ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘গিনেজ রেকর্ড’ গড়াই তার নেশা (ভিডিও)

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ২৬ অক্টোবর ২০১৮

ডেস্ক ॥ মানুষের কত বিচিত্র ধরনের শখ বা নেশা হতে পারে তা বলা কঠিন। পুরনো মডেলের গাড়ি সংগ্রহ, ডাক টিকিট সংগ্রহ, চুল বড় রাখা, গোঁফ বড় রাখা, পর্বতশৃঙ্গ জয় করা ইত্যাদি লাখো ধরনের শখ মানুষের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু কখনো শুনেছেন কারো শখ শুধু গিনেজ বুকে নাম লেখানো। শুধুমাত্র গিনেজ বুকে নিজের নাম উঠানোর জন্য সবক’টি দাঁত ফেলে ৪৯৬টি স্ট্র মুখে নেন। ভারতের নয়াদিল্লি থেকে লন্ডন, এরপর লন্ডন থেকে ওয়াশিংটন ও সানফ্রান্সিসকোতে পিজা সরবরাহ করেছেন মাত্র ২৭ ঘণ্টার মধ্যে- তাও গিনেজ বুকে নাম উঠানোর জন্য। ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির ছবি, মানচিত্র পুরো শরীরে ট্যাটু করিয়েছেন গিনেজ বুকে নাম তোলার আশায়। এই অদ্ভুত সৌখিন ব্যক্তির নাম হার প্রকাশ রিশি। তিনি ভারতের নাগরিক। যাকে ভারতে ‘গিনেজ রিশি’ নামেও অনেকে চেনে। বেশ কয়েক বার গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন তিনি। ৭৬ বছর বয়সী হার প্রকাশ রিশি ১৯৯০ সালে প্রথম গিনেজ বুকে স্থান করে নেন। পুরো ভারত জুড়ে নিজের স্কুটি দিয়ে বিরতিহীনভাবে ১,০০১ ঘন্টা পাড়ি দিয়েছিলেন। ২২ এপ্রিল থেকে ৩ জুন পর্যন্ত তিনি ৩০ হাজার ৯৬৫ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন তিনি। নিজের ঘরটাকে তিনি জাদুঘর বানিয়ে ফেলেছেন। পুরো ঘরের দেয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে তাকে দেয়া অসংখ্য সনদ। হার প্রসাদ রিশি বলেন, ‘আমার ‘কিনেটিক ১০০ সিসি’ স্কুটার দিয়ে পুরো ভারত ভ্রমণ করেছি। সঙ্গে ছিল আমার দুই বন্ধু। মহারাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে আমরা গিয়েছি। তখনই প্রথম গিনেজ বুকে আমার নাম উঠে। তারপর থেকে লোকজন আমাকে গিনেজ নামে ডাকা শুরু করে।’ ‘আমি চিন্তা করলাম নামটাই বদলে ফেলা যায় কিনা? যেই ভাবা সেই কাজ। আমি গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের পাবলিকেশন্সকে অনুরোধ জানালাম, আমার নামটা বদলে দিতে। তারা অনুরোধ রাখলেন। আমার নাম বদলে রাখা হলো ‘গিনেজ রিশি’।’ গত ১০ বছর ধরে তিনি ভারতের গিনেজ রেকর্ডস ক্লাবের সভাপতি। বেশ কয়েকজন ভারতীয়কে গিনেজ রেকর্ড গড়তে এই ক্লাবের পক্ষ থেকে সহায়তা করেছেন বলে তিনি দাবি করেছেন। ২০০৯ সালে নয়াদিল্লিতে রুশ দূতাবাসের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি দেখতে পান, কিছু শিশু রাশিয়ার পতাকা বিতরণ করছে। পতাকাতে লেখা ‘গর্ব ও আনন্দ’। রিশি বলেন, ‘আমি চিন্তা করলাম, পুরো বিশ্বকে নিজের মধ্যে নিয়ে আসলে কেমন হয়?’ এরপর তিনি ৪৯৯টি পতাকা তার শরীরে আঁকেন। তার পেট হয়ে যায় একটা বিশ্ব মানচিত্র। ‘যখনই আমি কোনো দেশ ভ্রমণ করেছি লোকজনে আমাকে বলেছে, তাদের দেশের পতাকা চিহ্নিত করতে।’ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হও’- এমন একটি লেখা রুশ, গ্রিক, জার্মান, ফরাসি, হিব্রু ও অন্যান্য ভাষায় তার শরীরে স্থায়ীভাবে লেখা রয়েছে। শুধু তাই নয়, ভারতীয় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবিও তার শরীরে আঁকা আছে। ২০১১ সালে তিনি তার মুখে অনেকগুলো স্ট্র নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারছিলেন না। বিষয়টি তার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। গাড়ির পার্টস প্রস্তুতকারক রিশি বলেন, ‘পরের দিন আমি একজন দন্তচিকিৎসকের শরণাপন্ন হই এবং সবগুলো দাঁত তুলে ফেলতে বলি। সব দাঁত তুলে ফেলার পর আমি আবার চেষ্টা করি এবং ৪৯৬টি স্ট্র মুখে পুরতে সক্ষম হই।’ তাছাড়া তিনি ৬৫টি জ্বলন্ত মোমবাতি মুখে নেয়া এবং ৫০০ গ্রাম ওজনের একটি টমেটো কেচাপ স্ট্র ব্যবহার করে মাত্র ৩৯ সেকেন্ডে খেয়ে গিনেজ রেকর্ড গড়েন তিনি। এখন তিনি আরেকটি বিশ্ব রেকর্ড গড়ার অপেক্ষায় আছেন। নয় হাজার ৫০০ পৃষ্টা জুড়ে বিশ্বের দীর্ঘতম উইল লিখে এখন তিনি গিনেজ বুকে নাম লেখাতে চেষ্টা করছেন। তার ২০টি রেকর্ডের মধ্যে ৭ টি গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে এবং বাকিগুলো লিমকা বুক অব রেকর্ডসে নথিভুক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি ২০টির বেশি গিনেজ রেকর্ড ভেঙেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাত্র গিনেজ বুক মাত্র সাত-আটটি রেকর্ডের সনদ দিয়েছে। আরও ১৫টি রেকর্ডের সনদ পাওয়া এখনো বাকি।’ ‘সবাই আমাকে পাগল ভাবে’ রিশি ‘রিপ্লে’স বিলিভ ইট অর নটের’ বড় ভক্ত। প্রতিষ্ঠানটি অদ্ভুত সব ঘটনা ও জিনিসপত্র নিয়ে কাজ করে। রিশি পরিকল্পনা করেছেন, মৃত্যুর পর তার দেহাংশ তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে দান করবেন। এমনকি তিনি ওই প্রতিষ্ঠানটিকে অনুরোধ করেছেন, তার দেহ যেন স্বচ্ছ কফিনে রেখে প্রদর্শনী করা হয়। যাতে দর্শনার্থীরা তারা ট্যাটুগুলো দেখতে পারে। রিশি বলেন, ‘এই বৃদ্ধ বয়সে এসে আমি চাই না আমার রেকর্ডগুলো কেউ ভেঙে ফেলুক। যত দিন সম্ভব আমি আমার রেকর্ডগুলো ধরে রাখতে চাই।’ এই আসক্তি ধরে রাখা তার পক্ষে সহজ কাজ নয়। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন প্রায়ই তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। তার শরীরের ট্যাটু ও বিশ্ব রেকর্ড নিয়ে সমালোচনা করে। ‘সবাই মনে করে আমি পাগল। মানুষ আমাকে বোকা বলে, আমাকে নিয়ে কটাক্ষ করে, নানান নামে ডাকে। কিন্তু এসবে আমি পাত্তা দেই না।’ গত তিন বছর ধরে রজত কুমার রিশির একজন প্রতিবেশী হিসেবে আছেন। রজত জানান, তিনি ভেবেছিলেন হার প্রকাশ রিশি কোনো ধরনের কষ্টে আছেন। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘যখন আমি তার সম্পর্কে সংবাদে পড়লাম তখন অবাক হয়েছি।’ তিনি আরও জানান, রিশির সঙ্গে তেমন বেশি কথা হয় না তার। কারণ তার মেজাজ একটু খিটখিটে। তিনি অনেক রেকর্ড গড়ায় তার মন জিতে নিয়েছেন। ‘অন্যান্য প্রতিবেশীরা রিশির অগোচরে তাকে নিয়ে তামাশা করে। তাকে নানান নামে ডাকে। কিন্তু আমি তার নেশার জন্য তাকে শ্রদ্ধা করি। কেউ কি ভাবল তার কোনো গুরুত্ব না দিয়েই তিনি অবিশ্বাস্য ধরনের কাজ করে চলেছেন। এমন কিছু করার চেষ্টা করলে আমাকে ঘরছাড়া হতে হবে।’ রিশির স্ত্রী বিমলা স্বামীর কাজকে সমর্থন করেন। বিমলা বলেন, ‘এই কাজ যদি তাকে(রিশি) আনন্দ দেয় তাহলে আমি কেন বিরক্ত হব। রিশি মনের দিক দিয়ে এখনো তরুণ।’ এই সময় রিশি জানান, মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলে তিনি কষ্ট পান। তার পাওয়া স্বর্ণপদকগুলো দেখিয়ে তিনি হাসিমুখে বলেন, ‘আমি যদি মানুষের কথায় কান দিতাম তাহলে এত সম্মান অর্জন করতে পারতাম না।’ https://youtu.be/kLT40-EzfwU
×