ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণভবনে আওয়ামী লীগের যৌথসভায় প্রধানমন্ত্রী

অনির্বাচিত সরকারের কথা তুলে তারা দেশ অস্থিতিশীল করতে চায়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

  অনির্বাচিত সরকারের কথা  তুলে তারা দেশ অস্থিতিশীল করতে চায়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনগণ আবারও নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবে এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নিরপেক্ষ ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ দাবির কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধন করে অনির্বাচিত সরকার আসার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে অনির্বাচিত সরকারের দাবি তুলে তারা (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। তারা নির্বাচন চায় কি-না সেটাতেই সন্দেহ রয়েছে। একদিকে নিজেকে (ড.কামাল) সংবিধানের প্রণেতা হিসেবে দাবি করেন, আরেকদিকে সংবিধান লঙ্ঘন করে অনির্বাচিত সরকারের কথা বলছেন কেন? কী উদ্দেশে? একদিকে নির্বাচন চাইবেন, আরেকদিকে অসাংবিধানিক দাবি তুলবেন, এমন আব্দার কেন? শুক্রবার রাতে তার সরকারী বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ এবং সংসদীয় দলের যৌথসভায় সূচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে আগামী নির্বাচনে বিজয়ের বিষয়ে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, ইনশাল্লাহ জয় আমাদের হবেই। কারণ দেশের জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আর আওয়ামী লীগ দেশে যে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা চলছে, নিশ্চয় জনগণই সেটাকে ধরে রাখবে। আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দেবে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলের সর্বোচ্চ ফোরামের এই যৌথসভায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ড. কামালের নাম উল্লেখ না করে তার সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, একদিকে দাবি করবেন সংবিধান রচয়িতা, অপরদিকে আবার সেই সংবিধানকে লঙ্ঘন করার জন্য নির্বাচনের অন্য ফর্মুলা দেবেন। অনির্বাচিত একটা সরকার গঠন করতে বলবেন। সরকারকে পদত্যাগ করতে বলবেন। এই আব্দারটা কেন? কার স্বার্থে, কিসের স্বার্থে? সেটাই আমরা বুঝতে চাই। কি কারণে তারা এটা চাচ্ছে। তাদের যদি এত শক্তি থাকে জনগণের সঙ্গে আসবে, ভোট হবে। ঐক্যফ্রন্টের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশটা যে সুন্দরভাবে চলছে। দেশের মানুষ স্বস্তিতে আছে, এটা তাদের ভাল লাগছে না। তারা চায় একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। দেশটাকে অস্থিতিশীল করতে। সিলেটের জনসভা থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারসহ সাত দফা দাবি মেনে নিতে ড. কামাল হোসেনের আন্দোলনের ডাক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উচ্চ আদালত থেকে রায় দেয়া হয়েছে কোন অনির্বাচিত সরকার থাকতে পারবে না। এই রায়ের প্রেক্ষাপটে সংসদে সংবিধান সংশোধন করে অনির্বাচিত সরকার আসার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের এই রায়ের পরও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীরা কীভাবে বলেন, গণতান্ত্রিক সরকারের বাইরে আরেকটি সরকার গঠন করতে হবে? তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ের পরে আমাদের সংবিধান সংশোধন করেছি। বাহাত্তরের সংবিধান ঠিক যে রকম ছিল, যেভাবে নির্বাচনের জন্য যা যা লেখা ছিল আমরা সেভাবেই নিয়ে এসেছি। ড. কামালের নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একদিকে নিজেকে সংবিধানের প্রণেতা হিসেবে দাবি করেন। আরেকদিকে সংবিধান লঙ্ঘন করে অনির্বাচিত সরকারের কথা বলেনÑ এটা কেন ও কী উদ্দেশে বলছেন, সেটাই আমার প্রশ্ন। তিনি বলেন, আমরা ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দেয়ার কথা বললাম। এই ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত ভোটগ্রহণ ও ফল ঘোষণা করা সম্ভব। কারও ভোট অন্য কেউ দিতে না পারায় ভোট জালিয়াতি কিংবা কারচুপিও করা সম্ভব নয়। এই ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহারে তাদের আপত্তি কোথায়? একদিকে নির্বাচন চাইবেন, আরেকদিকে অসাংবিধানিক দাবি তুলবেন। তার মানে, তারা নির্বাচন চান কি-না সেটিই হচ্ছে বড় কথা। দেশটাকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টাই তারা করছেন। ড. কামাল হোসেনের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এত বড় বড় কথা বলছেন, তিনি কার সঙ্গে ঐক্য করলেন? তিনি এতিমের টাকা চুরির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি, একুশে গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে নেতা মেনে জোট করলেন! তার মুখে দুর্নীতির কথা মানায়? তারা সিলেটে গিয়ে জনসভা করলেন, অথচ আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করলেন, আমরা নাকি বাধা দেই। কোথায় বাধা দিলাম? আমার নির্দেশ ছিল, যারাই সমাবেশ করতে চাইবে কাউকে বাধা দেয়া হবে না। অথচ বাধা দেয়ার অভিযোগ তুললেন। আসলে তারা চায়, আমরা বাধা দেই। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমরা বিরোধী দলে থাকতে কথা বলা তো দূরের কথা, একটা মিটিংও করতে দেয়নি। আমরা কিন্তু সকলের জন্য সভা-সমাবেশ উন্মুক্ত করে দিয়েছি। কাউকে বাধা দিইনি। এখন একটা ঐক্যজোট হয়েছে। তারা মুখে বড় বড় কথা বলে আর দুর্নীতিবাজ সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া এবং সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান তাদের সঙ্গে জোট করেছে। সেই দলসহ বিএনপি-জামায়াত জোটসহ ঐক্য হয়েছে। তারা বলল, আমরা নাকি তাদের মিটিং করতে দিচ্ছি না। সিলেটে তারা মিটিং করল। আগেই তারা বলে, আমাদের দিচ্ছে না। আমার যেটা মনে হয় যে, তারা চায় আমরা তাদেরকে বাধা দিই। আগামী নির্বাচনেও জয়ের আশাবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জয় আমাদের হবেই। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনগণের শক্তি নিয়েই আমরা ক্ষমতায় এসেছি। জনগণের ভোটেই আমরা ক্ষমতায় এসেছি। আমার জনগণের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা-বিশ্বাস আছে। যে উন্নয়নের ছোঁয়া আজকে সকলের জীবনে লেগেছে, নিশ্চয় তারা সেটা ধরে রাখবে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে সরকার গঠনের সুযোগ দেবে। আওয়ামী লীগের জয় হবে। তিনি বলেন, ইনশাল্লাহ আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও আমরা উদযাপন করতে পারব। আমরা না থাকলে আর কেউ ভালভাবে করতে পারবে না। কারণ তাদের (বিএনপি-জামায়াত) মনে পাকিস্তান। এখনও অনেকে বলে পাকিস্তান নাকি আমাদের চেয়ে বেশি উন্নত। যারা এটা বলে তাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। বলা উচিত পাকিস্তানে যেয়ে দেখে আসেন। পাকিস্তানের ঋণ শোধের জন্য সৌদি আরব ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। আমাদের কারও কাছে কোন ঋণ নেই। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ আমরা করে রেখেছি, যাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকে। আর সেই গতি অব্যাহত থাকবে যদি আওয়ামী লীগ আবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে। তাহলে মানুষ সুন্দর জীবন পাবে। প্রত্যেকটা গ্রাম শহরে রূপান্তর হবে। নাগরিক সকল সুবিধা গ্রামে বসেই পাবে। বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবেই প্রমাণিত বিএনপি একটি দুর্নীতিবাজ দল। দেশটাকে তারা লুটে খেয়েছিল। দেশের অনেকেই উন্নয়ন চোখে দেখে না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন তারা চোখে দেখে না, দেখবেও না। কারণ চোখ থাকতে তারা অন্ধ। শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জন্মলগ্ম থেকেই লড়াই সংগ্রাম করেছে। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সফলতা এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। এ সংগঠনের শিকড় অনেক গভীরে। দেশের উন্নয়নে কাজ করতে চাইলে যে সম্ভব তা প্রমাণ করেছি। আওয়ামী লীগ প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসে অনেক উন্নয়ন কাজ শুরু করে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা জয়ী হয়ে আবার দেশের উন্নয়নে কাজ শুরু করি। অনেক বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে আবার ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনে বলেই উন্নয়ন কাজগুলো দৃশ্যমান করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত ২০১৩ সালে ভোট ঠেকানোর নামে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, জ্বালাওপোড়াও শুরু করে। কিন্তু দেশের জনগণ রুখে দাঁড়ায় বলেই তারা পরাজিত হয়ে ঘরে ফিরে যায়। টানা দশ বছর ক্ষমতায় আছি বলেই দেশে উন্নয়ন দৃশ্যমান করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের টার্গেট তরুণ সমাজ। তরুণ সমাজ যেন কর্মসংস্থান করতে পারে সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা যাতে বিনিয়োগ করতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বেসরকারী খাত উন্মুক্ত করে দিয়েছি। ফলে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে উন্নতি হবে। না থাকলে যারা স্বাধীনতাই চায়নি, সেই শক্তি ক্ষমতায় আসলে উন্নয়ন থেমে যাবে। তারা দেশের কোন উন্নয়ন করবে না। ব্যক্তির উন্নয়ন করবে। অতীতেও আমরা তাই দেখেছি। জাতির জনককে হত্যার পর জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা কোন সরকারই দেশের উন্নয়ন করেনি। তাদের কাজ ছিল দুর্নীতি করা, স্বজনপ্রীতি, জাতির পিতার খুনীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া। তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করেছে। মামলার কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বিএনপির আমলে আমার নামে ১২ টি মামলা দিল। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে আমাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দিল। আমি কোন মামলাই তুলে নিতে বলিনি। আমি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, প্রত্যেকটি মামলা তদন্ত করতে হবে। কোন মামলায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পায়নি। তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, কিছুদিন আগে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হলো। আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম। দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারেনি। বরং পদ্মা সেতুর দুর্নীতির কাগজ খুঁজতে গিয়ে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও কোকো কোথায় কোথায় দুর্নীতি করেছে তার প্রমাণ পেয়েছে। কানাডার ফেডারেল কোর্ট রায় দিয়েছে পদ্মা সেতুতে বিন্দুমাত্র দুর্নীতি হয়নি। বরং খালেদা, তারেক, কোকোর দুর্নীতির প্রমাণিত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। তারা শুধু এতিমের টাকাই চুরি করে না, তারা আন্তর্জাতিকমানের দুর্নীতিবাজ। বৈঠক প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, এই সংসদের আজকেই পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক শেষ বৈঠক। দেশের মানুষ যদি আবার আমাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনে তাহলে আবার বৈঠক করতে পারব। তিনি বলেন, উন্নয়নের গতিধারা যেন অব্যাহত থাকে, সেটাই চাই। দেশবাসীকে বলবÑউন্নয়নের জন্য গতিধারা যেন অব্যাহত থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে যদি দেশের জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আবারও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনেন। আমার বিশ্বাস, দেশের জনগণ আবারও নৌকায় ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে। কারণ, দেশের জনগণের প্রতি আমার আস্থা-বিশ্বাস আছে। কারণ আওয়ামী লীগ যে দেশের মানুষের উন্নয়ন করতে পারে তা প্রমাণ করেছি। আগামী নির্বাচনে ইনশা আল্লাহ নৌকার জয় হবেই। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে নৌকা জিতবে ইনশা আল্লাহ। সূচনা বক্তব্যের পর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পরিচালনায় যৌথ সভায় শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন দলের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। এর পর আগামী নির্বাচন, দলের প্রচার কৌশল, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন দলের নীতিনির্ধারক নেতারা।
×