ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তফসিলের আগে সংলাপ চায় বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৫ অক্টোবর ২০১৮

তফসিলের আগে সংলাপ চায় বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিলের আগে সরকারের সঙ্গে সংলাপ চায় বিএনপি। এ জন্য দলটি বিভিন্নভাবে চেষ্টা তদ্বির চালাচ্ছে। দলগত হোক বা নতুন রাজনৈতিক জোট ঐক্যফ্রন্টের মাধ্যমে হোক; সরকারের সঙ্গে সংলাপ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিদেশী কূটনীতিকদের দিয়েও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তারপরও সরকারের সঙ্গে সংলাপ করার সুযোগ না হলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত করে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে দল বা ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব পেশ করার প্রস্তুতি রয়েছে। জানা যায়, ইতোমধ্যেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ থেকে বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের কাছে কিছু দাবি পেশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা ইত্যাদি। ১৩ অক্টোবর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর এ জোটের পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে প্রায় একই ধরনের দাবি পেশ করা হয়েছে। আর এসব দাবি আদায়ে ইতোমধ্যেই সিলেটে সমাবেশ করেছে ঐক্যফ্রন্ট। এর পর চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে তাদের সমাবেশ করার কথা রয়েছে। এদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবশে সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি বিদেশী কূটনীতিক ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে বিএনপি। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর এ জোটের পক্ষ থেকেও বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকও করা হয়েছে। বৈঠকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কি কি করা উচিত তা তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তীতে আরও বৈঠক করার পরিকল্পনাও রয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনও তার অবস্থান থেকে বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলে জানা গেছে। সরকারের সঙ্গে বিএনপির সংলাপ করার আগ্রহ দেখে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের পাশাপাশি কোন কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করার কথা বলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ করার বিষয়েও তাগিদ দেয়া হচ্ছে। এসব দেখে বিএনপির সিনিয়র নেতারা সংলাপের বিষয়ে আরও বেশি আশাবাদী হয়ে উঠছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, দেশে এমন অবস্থা সৃষ্টি করা হবে যে সরকার শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করতে বাধ্য হবে। অপর এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সঙ্কট নিরসনে সংলাপের কোন বিকল্প নেই। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব সরকার সংলাপের ব্যবস্থা করুক। এদিকে কোন কারণে সরকারের সঙ্গে সংলাপ করা সম্ভব না হলে বিএনপি এককভাবে অথবা ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করবেন। এ সময় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরা হবে। এ জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাব প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে ইতোমধ্যে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে দেয়া দাবিগুলোও থাকবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশের যে কোন সমস্যা সমাধানে সংলাপের কোন বিকল্প নেই। সংলাপ হলে অনেক কিছুরই সমাধান সম্ভব। কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন ধরে সংলাপের কথা বললেও সরকার এ বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছে না। আমরা আশা করছি, তফসিলের আগে সরকার সংলাপের ব্যবস্থা করবে। তা না হলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আমরা আমাদের করনীয় ঠিক করব। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো দেশে আর কোন নির্বাচন হতে দেবে না বিএনপি। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, নবেম্বরের প্রথম সপ্তায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত। তফসিলের পর রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে নির্বাচন কমিশন একটি সংলাপের আয়োজন করবে। তা না হলে আরপিও ও সংবিধান অনুসারে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এর বাইরে কোন রাজনৈতিক দলের দাবিদাওয়া পূরণের কোন সুযোগ নির্বাচন কমিশনের নেই। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ইতোমধ্যে বিএনপি ৭ দফা দাবি পেশ করে তা আদায় না হলে কোন অবস্থাতেই নির্বাচনে যাবে না বলে দলের পক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হলেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে। সংবিধান অনুসারে বর্তমান সরকারের অধীনেই যে নির্বাচন হবে সেটি দলের নেতাকর্মীদের চিন্তায় রয়েছে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকার যদি ন্যূনতম পদক্ষেপ নিয়েও দলের নেতাকর্মীদের আস্থায় আনতে পারে তাহলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। আর তা না হলে নির্বাচনের বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্তের দিকেই তাদের যেতে হবে। তবে সংলাপের মাধ্যমে বিএনপির দু’একটি দাবি মেনে নিলেও তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে চায়। সূত্র মতে, বিএনপির পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা এবং দেশ-বিদেশে যারা শুভাকাক্সক্ষী রয়েছে তারা সবাই চায় বিএনপি যেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন বর্জনের মতো এবার কিছু না করে। যে করেই হোক মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত হলে যেন বিএনপি নির্বাচনে যায়। কারণ, এবার নির্বাচন বর্জন করলে দলটি রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি বেকায়দায় পড়বে। আর এ কারণেই বিএনপি সরকারের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশের নিশ্চয়তার জন্য দৌড়ঝাঁপ চালাচ্ছে। জানা যায়, অতীত কর্মকা-ের জন্য সমালোচনাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের চাপে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আপাতত দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করেছে বিএনপি। আর এ কারণে এবারই প্রথম জামায়াতকে ছাড়া সম্প্রতি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে দলটি। এ ছাড়া বাহ্যিকভাবে জামায়াতের সঙ্গে কৌশলে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক জোট ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছে বিএনপি। তবে নির্বাচনের আগে যে কোন কৌশলে আবারও বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে মিলে কাজ করবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। জানা যায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ক’জন সিনিয়র নেতা ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া প্রতিমাসে অন্তত একবার বিদেশী কূটনীতিকদের একসঙ্গে জড়ো করে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। এর বাইরে দলের ক’জন নেতা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য সহযোগিতা চান। এমনকি বিএনপি মহাসচিব জাতিসংঘ ও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে গিয়েও যোগাযোগ করে এসেছেন। এর মাধ্যমে সরকারকে শেষ পর্যন্ত বিএনপির বিষয়ে কঠোর অবস্থানের বদলে কিছুটা হলেও নমনীয় করা যাবে বলে দলটির নেতাকর্মীরা আশা করছে। দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার চেষ্টা করা হলেও খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর এ তৎপরতা আরও গতিশীল করে বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানসহ ক’জন সিনিয়র নেতা এবং ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এ কূটনৈতিক তৎপরতায় সক্রিয় থেকে ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের লন্ডন প্রবাসী ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিভিন্ন মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে সচেষ্ট রয়েছেন। এ জন্য তিনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের দলীয় শাখা কমিটির নেতাদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, নির্বাচনের আগে রাজপথে আন্দোলন করে খুব একটা সুবিধা করা যাবে না এমন ধারণা থেকেই কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, তফসিলের আগে সরকার বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করবে। তা না হলে তফসিল ঘোষণার পর সরকার নানামুখী চাপে পড়বে এবং সংলাপ করতে বাধ্য হবে। আর সংলাপ হলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ কিছুটা হলেও ভাল হবে।
×