ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যেভাবে লিখেছিলেন প্রথম কবিতা

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২৬ অক্টোবর ২০১৮

যেভাবে লিখেছিলেন প্রথম কবিতা

কবিতার উৎসমূল কোথায়? কবিতা লিখতে হলে কী করতে হবে? এক পাঠকের এমন প্রশ্নের জবাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘প্রেমে পড়ো, পড়ে ব্যর্থ হও, সেই ব্যর্থতা আর বেদনা থেকে সৃষ্টি হতে পারে কবিতার।’ অনেকেই বলেও থাকেন, ‘কবিতার উৎসমূলে আছে বেদনাবোধ। বেদনাবোধই জন্ম দেয় কবিতার।’ ইংরেজ কবি কিটস্-শেলি-মিল্টন তাদের প্রেয়সির বিরহে লিখেছেন অনেক কবিতা। নজরুলও লিখেছেন। কালিদাস ‘মেঘদূত’ লিখেছিলেন প্রিয়াবিরহের বেদনা থেকেই। কথিত আছে, ‘বাল্মীকির ক্রোঞ্চমিথুন বিয়োগজনিত শোকই ‘শ্লোক’ রূপে উৎসারিত হয়েছিল।’ কেউ কেউ মনে করেন, কবিতার জন্মজঠর হচ্ছে কল্পনা ও সাধনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বলেই ফেলেছেন, ‘কবিতা কল্পনা-লতা। সাধনার ধন।’ এ প্রসঙ্গে কন্সিনোস এ্যাসেন্সের কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ‘সেভিল’-এ, কিন্তু থাকতেন মাদ্রিদে। সমুদ্র নিয়ে তিনি একটি অনুপম কবিতা লিখেছিলেন। এ জন্য বোহের্স তাকে অভিনন্দন জানালে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ সমুদ্র নিয়ে কবিতাটি সুন্দরই। কোন একদিন হয়ত সমুদ্র দেখার সৌভাগ্য হবে।’ তিনি কখনও সমুদ্র দেখেননি। অর্থাৎ কবিতাটি কাল্পনিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও বলেছেন, ‘লেখা পড়ে যেমন ভাবো, লেখক তেমন নয় গো...!’ কবিতার উৎসমূলে রয়েছে সৌন্দর্য অনেকে আবার এ ধারণাও করেন। ফুল, পাখি, নদী চাঁদ, ঝর্ণা ও প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং রমণীর রূপলাবণ্যম-িত শরীর, বক্ষ, কেশ, আঁখি, মুখবয়ব ভাবুক মনকে নাড়া দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিচ্ছে বার বার। যুগের পরিবর্তনে কবিতার ধরন বা গঠনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আধুনিক গীতিকবিতা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইদানীং আধুনিকতার চড়ংঃ গড়ফবৎহরংসকে কেন্দ্র করে কবিতার বক্তব্য বিষয়বস্তুতে এসেছে নানা রকম পরিবর্তন। দিনে দিনে কবিতা হয়ে উঠছে একটি শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম। কাদিকামো বলেছেন, ‘নব্বই মিনিটের একটি চলচ্চিত্র যা প্রকাশ করতে না পারে, তিন মিনিটের একটি ট্যাঙ্গো (দক্ষিণ আমেরকিার নৃত্য) কবিতা তা সফলভাবে উপস্থাপন করতে পারে।’ বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ ‘যেতে নাহি দিব’ নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতাসেন’ ‘আট বছর আগে একদিন’ মির্জা গালিব কিংবা হাফিজের অসংখ্য ফার্সি ও আরবি কবিতা কাদিকামোর উক্তির সার্থকতা প্রমাণ করে। জাপানী ‘হাইকু’ উর্দু ‘শের’ ইংরেজি অনেক কবিতা এর উদাহরণ। পোলিশ কবি শিম্বোর্সকা এক সাক্ষাতকারে প্রশ্নকারীকে বলেছিলেন, ‘একজন চিত্রশিল্পীকে আমি এই প্রশ্ন করতে পারি না যে, কেন তিনি এভাবে আঁকেন আর কেনইবা অন্যভাবে নয়। একজন সুরকারের কাছে আমি জানতে চাইতে পারি না, কীভাবে হঠাৎ করে জীবনে সঙ্গীত আসে। আমি জানি তাঁরা আসলেই তা ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। আমিও পারি না। এ নিয়েই আমি হয়ত জন্মেছি। তবে এ নিয়ে আপনাকে অবশ্যই কিছুটা পরিশ্রম করতে হবে।’ অর্থাৎ পরিশ্রম বা সাধনার মাধ্যমে কবিতা সৃষ্টি সম্ভব। বিশেষ মুহূর্ত বা পরিস্থিতি হতে পারে কবিতার উৎসবিন্দু। এ প্রসঙ্গে মধুসূদনের কথা উল্লেখ করা যায়। একবার তাকে টেনে নিল বিদেশী ভাষা। ভুল বুঝতে পেরে পরবর্তীতে ফিরে এলেন মাতৃভাষার কোলে। উপহার দিলেন কালজয়ী কাব্যসম্ভার। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, সুকান্তর কবিতার জন্মও বিশেষ মুহূর্ত ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেই। তবুও তা কালোত্তীর্ণ। এ প্রসঙ্গে রুশ কবি ভজনেসেন্সকীর কবিতার সৃষ্টিরহস্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আমি কখনই কলম দিয়ে কবিতা লিখি না। আমি রাস্তায় হেঁটে বেড়াই; তবে বনেই হাঁটতে পছন্দ করি বেশি এবং যদি ঘণ্টা দু’য়েকের মতো হাঁটি তাহলে একটি, দুটি কিংবা তিনটি কবিতা পেয়ে যাই, তবে আমার হাঁটা যদি আরও দীর্ঘ হয় তাহলে একটি দীর্ঘ কবিতাই আমার আয়ত্তে চলে আসে।’ অনেকের ধারণা, নির্জনতার পথ ধরেই আত্মপ্রকাশ ঘটে কবিতায়। এ কথা সত্য, নির্জনতা ব্যক্তিমনকে টেনে নেয় ভাবনার গভীরতায়, ক্ষণিকের তরে হলেও করে তোলে ভাবুক ও কবি। রবীন্দ্রনাথকেও নির্জনতার অভিসারী বললে ভুল হবে না। পোলিশ কবি শিম্বোর্সকা এই নির্জনতার শিকার। নির্জনতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘এ ছাড়া আমি লিখতে পারি না। এমন কোন লেখকের কথা আমি কল্পনা করতে পারি না যিনি শান্তি ও নির্জনতা খুঁজে পতে চেষ্টা করেননি। দুর্ভাগ্যক্রমে কবিতা কোলাহল, হুল্লোড় কিংবা বাসে সৃষ্টি হয় না। চার দেয়াল এবং টেলিফোন না বাজার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখতে পারে জাগ্রত অবস্থায়Ñ যাকে বলা যেতে পারে কল্পনা। অচেতন মনে বা ঘুমন্ত অবস্থায় যা অবলোকন করে তাকে স্বাভাবিক ভাষায় বলা চলে স্বপ্ন। স্বপ্নও হতে পারে কবিতার মূল উৎস। কোলরিজের ‘কুবাই খান’ কবিতাটিই এর প্রমাণ। যেভাবে কবি স্বপ্ন দেখেছিলেন, জেগে উঠে সেভাবেই কবিতাটি রচনা করেছেন। পৃথিবীর অনেক কবির জীবনেই এমনটি ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এমার্সনের বক্তব্য হলো, ‘কবিতা থেকেই কবিতা স্ফুরিত হয়’ বা ‘কবিতা থেকেই কবিতার জন্ম’। এমার্সনের এই ধারণা বা উক্তি অমূলক নয়। এ কথা সত্য যে কোন সার্র্থক কবিতাই ভাবুক পাঠকমনে সৃষ্টি করে সূক্ষ্ম মায়াজালÑ তার সঙ্গে যুক্ত হয় আরেকটি জগত ও মুহূর্ত। সে মুহূর্তে ভাবুক পাঠকমন দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে নতুন কবিতা। তাই বলে একে ততক্ষণ অনুকরণ বলাও টিক হবে না, যতক্ষণ অনুকরণীয় বিষয়টি হয়ে থাকে অনুপ্রেরণার উৎস। রবীন্দ্রনাথের ‘১৪০০ সাল’ কবিতা অবলম্বনে লেখা নজরুলের ‘১৪০০ সাল’ এর উদাহরণ। তাই বলে নজরুলের রচনাকে অনুকরণ বলা যাবে না। কারণ এর বাণী, চেতনা ও বক্তব্য রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বতন্ত্র ও স্বকীয়। প্রায় সব কবির ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটা স্বাভাবিক। তা হলে দেখা যাচ্ছে, কবিতার সৃষ্টি রহস্য বা উৎসমূল বিচিত্র। উল্লিখিত উৎসগুলো ছাড়া যে কবিতার উৎসস্থল থাকতে পারে না- এ কথা বলার উপায় নেই। সবচেয়ে অবাক কা- এই যে, কবিতার উৎসরহস্য আবিষ্কারে বিজ্ঞান অপারগ। ক্লোন করে গরু-ভেড়া এবং টেস্ট-টিউবের সাহায্যে মানব-শিশুর জন্ম দিতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এমন পদ্বতিতে তারা পারেননি কোন কবিতার জন্ম দিতে। বড় বিচিত্র ও রহস্যঘেরা কবিতার উৎসমূল। মানবমনের সূক্ষ্ম ও বিচিত্র অনুভূতির মাধ্যমেই খোলা যেতে পারে ওই মহলের দু-একটি দরজা-জানালা। তবে সেই জানালার পাশে যদি বসে থাকে হাস্যোজ্জ্বল কোন তরুণী তা হলে কবিতা হতে পারে অবলীলায়। এ প্রসঙ্গে আমরা দুই বাংলার জনপ্রিয় কবি ও কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা লেখার পেছনে কী উৎস ছিল সেদিকে লক্ষ্য করি। বাল্যকালে অনেকেরই যেমন আকাক্সক্ষা থাকে বড় হয়ে লেখক হবে তেমন কোন আকাক্সক্ষা ছিল না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। একটু একটু ইচ্ছে ছিল, বড় হয়ে ভূপর্যটক হবে। এই ইচ্ছেটা হয়েছিল মূলত তখনকার দিনে কিছু লেখকের গল্প পড়ে। তখনকার দিনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা ছিল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বের হতে তিন মাস সময় লাগত। এ তিন মাস সময়ে সুনীলের বাবা ... তাকে বাড়ি আটকে রাখার জন্য একটি প্ল্যান করলেন। মহাশয়ের ধারণা ছিল, ছেলেটা দুপুরবেলা বাড়ির বাইরে বের হলে কুসঙ্গে পড়বে, বখে যাবে, বিড়িফিড়ি খেতে শিখবে। .. বাড়িতে টেনিসনের কাব্যসংগ্রহ ছিল। বইটি সুনীলের হাতে দিয়ে রোজ দুটো করে কবিতা অনুবাদ করতে বললেন তিনি। বাবাকে বেশ ভয় পেত সুনীল। তার নিষেধ অমান্য করার সাহস ছিল না। অগত্যা বসে বসে টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করতে লাগল। তখন সুনীলের বয়স পনেরো কিংবা ষোলো বছর। দু-একদিন অনুবাদের সেই বিরক্তিকর কাজটি করার পর তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। ... অনুবাদগুলো মিলিয়ে দেখতেন না। শুধু টেনিসনের কবিতার লাইন আর সুনীলের অনূদিত লাইনগুলো গুনে গুনে টিক মেরে দিতেন। সুনীল ভাবল, যেহেতু বাবা কবিতা মিলিয়ে দেখেন না, তা হলে এত কষ্ট করা কেন? এরপর দিনই টেনিসনের কবিতার প্রথম লাইনটার মতো মোটামুটি মিল রেখে বাকিটা সুনীল বানিয়ে লিখল। কাজটি একেবারে সহজ মনে হলো তার কাছে। এভাবেই প্রথম কবিতা লেখা হয়ে উঠেছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। সেই সব কবিতা কিন্তু সুনীল কোথাও সঙ্কলন করেনি, এমনকি কোথাও ছাপতেও দেয়নি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকায়। তখনকার দিনে বন্ধুর বোনদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ খুব একটা ছিল না। একজন বন্ধুর বোনের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল সুনীলের। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারত না। দেখা হয়, কথা হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিশেষ কিছু যে একটা ব্যাপার আছে, সেটি বলা হয়ে ওঠে না। শেষে একটি বাঁকা পথ বেছে নিতে হলো। বন্ধুর সেই বোনকে উদ্দেশ্য করে লিখে ফেলল একখানি চিঠি। তারপর ভাবতে লাগল, চিঠি মেয়েটির হাতে দেবে কী করে? হাতে হাতে দেয়ার সাহস হয় না। ডাকে পাঠালে বাড়ির অন্য কেউ সেটি খুলে ফেলতে পারে। উপায়ন্তর না দেখে, ‘একটি চিঠি’ শিরোনাম দিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠিয়ে মনের কোণে সুপ্ত বাসনা নিয়ে বসে রইল, যদি ছাপা হয় তাহলে মেয়েটি হয়ত পড়বে। তখন ‘দেশ’ পত্রিকা রাখা হতো মেয়েটির বাড়িতে। কিন্তু কবিতা পাঠালে যে ‘দেশ’ এ ছাপা হয় না, সে কথা কিন্তু সুনীল জানত না। তাকে অবাক করে দিয়ে সম্পাদক সেই কবিতাটি ছেপে দিলেন, সময়টা তখন ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ। তখন ‘দেশ’ পত্রিকায় বিখ্যাত লেখকদের গল্প ও প্রবন্ধ ছাপা হতো বেশি। কবিতা তেমন ছাপা হতো না। দু-একটি ছাপা হতো, তাও বড় কোন লেখার তলায়। কোথাও হয়ত প্রবন্ধ শেষ হয়েছে, তলায় খানিকটা জায়গা বের হলো, সেখানে একটি কবিতা বসে গেল। এ জন্যই বোধ হয় অচিন্ত্য কুমার সেন ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘গদ্যের পাদদেশে স্থান হয় বলে কবিতার আরেক নাম পদ্য।’ ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়ে গেল সুনীলের প্রথম কবিতা, কবিতার আদলে আসলে সেটি একটি চিঠি। মেয়েটি পড়ল হয় সেই কবিতা (চিঠি)। কিন্তু এটি যে তার ভাইয়ের বন্ধু সুনীলের লেখা তা আর বিশ^াস করল না। মেয়েটি জানাল, সুনীলের নামের সঙ্গে মিলে গেছে কবির নামটা। বলাবাহুল্য, মেয়েটির কবিতার দিকে বিশেষ মনোযোগ ছিল। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে এমন কিছু পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দিত যা সুনীল আগে কখনও পড়েনি। পরে খুঁজে খুঁজে সেই কবিতাটি পড়ে নিত। মেয়েটির কাব্যের প্রতি মনোযোগ ছিল বলে সুনীল মুগ্ধ হতো। তার মনোযোগ নিজের দিকে টেনে আনতেই কবিতায় আশ্রয় নিয়েছিল সুনীল। যদি মেয়েটির খেলাধুলায় উৎসাহ থাকত সুনীল বোধহয় খেলোয়াড়ই হতো। এভাবেই লেখা হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
×