ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পালা নাট্যের এক অদ্ভুত মোহনীয় ক্ষমতা রয়েছে ॥ সায়িক সিদ্দিকী

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

পালা নাট্যের এক অদ্ভুত মোহনীয় ক্ষমতা রয়েছে ॥ সায়িক সিদ্দিকী

বাংলাদেশের অত্যন্ত মেধাবী তরুণ নাট্যকর্মী, নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা সায়িক সিদ্দিকী। কিশোরগঞ্জের সন্তান সায়িক সিদ্দিকী বাংলাদেশের পাশাপাশি বিদেশের মাটিতে সাংস্কৃতিক প্রতিভার দ্যুতি ছড়িছেনে। দুই বাংলাতে নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনয়শিল্পী সত্তার জানান দিয়েছেন। তার রচিত ও নির্দেশিত কয়েকটি পালা বেশ আলোচনায় এসেছে। এগুলো দেশ-বিদেশে নন্দিত হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম নাট্য ঐতিহ্য পালাকে নতুন করে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড ও ব্যস্ততা নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। আপনার থিয়েটার জীবর শুরুটা কোথায় কিভাবে হয়েছে? সায়িক সিদ্দিকী : আমার জন্ম কিশোরগঞ্জে। সেই ছোটবেলায় রবিঠাকুরের নৃত্যনাট্য ‘তাসের দেশ’ এর মধ্য দিয়ে প্রথম অভিনয় জীবন শুরু করি। তারপর রবিঠাকুরের ‘কাল মৃগয়া’, ‘শাপমোচন’, ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে কাজের মধ্য দিয়ে মঞ্চে আমার একটু একটু করে যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে নৃত্যনাট্য, নাটক, আর পালানাটকে কাজ করে আসছি। এ পর্যন্ত কত নাটকে অভিনয় করেছেন? সায়িক সিদ্দিকী : আসলে ওই ভাবে নির্দিস্ট সংখ্যা বলতে পারছি না।তবে আমি বিভিন্ন ধারার নাটকে অভিনয় করেছি যেমন সংলাপ প্রধান নাটক, নৃত্যনাট্য, পালানাট্য। আমার জন্ম কিশোরগঞ্জে হওয়ায় আমি খুব ভাগ্যবান। ছোটবেলা থেকে এখানে একটা উন্নত সাংস্কৃতিক পরিবেশ পেয়েছি। ছোটবেলায় অনেক কিছু শিখতে পেরেছি আমার কিশোরগঞ্জ থেকে। ময়মনসিংহগীতিকাসহ অনেক বিখ্যাত লোকজ গল্পের নাটকের পাশাপাশি ও রবিঠাকুরের কিছু নৃত্যনাট্য করেছি। যেমন নৃত্যনাট্য ‘কাজলরেখা’, ‘মহুয়া’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘মলুয়া’, ‘সোনাই মাধব’, ‘শান্তির স্বপক্ষে’, ‘সাখিনা সুন্দরী’, ‘রূপবান’, ‘বীরাঙ্গনা সখিনা’, ‘তাসের দেশ’, ‘কাল মৃগয়া’, ‘শ্যামা’, নাটক ‘তাহাদের উপাখ্যান’, ‘মড়া’, ‘ভামিনী অধ্যায়’, ‘শমসের বাওয়ালী’, ‘নোনা ছোবল’, পালা নাটক ‘রূপচান সুন্দরীর পালা’, ‘ভানু সুন্দরীর পালা’, ‘জয়তুন বিবির পালা’, ‘খোয়াবজানের পালা’, ‘নোলকজানের পালা’ প্রভৃতি। কত নাটক রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন? সায়িক সিদ্দিকী : আমার রচিত ও নির্দেশিত নাটক গুলি হচ্ছে ‘তাহাদের উপখ্যান’, ‘রূপচান সুন্দরীর পালা’, ‘ভানু সুন্দরীর পালা’, ‘ভামিনী অধ্যায়’, ‘জয়তুন বিবির পালা’, ‘কইন্যা শশীর পালা’, ‘গুণজান বিবির পালা’, ‘পদকের পদাবলী’, ‘খোয়াব জানের পালা’, ‘নোলক জানের পালা’। এখন সবাই প্রসেনিয়াম থিয়েটার তথা ইউরোপিয়ান থিয়েটার নিয়ে ব্যস্ত, সে সময়ে আপনি পালা করছেন, ক্যারিয়ার কি ঝুঁকিতে পড়ে গেল না? সায়িক সিদ্দিকী : না, আমি মনে করছি না যে ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। বরং আমি গর্বিত যে এত চমৎকার একটি লোকজ নাট্য ধারা আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল। যা নিয়ে এই প্রথম কাজ হচ্ছে না বহু বছর আগে থেকেই এই পালা বঙ্গ মঞ্চে মঞ্চায়িত হয়ে আসছে। হাজার বছরের এই ঐতিহ্যকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারছি। এই পালা কে নিয়ে কাজ করতে পারছি। আসলে কি জানেন আমার ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, যে শিল্প আমার সত্তায় আরোপিত হিসেবে বসে, সে শিল্পের দ্বারা আমি শিল্পী হতে পারব না। আসলে পালা নাট্য আমার ভেতরে সেই ছোটকাল থেকে এমনভাবে ভর করে আছে যে আমি পালা ছাড়া আর কিছু করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। তাছাড়া অনেক বছর ধরে আমি পালা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম পালা নাট্যের এক অদ্ভুত মোহনীয় ক্ষমতা রয়েছে যা দর্শকদের বাংলার মাটির সঙ্গে বারবার পরিচয় করিয়ে দেয়। দেশের বাইরে আপনার কাজের পরিধি বেড়েছে এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কি? ভারতে কি কি কাজ করেছেন? সায়িক সিদ্দিকী : গত এক বছরে আমাকে অসংখ্যবার ভারতের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন উৎসবে পালা নিয়ে যেতে হয়েছে। ওখানকার দর্শক পালা কে খুব পছন্দ করছে। আমাদের পালা দেখে ওখানকার কিছু নাটকের দল বাংলাদেশের পালা শেখার জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমি ভারতে নদিয়া জেলার চাকদাহ নাট্যজন নামের একটি থিয়েটারে আমার লেখা ‘ভানু সুন্দরীর পালা’টি নির্দেশনা দেই। ভারতের বিভিন্ন জেলায় প্রতিনিয়ত এই পালাটির মঞ্চায়ন হচ্ছে। তার কিছু সময় পর ভারতের বাঁকুড়া জেলার বাঁকুড়া থিয়েটার একাডেমি নামক একটি থিয়েটারে আমার লেখা ‘কইন্যা শশীর পালা’ নির্দেশনা দেই। এই পালাটিও তারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চায়ন করে বেড়াচ্ছে। এই দুটি পালা কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে পালা নাটক বা পালা ফর্মের ভবিষ্যত কি? সায়িক সিদ্দিকী : আমি মনে করি ভবিষ্যত অনেক ভালো। এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা পালা ফর্মকে অনেক ভালভাবে নিচ্ছে। আমি আমাদের দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পালার শো করেছি, তখন দেখেছি ছাত্রছাত্রীরা পালাকে অনেক পছন্দ করেছে। শুধু তাই নয় এই একই পালা যখন আমি ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে আবারও শো করেছি বেশকিছু ছাত্রছাত্রী আবারও তা দেখার জন্য চলে এসেছে। আমরা দেখছি প্রতিনিয়ত বেশিরভাগ দর্শকরা পালাটি একবার দেখে গিয়ে পরবর্তীতে একই পালা আবারও দেখার জন্য আরও কিছু দর্শক সঙ্গে নিয়ে আসছে। পালা নাট্য মঞ্চে ব্যাপক ভাবে নতুন দর্শক তৈরি করছে । যা নাট্য আন্দোলনের এক ইতিবাচক দিক। বাংলাদেশের নাট্য ঐতিহ্য রক্ষায় নাট্য আন্দোলন কতটা ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন? সায়িক সিদ্দিকী : পালা নাট্য মঞ্চে নতুন দর্শক তৈরি করছে ব্যাপক ভাবে। শুধু তাই নয় ঐতিহ্যবাহী এই নাট্য আঙ্গিকের সঙ্গে এই প্রজন্মের দর্শকদের পরিচয় হচ্ছে। যা এই সময়ের নাট্য আন্দোলনের এক ইতিবাচক দিক। আমাদের এই প্রজন্মের দর্শকরাও আমাদের দেশের এই ঐতিহ্যবাহী নাট্য আঙ্গিক পালার সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে। বাংলা নাট্যের এই শক্তিশালী ফর্ম পালা সম্পর্কে জানতে পারছে। অভিনয়, নাটক রচনা নাকি নির্দেশনা কোন্ বিষয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? সায়িক সিদ্দিকী : তিনটি বিষয়েই ভাল লাগে। তবে অভিনয় করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। নাটক বা পালা নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? সায়িক সিদ্দিকী : পালাকে সবার কাছে পৌঁছানো। এই প্রজন্মের সব ছেলেমেয়েরা মঞ্চে গিয়ে শুধু পালা দেখবেই না তারাও এক সময় পালায় অভিনয় করবে। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর কাছে আমাদের দেশের এই শক্তিশালী নাট্য আঙ্গিককে তুলে ধরা। ভারতে যেমন এখন পালার ওপর কাজ শুরু হয়েছে। আমি স্বপ্ন দেখি বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও এক সময় পালা নিয়ে কাজ হবে। বাংলাদেশের তরুণ নাট্যকর্মীদের নিয়ে কোন পরিকল্পনা আছে কি? সায়িক সিদ্দিকী : অবশ্যই আছে। তরুণ নাট্যকর্মীরাই পালার প্রাণ। আমাদের দেশে আমার সব ক’টি পালায় তরুণ রাই পারফর্ম করছে আমাদের ঢাকার বঙ্গলোক, ময়মনসিংহের অন্বেষা থিয়েটারের কর্মীরা সবাই তরুণ। আবার ভারতেও যে দুটি পালা নির্দেশনা দিয়েছি সেখানেও তরুণরাই অভিনয় করছে। অসম্ভব মেধাবী অনেক তরুণ নাট্যকর্মী আছে আমাদের দেশে তাদের সবার মাঝে পালাকে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। তাদের সঙ্গে নিয়ে নতুন নতুন পালা দর্শকদের উপহার দিতে চাই। আমি বিশ্বাস করি এই মেধাবী তরুণরা যদি যুক্ত হয় তবে এই পালার দর্শক জনপ্রিয়তার গতি অনেকগুণে বেড়ে যাবে । -সাজু আহমেদ
×