ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আজও স্বপ্ন দেখায় অক্টোবর বিপ্লব

শতবর্ষ আগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, শোষণহীন শ্রেণীহীন সমাজের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৫ অক্টোবর ২০১৮

শতবর্ষ আগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, শোষণহীন শ্রেণীহীন সমাজের প্রত্যাশা

মোরসালিন মিজান ॥ পৃথিবী শুধু এর হবে না। ওর হবে না শুধু। সবার, সব মানুষের হবে। কোন ধরনের শোষণ নয়। বঞ্চনা নয়। শ্রেণীহীন সমাজের প্রত্যাশা। যে যার অধিকার বুঝে পাবে। এসব শুভ সুন্দর প্রত্যাশা নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল সাধারণ মানুষ। অভূতপূর্ব গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এবং তা এই অক্টোবর মাসেই। আজ বৃহস্পতিবার ২৫ অক্টোবর। ঐতিহাসিক রুশ বিপ্লবের আলোকোজ্জ্বল দিন। শতবর্ষ আগে সাত সমুদ্র তেরো নদী দূরত্বে যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছিল বাংলাদেশেও। অল্প বিস্তর প্রভাব এখনও পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য সাম্প্রতিক কালে এসে পঞ্জিকার হিসাব কিছুটা বদলে গেছে। বর্তমানে অক্টোবর বিপ্লবের বার্ষিকী উদ্যাপন করা হয় ৭ নবেম্বর। জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে বিপ্লবের দিনটি ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর। গ্রেগারিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে দিনটি হয় একই বছরের ৭ নবেম্বর। এরপরও অক্টোবর এলে ঠিক মনে পড়ে যায় অক্টোবর বিপ্লবের কথা। এখন পুঁজির দাপট! টাকার দাসত্ব। শোষণ বেড়েছে। প্রতিনিয়ত বঞ্চনার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। শ্রমিক তার শ্রম দিচ্ছে। দিয়েই যাচ্ছে। উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। মালিক ফুলে উঠছে। ফেঁপে উঠছে শুধু। ফসল ফলাচ্ছে কৃষক, টাকা গুনছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। লুটেরার দল লুটেপুটে খাচ্ছে সব। অর্থনৈতিক মুক্তি মিলছে না মানুষের। এই যখন বাস্তবতা তখন অক্টোবর বিপ্লবের কথা কেনইবা মনে পড়বে না? অক্টোবর বিপ্লব বিপ্লবের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান আলোচনা। এর মধ্য দিয়ে নতুন এক দর্শনের সূচনা হয়েছিল। বঞ্চিত, শোষিত শ্রমিক শ্রেণী ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আপন শক্তিতে। এই দাঁড়ানো যে সে দাঁড়ানো নয়। উত্থান। যুদ্ধ জয়। প্রতিটি মানুষের সম অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে সত্যি করেছিল বলশেভিক বিপ্লব। রাশিয়ান বিপ্লবের দুটি ধাপ। প্রথম ধাপটি ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে রাশিয়ার সা¤্রাজ্যের পতন ঘটানো হয়। ক্ষমতাচ্যুত করা হয় শেষ স¤্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসকে। দায়িত্ব নেয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দ্বিতীয় ধাপটি ছিল অক্টোবর বিপ্লব। কমরেড লেনিন নেতৃত্ব দিয়ে এই সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যান। এর মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করে বলশেভিক বা কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে বিপ্লবের দিনটি ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর। অক্টোবর বিপ্লবের প্রাণ ছিল শ্রমিক শ্রেণী। হতদরিদ্র কৃষক শ্রেণী ছিল তাদের সঙ্গে। যুগ যুগ ধরে বুকে জমিয়ে রাখা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন তারা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১০ অক্টোবর লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ২৩ অক্টোবর বলশেভিক নেতা জ্যান আনভেল্টের নেতৃত্বে বামপন্থী বিপ্লবীরা বিক্ষোভ শুরু করে এস্তোনিয়ার রাজধানীতে। এর দু’দিন পর ছিল ঐতিহাসিক ২৫ অক্টোবর। এদিন লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবী রেড গার্ডস পেত্রোগার্দে বিক্ষোভ শুরু হয়। আর ৯টা ৪৫ মিনিটে যুদ্ধজাহাজ অরোরা থেকে ফাঁকা শেল নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে সূচনা করা হয় চূড়ান্ত আক্রমণের। অল্প সময়ের মধ্যে বিপ্লবীরা পেত্রোগার্দের গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোর দখলে নিতে সক্ষম হন। পরে অস্থায়ী সরকারের প্রধান দফতর উইন্টার প্যালেসের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন তারা। সহসাই এই প্যালেসের পতন হয়। একই সময় স্মোলনির সমাবেশ হলে পেত্রোগার্দ সোভিয়েতের জরুরী অধিবেশনে মহামতি লেনিন ঘোষণা করেনÑ ‘যে শ্রমিক ও কৃষক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার কথা বলশেভিকরা সর্বদা বলে এসেছে আজ তা ঘটল’। এভাবে ২৫ অক্টোবর লেখা হয় নতুন ইতিহাস। জয় পায় বিপ্লবীরা। প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিকদের শাসন। পতাকা ওড়ে সমাজতন্ত্রের। একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিপরীতে সাম্যের পৃথিবীর দাবি জোরালো হয়। দুনিয়াজুড়ে আলোড়ন তুলে অক্টোবর বিপ্লব। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্ব ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোও আকৃষ্ট হয়। তবে সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে অর্জনের অনেক কিছুই ম্লান হয়ে গেছে। ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে কিউবা, উত্তর কোরিয়া, চীন, লাওস, ভিয়েতনামের মতো কয়েকটি দেশই ভরসা। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর কোথাও সেভাবে দাঁড়াতে পারছে না। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, এই ব্যর্থতা সমাজতন্ত্রের নয়। অক্টোবর বিপ্লব হিটলারের ফ্যাসিবাদ থেকে বিশ্ব সভ্যতাকে রক্ষা করেছিল। একইসঙ্গে রুশ দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছিল মুক্তির পথ। তার বিশ্লেষণ মতে, পুঁজিবাদ মুনাফার জন্য সব ধরনের অন্যায় করতে পারে। সমাজতন্ত্র হচ্ছে সামাজিক মালিকানা। সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করে মনুষ্যত্বে। হ্যাঁ, এ কারণেই অক্টোবর বিপ্লব আশা জাগায়। স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখে। ঐতিহাসিক অর্জনের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। ফের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে পৃথিবী। পুঁজির কাছে নত হয়েছে। প্রতিদিনের জীবন, দর্শন সবকিছুই পুঁজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশেও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম সেই আগের মতো নেই। তবে অক্টোবর বিপ্লবের চেতনা বুকে বাঁচিয়ে রেখেছেন অগনিত মুক্তিকামী মানুষ। সকলের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এই চেতনা জাগ্রত থাকবে- সকলের তাই প্রত্যাশা।
×