ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২৬ অক্টোবর ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পর্ব-২০) জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন তাঁর কবিতায়, কুড়ি বছর পেরিয়ে যাবার কথা। চরণটা বোধহয় ছিল এই রকম: ‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার। তখন হঠাৎ যদি দেখা হয় তোমার আমার ...।’ এই কথাগুলোতে দুটি বিষয়ে ভাবার মতো উপাদান আমরা খুঁজে পাই। একটা হচ্ছে সময় সংক্রান্ত। কুড়ি বছর। দুই দশক। মেলা বছর। খেলা কথা নয়। এই সময়ের বিষয়টি মনের ভেতরে কেমন যেন হাহাকার সৃষ্টি করে। মনটা আর্দ্র হয়ে আসে। আবার পরক্ষণেই এই দুঃখ ভারাক্রান্ত মনকে উদ্দীপিত করে তোলে এর পরের বাক্যটি, ‘তখন হঠাৎ যদি দেখা হয় তোমার আমার!’ সব মিলিয়ে আমার পড়া সকল কবিতার মধ্যে এই রকম কাব্যময় কথা খুব কমই পড়েছি আমি। পড়লেও স্মরণে রাখতে পারিনি। মানুষের জীবনে আশাহীন অন্ধকার সময় অবশ্যই আসে। এবং তা যে একবার আসে তা নয়। আমি নিশ্চিত, যে আমাদের সকলের জীবনেই বেশ কয়েকবার আসে। তবুও এই হঠাৎ দেখার মতো আনন্দদায়ক কোন একটি মুহূর্তের অপেক্ষায় আমরা অবলীলায় কাটিয়ে দিই কয়েক দশকের জীবন। আমার নাট্য জীবনের ৪৬ বছর পেরিয়ে গেল চোখের পলকে। এরই মাঝে অনেক কাজ, অকাজ করেছি আমি বিভিন্ন মাধ্যমে। আমার অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধি এই বলে যে কাজ যা হয়েছে তা মঞ্চেই হয়েছে। এর বাইরে বেশির ভাগই হয়েছে অকাজ। এ নিয়ে বিস্তর তর্ক হতে পারে তবে যেহেতু অনুভূতিটা আমার নিজস্ব, সেহেতু আমার বোধটাই আশা করি সবচেয়ে বেশি অগ্রগণ্য। ’৭২ এ একটা খ-কালীন নাটক করেছিলাম মঞ্চে। নাটকটি ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’। নির্দেশনায় ছিলেন আতাউর রহমান। এরপরেই আমার উপরে দায়িত্ব বর্তায় নাগরিকের পরবর্তী মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দেয়ার। আমাদের দলের তখনকার সদস্য বন্ধুবর গোলাম রাব্বানী আমাকে বাদল সরকারের ’বাকি ইতিহাস’ নাটকটি পড়ে দেখতে বলেন। নাটকটি এতই হৃদয়গ্রাহী ছিল যে এটি নির্দেশনা না দেয়ার কোন কারণই থাকতে পারে না। অতএব দ্রুত কাজ শুরু হলো। ৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩, বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন বলে সবাই মনে করেন। ওই দিন থেকে বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের শুরু। নাটক বাকি ইতিহাস, নাট্যকার বাদল সরকার, নির্দেশক আলী যাকের। সেই যে শুরু হয়ে গেল সেই ’৭৩ এ, তখন থেকে এই পর্যন্ত অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। অথচ মনেই হয়নি কিভাবে এই প্রচুর সময় পার করে দিয়েছি। আমি নিশ্চিত যে আমার এই গ্রন্থেই ধারাবাহিকভাবে আমি উল্লেখ করেছি আমার নাট্য তালিকা। কিন্তু তবুও মনে হয় কিছু বাকি থেকে গেল কি? সেজন্য আবারও তুলে দিই সেই তালিকাটি আমার পাঠকদের জানার জন্যে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি মঞ্চে আমার প্রথম নির্দেশনা বাকি ইতিহাস (১৯৭৩), নাট্যকার ছিলেন বাদল সরকার। এটি একটি মৌলিক নাটক ছিল। একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ এ মলিয়ের রচিত ’দ্য ইন্টেলেকচ্যুয়াল লেডিজ’ আমি বাংলায় রূপান্তর করি ’বিদগ্ধ রমনীকুল’ শিরোনামে। এবং রশিদ হায়দার রচিত মৌলিক নাটক ‘তৈল সংকট’ নিয়ে যুথবদ্ধ নাটক বিদগ্ধ রমনীকুল ও তৈল সংকট নির্দেশনা দিই আমি। ওই বছর (১৯৭৩), আমার সর্বশেষ রূপান্তরিত এবং নির্দেশিত নাটক ছিল এডওয়ার্ড এ্যালবি রচিত ’এভরিথিং ইন দ্য গার্ডেন’ অবলম্বনে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে। একইভাবে মঞ্চে আমার রূপান্তরিত এবং নির্দেশিত নাটকগুলো হলো : বের্টল্ট ব্রেশ্ট রচিত ‘গুড উওমেন অব সেটজুয়ান’ অবলম্বনে সৎ মানুষের খোঁজে (১৯৭৫), কার্ল স্যুখমায়ার রচিত ’ক্যাপ্টেন অব কোপেনিক’ অবলম্বনে কোপেনিকের ক্যাপ্টেন (১৯৮১), উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ’হ্যামলেট’ অবলম্বনে দর্পণ (১৯৯১) এবং আন্তন চেখভের ’দ্য চেরী অর্চার্ড’ অবলম্বনে কাঁঠাল বাগান (২০০৯)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অচলায়তন (১৯৮০) এবং সৈয়দ শামসুল হক রচিত নূরলদীনের সারাজীবন (১৯৮৩) এবং খাট্টা তামাশা (১৯৯৫), উৎপল দত্তের ছায়ানট (২০০৫) মঞ্চে এসেছিল আমার নির্দেশনায়। বলা বাহুল্য যে শেষোক্ত চারটি নাটকই ছিল মৌলিক নাটক। অভিনয় করে অপার আনন্দ পেয়েছি বাকি ইতিহাস (১৯৭৩), এই নিষিদ্ধ পল্লীতে (১৯৭৩), ভেঁপুতে বেহাগ (১৯৭৪), দেওয়ান গাজীর কিস্সা (১৯৭৭), সাজাহান (১৯৭৯), নুরলদীনের সারাজীবন (১৯৮৩), ম্যাকবেথ (১৯৮৩), ছায়ানট (২০০৫) এবং কাঁঠাল বাগান (২০০৯) নাটকে। এখানে উল্লেখ্য যে, ’ম্যাকবেথ’ নাটকটি ছিল ক্রিস্টোফার স্যান্ডফোর্ডের নির্দেশনায় থিয়েটার এর সঙ্গে নাগরিকের একটি যৌথ প্রযোজনা। ’দেওয়ান গাজীর কিস্সা’ নাটকে দেওয়ান গাজী এবং ’নুরলদীনের সারাজীবন’ নাটকে নুরলদীন চরিত্রে অভিনয় করতে পারাটা আমার অভিনয় জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। এখানে বিশেষভাবে আমি উল্লেখ করতে চাই গ্যালিলিও নাটকের কথা যেখানে গ্যালিলিও চরিত্রে আমি অভিনয় করি। নাটকটি প্রথম মঞ্চায়ন হয় ১৯৮৮ সালে। বের্টল্ট ব্রেশটের ’দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও’ অবলম্বনে এটি বাংলায় রূপান্তর করেন আব্দুস সেলিম এবং নির্দেশনা দেন আতাউর রহমান। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নাটকটি নিয়মিত মঞ্চায়ন করে নাগরিক। এরপর দীর্ঘ ২০ বছরের বিরতি। অতঃপর ২০১৮ সালের ৫ অক্টোবর নাটকটি নতুন রূপে পুনঃমঞ্চায়ন হয় পান্থ শাহ্রিয়ার এর নির্দেশনায়। আবারও মঞ্চে ’গ্যালিলিও’ রূপে ফিরি আমি। নাটকটি এবং নাটকের ’গ্যালিলিও’ চরিত্রটি তখন এবং এখন সব সময়ই আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। তাই এই নাটকের প্রতি এবং গ্যালিলিও চরিত্রটির প্রতি আমার বিশেষ ভালবাসা এবং দুর্বলতার কথা লুকালাম না আমি। ঢাকার মঞ্চে প্রতিদিন দুটি কি তিনটি নাটক অভিনিত হচ্ছে, এটি একটি বিশাল তাৎপর্য বহন করে। যে দেশ বা অঞ্চলে কালেভদ্রে পূজোয় কি ঈদে অথবা অফিসে কর্মচারীদের মনোরঞ্জনের জন্য নাটক হতো সেইখানে নাটক হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি নিয়মিত চর্চিত শিল্পমাধ্যম। আমি নিশ্চিত যে এটাই সব পাওয়া নয়। তবুও একটা বলিষ্ঠ সূচনা তো বটেই? এরপর আজকের নব প্রজন্মের নাট্যজনেরা নাটককে ছড়িয়ে দেবেন বাংলাদেশের সর্বত্র। সৃষ্টি হবে আরও অনেক নাট্য কেন্দ্রের। এইটিই আশা রাখি। এবং নাটক কেবল রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবেই নয়, জীবন বা জীবন দর্শনের অভিব্যক্তি হিসেবেও চর্চিত হবে। ওপরে উল্লিখিত আমাদের মঞ্চায়িত নাটকের তালিকা থেকে বোঝা সম্ভব হবে যে বিশ্বের অনেক প্রখ্যাত নাট্যকারের নাটক আমরা বাংলার মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্যভাবে মঞ্চে এনেছি। দুঃখ কেবল একটাই যে আমাদের তালিকায় মৌলিক নাটকের সংখ্যা নগণ্য। এই জন্য আমার দল নাগরিককে অপবাদ দেয়া হয়। ঠাট্টা করে ডাকা হয় ’সাহেব গ্রুপ’ বলে। কিন্তু কেউ এই বিষয়ে ভাবেন না যে ভাল নাটক লেখা না হলে তা মঞ্চে নিয়ে আসার কোন বৈধ কারণ কি আছে? আমার জানা মতে বাংলায় রচিত বাংলাদেশী নাটকের তিন চারটিকে বাদ দিলে বাকি সবই কেবল আমাদের ত্বক স্পর্শ করে যায়। আত্মাকে স্পর্শ করে না। এ যেন আমাদের অসম্পূর্ণ এবং অপরিণত শিক্ষা ব্যবস্থারই মতো। আমরা লেখাপড়া শেষ করি জীবনটাকে চালিয়ে নেবার মতো একটি চাকরির জন্যেই। শিক্ষা দিয়ে যে জীবনের গভীরে প্রবেশ করা যায় সে সম্বন্ধে ভাবা দরকারি বলেও মনে করি না কখনও। অথচ এটাই হওয়ার কথা ছিল আমাদের এই দেশে, যার জন্ম একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। এবং যে যুদ্ধের পেছনে লক্ষ্য ছিল নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা। কেমন যেন গ্লানিবোধ হয় যখন ভাবি যে আমি এবং আমরা কত অল্প পড়াশোনা করে কত সহজেই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছি এবং যাচ্ছি। এর কারণ অনুধাবন করা খুব কষ্টকর নয়। সদ্য স্বাধীন একটা দেশে জীবন ধারণের জন্য বিভিন্ন কাজ করার মানুষের অভাব হেতু আমরা সকলেই একটা সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম। একটি প্রতিযোগিতামূলক সমাজে যেটি হয়তো সম্ভব হতো না। আমি যদি আমাদের পাশের শহর কলকাতার দিকেই তাকাই তাহলে দেখব যে সেখানে আমার চেয়েও অনেক মেধা সম্পন্ন মানুষ স্বীকৃতির দিক দিয়ে আমার অনেক পেছনে পড়ে আছেন। এর কারন একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে তাদের ক্রমাগত প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে নিজস্ব স্বীকৃতি লাভের জন্য। এই বিষয়টিকে আমরা ছোট করে না দেখে যদি সত্যিকার অর্থে চেষ্টা চালিয়ে যাই আরও নিবিড় মেধা উদ্বুদ্ধ কাজকর্ম করতে তাহলে হয়ত আমরা যেমন শীর্ষে পৌঁছুতে পারব, তেমনি আমাদের সমাজ এবং দেশটিও মেধা সম্পন্ন দেশ হিসেবে আরও বেশি উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং কেবল তখনই আমরা একটা প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থায় বিশ্বকে মোকাবেলা করতে পারব। (চলবে)
×