বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ১০টি সিরিজ জেতা হয়ে গেছে আগেই। জিম্বাবুইয়েকে তিনটি সিরিজে আগেই হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে প্রথমবার জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে। এরপর ২০১৪ ও ২০১৫ সালে যথাক্রমে ৫ ও ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। এবার চতুর্থবারের মতো জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। ইমরুল ও সৌম্যের সেঞ্চুরিতে জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ।
×