ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্কটে অবহেলায় বেড়ে ওঠা, তবু স্কুলমুখী-আঁধারে আলোকরেখা

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

সঙ্কটে অবহেলায় বেড়ে ওঠা, তবু স্কুলমুখী-আঁধারে আলোকরেখা

মামুন-অর-রশিদ ॥ নানান সঙ্কট, সমস্যা আর অবহেলার মধ্যেই বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে রাজশাহীর হেতমখা হরিজন পল্লীর শিশুরা। এক সময় স্কুল কী? সে সম্পর্কে জানাই ছিল না তাদের। খুপরি ঘরের ঘিঞ্জি পরিবেশেই বেড়ে উঠে এক সময় বেছে নিতে হতো বাপ-দাদার পেশা। এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হরিজন পল্লীর শিশুরাও যাচ্ছে স্কুলে। পড়াশোনার পরিবেশ নেই ঘরে, তারপরেও লেখাপড়ায় আগ্রহী পল্লীর শিশুরা। এরই মধ্যে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার সিঁড়ি ছুঁয়েছে পল্লীর শিশুরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ছে কয়েকজন। আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে পড়ছে অনেকে। আগে খুব বেশি হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পেত তারা। তবে এখন প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়েছে অনেকে। শুক্রবার রাজশাহী নগরীর হেতমখা হরিজন পল্লীতে সরেজমিন গিয়ে এখানকার বাসিন্দা, বিদ্যালয়গামী শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। রাজশাহী নগরীতে হরিজন সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল হেতমখা হরিজন পল্লী। নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডে এর অবস্থান। প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬শ’র বেশি পরিবারের বসবাস এখানে। ছোট ছোট খুপরি ঘর। এক ঘরেই পরিবারের সব সদস্যদের বসবাস। কোন কোন ঘরে ৫ থেকে ৬ সদস্য বসবাস করেন এসসঙ্গে। কোন রকমে যেন মাথা গোঁজার ঠাঁই তাদের। নারী-পুরুষ শিশুরা রাতদিন কাজেই ব্যস্ত থাকেন। জন্মের পর বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরাও ক্রমেই বাবা-মায়ের কাজে সহযোগিতা করে। এক সময় তারাও কাজে লিপ্ত হয়। শহরের নোংরা আবর্জনা পরিষ্কার তাদের মূল পেশা। অনেকে মেথর বলেন তাদের। স্থায়ী চাকরির সুযোগ নেই। কেউ সিটি কর্পোরেশনে ঝাড়ুদার, কেউ বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন অফিসের পরিচ্ছন্নতার কাজে লিপ্ত। মাস্টাররোলেই আটকে থাকে তাদের জীবন। স্থায়ীভাবে চাকরির সুযোগও নেই। এরই মধ্যে এখন এ পল্লীর শিশুরা আয়ত্ত করছে পড়ালেখা। স্কুলমুখী হয়েছে তারা। এটায় এখন আশার কথা। যেন আঁধার ঘরে বসে শিক্ষার আলো ছোঁয়ার চেষ্টা তাদের। সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে কথা হয় পল্লীর কিশোরী তানিয়া রানীর সঙ্গে। ১৮/১৯ বছরের তানিয়া শত প্রতিকূলতার মাঝেও প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে এখন পড়াশোনা করছেন রাজশাহী নগরীর শহীদ কামারুজ্জামান সরকারী কলেজের ডিগ্রীতে (পাস কোর্স)। তার দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন রাজশাহী বিদ্যালয়ে, একজন আছেন এবি ব্যাংকে মাস্টাররোলে কর্মচারী। তাদের বাবা রামেশ্বর অন্য হরিজন বাসিন্দাদের মতোই কাজ করেন। তানিয়া জানায়, তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয় নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে। এক ঘরেই বসবাস করতে হয় তাদের। পড়ার আলাদা কোন জায়গা নেই। রাতে পুরো পল্লীতে গান-বাজনা চলে। এরইমধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয় তাকে। ২০০৮ সালে যখন এসএসসি পরীক্ষা তখনই পড়াশোনার পরিবেশ পায়নি তানিয়া। এখানে-সেখানে বসেই কোন রকমে পড়াশোনা করতে হয়েছে। এখনও একই অবস্থার মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে তানিয়া রানী। শুধু তানিয়া নয়, এ পল্লীর সব ঘরের শিশুরা এখনও ঘিঞ্জি পরিবেশে বেড়ে উঠে স্কুলে যাচ্ছে। তাদের পল্লীতেই রয়েছে হরিজন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানেই সব ছাত্রই হরিজন পল্লীর। বাসায় বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করে স্কুলেও যাচ্ছে তারা। অনেকে প্রাথমিকের গ-ি পেরিয়ে পড়াশোনা করছে উচ্চ মাধ্যমিকে। রাজশাহী বহুমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীতে পড়ছে সোনালী। পাশের মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার জেএমসি পরীক্ষা দেবে এ পল্লীর কিশোর ঋত্বিক। হরিজন পল্লী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমাপনীর প্রস্তুতি নিচ্ছে দিয়া। একই পল্লীর শিশু রুপালী পড়ছে রাজশাহী বহুমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে। আর রুপালী নামের একজন এবার একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। রুপালী, দিয়া, সোনালীরা জানায়, স্কুলে তাদের আলাদায় থাককে হয় শুধু হরিজন পল্লীর বলে। অন্যরা তাদের সঙ্গে মেশে না। তারপরেও তারা পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু নানা করণে শেষ পর্যন্ত প্রাথমিকের গ-ি পার হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। কারও বিয়ে হয়ে যায়, কেউ বাপ-মায়ের সঙ্গে কাজে নেমে পড়ে। রাজশাহীর হেতমখা হরিজন পল্লীর বাসিন্দা ও মহানগর হরিজন ঐক্যপরিষদের সভাপতি শ্রী বসন্তলাল জানান, তাদের নানা সমস্যা। আবাসন সঙ্কট, কর্মসংস্থান নেই। ছেলেমেয়েরা উপযুক্ত হলেও কাজ পাচ্ছে না। ঘরে বসে বাবার আয় রোজগারেই তাদের খেতে হয়। এর মধ্যে স্কুলের পরিবেশে মিশতে পারে না অনেকে। তারপরেই তারা এখন স্কুলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ পল্লীর শিশুরা স্কুলে গেলেও হরিজন পরিচয় পাওয়ার পর তাদের স্কুল থেকেই বের করে দেয়া হতো। এখনও তাদের আলাদা থাকতে হয়। স্কুলে টিফিন পায় না হরিজনের শিশুরা। তিনি বলেন এখন তার বয়স ৯০। অথচ সরকারের কোন ভাতা তিনি পান না। তিনি বলেন- বয়স্ক, বিধবা কোন ভাতায় জোটে না তাদের। তিনি বলেন, দেশের অন্যান্য সিটিতে হরিজন পল্লীর বিদ্যুতের বিল দেয়া লাগে না। অথচ তাদের নিজেদের বিল পরিশোধ করতে হয়। ঘরের মধ্যে কাপড় টাঙিয়ে ছোট ছোট ঘরে করেই পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে তাদের থাকতে হয়। এরমধ্যে পড়াশোনার পরিবেশ নেই। তারপরেই নানা সীমাবদ্ধাতার মধ্যেই তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে এখন। পড়াশোনা করে তারা আদৌ কমসংস্থানের সুযোগ পাবে কি না এ নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন। হরিজন পল্লীতে গড়ে উঠা ‘হরিজন বিজয় বয়েজ ক্লাবে’র মাধ্যমে নিজেদের সমস্যার সমাধান করা হয়। এ ক্লাবের সভাপতি ও হরিজন পঞ্চায়েত কমিটির সহকারী মন্ডল হরিলাল বাবু বলেন, তারা সরকারী সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের একটি মন্দির রয়েছে সেখানেও মিলে না কোন অনুদান। স্থানীয় এমপি বারবার তাদের প্রতিশ্রুতি দিলেও কোন কাজ করেননি তাদের উন্নয়নে। তবে তিনি বলেন, তাদের ভরসা এখন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। আগের টার্মে তিনি হরিজন পল্লীর উন্নয়ন করতে চেয়েছিলেন। এবার আবার মেয়র হয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা আশা করছেন তাদের উন্নয়নে এবার কাজ করবেন লিটন। ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের কাজ শুরু করেছেন মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। জানা গেছে, ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু হতে যাচ্ছে বস্তি ও হরিজন পল্লী উন্নয়নের কাজ। এর মধ্যে নগরীর তিনটি বস্তির জন্য ২০ লাখ টাকা করে ৬০ লাখ এবং হরিজন পল্লীর উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৬০ লাখ টাকা । রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বলেন, রাজশাহী নগরীর বস্তি ও হরিজন পল্লীর উন্নয়ন প্রকল্পে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে উন্নয়ন কাজের জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়েছে।
×