ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এসেছে নবান্নের ঘ্রাণ

উত্তরের মরা কার্তিক আজ ভরা কার্তিকে পরিণত

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২৫ অক্টোবর ২০১৮

উত্তরের মরা কার্তিক আজ ভরা কার্তিকে পরিণত

তাহমিন হক ববি, নীলফামারী ॥ ‘হাতিকে ঠেলা যায়- কিন্তু কার্তিককে ঠেলা যায় না।’ ইতিহাসের সেই প্রবাদ বাক্যটি বর্তমানে হারিয়ে গেছে। বাংলা পঞ্জিকায় কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। এক সময় অভাবের মাস বলে খ্যাত ছিল কার্তিক। কার্তিক মাস এলেই উত্তরবঙ্গে বলা হলো এই এলো মরা কার্তিক। মানে কাজের অভাবে মানুষজন অভাবে পড়ত খাদ্যের অভাবে মানুষ মারা যেত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গত দশ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি খাতসহ বিভিন্ন সেক্টরের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে বেকারত্ব ঘুচিয়ে দেয়ায় ‘উত্তরের মরা কার্তিক আজ ভরা কার্তিকে পরিণত হয়েছে।’ হারিয়ে গেছে মরা কার্তিক- আর ওই প্রবাদ বাক্যটি বলতে আর শোনাও যায় না। কার্তিক যেন হয়ে এসেছে নতুন ধানের নবান্নের ঘ্রাণ। নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলি ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি গ্রামের কৃষক আলম হোসেন বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই আমাদের কাছে শ্রেষ্ঠ জাদুকর। তিনি টানা দশ বছর ক্ষমতায় থেকে কৃষি খাতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এমন সরকার প্রধান আমাদের সারা জীবনের জন্য প্রয়োজন। গ্রামীণ জনপদে বইছে এখন উৎসবের আমেজ। গ্রামে যাদের শিকড় কেবল তারাই এ উৎসবের মর্মার্থ অনুধাবনে সক্ষম। নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দই আলাদা। এ সময় কৃষকদের চোখে ভাসতে দেখা যায় হাসির ঝিলিক। মাঠে এখন সোনারঙা ধানের ছড়াছড়ি।সর্বত্র হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে কার্তিকেই নবান্নের সুর। সব কৃষক প্রাণেই যেন এক অফুরান আনন্দ বিরাজমান। কিশোরীগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম (৪৭) বলেন, মঙ্গা দূরীকরণে শেখ হাসিনা আমাদের কাছে মহান। তার কারণেই আজ কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় আমন ধানে স্বল্পমেয়াদী জাতের উদ্ভাবন ও দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে কার্তিক মাসেই কৃষকের ঘরে উঠছে সোনালী ধান। স্বল্পমেয়াদী ধান চাষের ফলে সঠিক সময়ে গম, আলু বা সরিষা আবাদ করতে পারছি কৃষকরা। তিনি বলেন, আমনের উচ্চ ফলনশীল ও খরাসহিষ্ণু ধান কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। এ দিকে নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আগাম জাতের আমন ধান কাটা, মাড়াইয়ের পাশাপাশি সেই জমিতে কৃষকরা আগাম আলু আবাদে মেতে উঠেছে। আর এসব কৃষি কাজের সুযোগ পেয়ে কিষান কিষানিরাও আনন্দে আত্মহারা। কাজ আর কাজ। হাতে কাজ মানে হাতে নগদ অর্থ। দশ বছর আগের সেই মরা কার্তিকের অভাব সকলেই ভুলে গেছে। অনুকূল আবহাওয়া, বীজ ও সারের দাম কম এবং সার সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ায় কৃষকরা এখন কৃষিতে মনোযোগী । সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বল্প মেয়াদী আগাম জাতের আমন ধান আবাদ করে ধান কাটা এবং মাড়াই শেষে তারা বিভিন্ন জাতের আলু আবাদের জন্য কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়ে। এ জেলার, বিশেষ করে জেলা সদর, ডোমার, কিশোরীগঞ্জ, জলঢাকা উপজেলাজুড়ে ব্যাপক আগাম আলু আবাদ চলছে। কৃষক ও কামলা কিষান এ নিয়ে মহাব্যস্ত সময় পার করছে। কিশোরীগঞ্জ উপজেলার নিতাই ইউনিয়নের গাংবের গ্রামের কৃষক আবুল কালাম আজাদ (৬০) বলেন, আগাম জাতের আমন ধান আবাদ করেছি। সেই জমির ধান কেটে সেখানে আগাম জাতের আলু চাষ করছি। আলু বীজের দাম কম, সার সঙ্কট নেই। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি কৃষক মঙ্গা দূরীকরণে স্বল্প মেয়াদী ধান আবাদ করে সেখানে আলু চাষ করছে। পানিয়ালপুকুর এলাকার কৃষক মোছারুল (৪৫) বললেন, অন্যান্য বছরের নতুন এবার আগাম আমন ধানের মতো আলু আবাদও বিপ্লব ঘটাবে। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা আগাম জাতের গ্রানুলা, সেভেন জাতের আলুই বেশি লাগাচ্ছে। কৃষি শ্রমিক জিয়ারুল, শাবুল, বেলাল, টিটো, জহুরুল, খোকন, মানিক, গোলাপ, রঞ্জিত বলেন, আগাম জাতের আমন ধান কাটার পর তারা এখন আলুক্ষেতে কাজ করে পারিশ্রমিক পাচ্ছেন ৪০০ টাকা। উত্তরের রংপুর কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় আমন ধানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ৯৪ হাজার ১৮৪ হেক্টর জমিতে। সেখানে অর্জিত হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৪৭৬ হেক্টরে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ হাজার ২৯২ হেক্টর জমিতে বেশি আমন ধান আবাদ হয়েছে। এ ছাড়া স্বল্পমেয়াদী ধানের আবাদ হয়েছে ৬১ হাজার ১২ হেক্টর জমিতে। আগাম এই ধান কর্তন শেষে এখন ওই জমিতে আবাদ চলছে আগাম গম,আলু, সরিষা, শাক সবজি। যা কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। এদিকে কৃষি বিভাগ এখনও চলতি বছরের আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেনি। তবে কৃষকরা এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু লাগানোর কাজ শেষ করেছে। অন্যান্য কৃষকরা আলু আবাদে জমি তৈরি করে কাজ করছে। নীলফামারী কৃষি বিভাগের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলায় এবার স্বল্পমেয়াদী আমন আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ১৮৯ হেক্টর জমিতে। বুধবার পর্যন্ত ১১ হাজার ৩৪৩ হেক্টর জমির ধান কাটাই- মাড়াই শেষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে এখানকার কৃষক এবার আলু আবাদে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষে তাদের সহায়তা প্রদান করে আলু আবাদ এবার এ জেলায় বিপ্লব ঘটাতে সহায়ক হবে বলে তিনি মনে করছেন।
×