ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশী বিনিয়োগে উল্লম্ফন

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৫ অক্টোবর ২০১৮

বিদেশী বিনিয়োগে উল্লম্ফন

রহিম শেখ ॥ চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই রেকর্ড পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। প্রস্তাব আসছে জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। বিনিয়োগের এমন উল্লম্ফনে নতুন আশার সঞ্চার করছে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো। বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জাপানের নিপ্পন স্টিল, হোন্ডা থেকে শুরু করে চীনের কুনমিং আয়রন এ্যান্ড স্টিল, হোল্ডিং গ্রুপের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। শুধু প্রস্তাব নয়, বিনিয়োগের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে জমি ইজারাও নিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে বেসরকারী ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত কারখানায় ইতোমধ্যে উৎপাদনও শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে যে সম্ভাবনার সূচনা হয়েছে, তাকে শিল্পায়নের নতুন যাত্রা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বেজার হিসাব অনুযায়ী, সরকারী তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতোমধ্যে প্রায় ১ হাজার ৬৩১ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার সমান। এসব বিনিয়োগের বেশির ভাগই বিদেশী। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এক দরজায় সব সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করবে। এসব কারণে বাংলাদেশের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে, যার সিংহভাগ অর্থনৈতিক অঞ্চলে। আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে যে সম্ভাবনার সূচনা হয়েছে, তাকে শিল্পায়নের নতুন যাত্রা বলছি। বেজা জানায়, দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১০ সালে পাস হয় ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস আইন-২০১০’। এরপরেই গঠন করা হয় অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে থাকা বেজার গবর্নিং বোর্ড এখন পর্যন্ত ৮২টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে সরকারী ৫৪টি, বেসরকারী ২৩টি এবং চীন, জাপান ও ভারতের জন্য চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবে বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। বেজা আপাতত চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীকে ঘিরে ৩০ হাজার একর জমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর গড়ে তোলা ও মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বেশি জোর দিচ্ছে। মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট ইকোনমিক জোন, বাগেরহাটের মোংলা ইকোনমিক জোন এবং চীন, জাপান ও ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলেও দ্রুত কাজ এগিয়ে চলছে। এর মধ্যে শ্রীহট্টে বিনিয়োগকারীদের জমি বরাদ্দ শেষ। মিরসরাই, মহেশখালীতে ও মোংলায় জমি বরাদ্দ চলছে। বেসরকারী ২৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে ৭টি চূড়ান্ত লাইসেন্স পেয়ে গেছে উদ্যোক্তারা। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পশহর ও শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে আগামী বছরের শেষ দিকে কারখানা উৎপাদনে যাবে আশা করা যায়। বেসরকারী ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতোমধ্যে পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছে। জাপান ও চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০২১ সালে কারখানা চালু হবে। জাপানী বিনিয়োগের আগ্রহের কথা তুলে ধরে পবন চৌধুরী বলেন, শুধু জাপানী বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, এটা চিন্তাও করা যায়নি। এখন জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চলই দেশের জন্য ‘গেম চেঞ্জারের’ ভূমিকা পালন করবে। বেজার তৈরি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ৩৯টি বিনিয়োগ প্রস্তাবের বিপরীতে ৩ হাজার ৫৩৭ একর জমি বরাদ্দ দেয়া শেষ হয়েছে। এতে কোম্পানিগুলো ১ হাজার ৪৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বার্জার পেইন্ট, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, সামিট এ্যালায়েন্স লজিস্টিক পার্কসহ ১০টি কোম্পানিকে ৩৫০ একর জমি বরাদ্দের অনুমোদন দিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করবে ১৯৮ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিনিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে ১ হাজার ২৪৫ কোটি ডলারের। শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে পোশাক খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপ, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও ডাবল গ্লেজিং নামের একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে ২৩১ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে বেজা। এসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করবে ১৩৮ কোটি ডলার। মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২৪৮ কোটি ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে ৫১০ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। জানা যায়, বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জাপানের নিপ্পন স্টিল এ্যান্ড সুমিতমো মেটাল বাংলাদেশের ইস্পাত খাতে বিনিয়োগ করছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর নিপ্পনের পরিচালক নমুরা ইউচি ঢাকায় এসে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে ১০০ একর জমি ইজারা নেয়ার চুক্তি করেছেন। যৌথ বিনিয়োগে নিপ্পনের ইস্পাত কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হবে চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে। আবার দুই মাসের মধ্যেই ঢাকার রাস্তায় নামবে দেশে উৎপাদিত হোন্ডা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল। বিশ্বের শীর্ষ মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জাপানের হোন্ডা মোটর কর্পোরেশন বেসরকারী আবদুল মোনেম ইকোনমিক জোনে ২৫ একর জমিতে কারখানা করেছে। নিপ্পন স্টিল ও হোন্ডার চেয়েও বড় প্রস্তাব দিয়েছে জাপানের সজিত কর্পোরেশন। তারা মিরসরাইয়ে শিল্প পার্ক করার জন্য ১ হাজার একর জমি চেয়েছে। চীনারা আরও এগিয়ে। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কুনমিং আয়রন এ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেড ইস্পাতশিল্পে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। ২০ লাখ টন উৎপাদন ক্ষমতার একটি ইস্পাত কারখানা, বিদ্যুতকেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। এ জন্য প্রায় ১ হাজার একর জমি ইজারার আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশে তাদের অংশীদার হচ্ছে ১৭ কোম্পানির জোট স্টার কনসোর্টিয়াম। চীনের আরেক বড় প্রতিষ্ঠান ঝেজিয়াং জিনজুন হোল্ডিং গ্রুপ মিরসরাইয়ে বিদ্যুতকেন্দ্র করার জন্য ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। এ জন্য ১ হাজার একর জমি ইজারা নিয়ে মূল্যের প্রথম কিস্তি ৭ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধও করেছে। মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স ও এলএনজি টার্মিনাল প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ করছে দক্ষিণ কোরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম কোম্পানি এস কে গ্যাস। বাংলাদেশে তাদের অংশীদার টি কে গ্রুপ। তারা বিনিয়োগ করবে ২৩৯ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এ জন্য ৪১০ একর জমি বরাদ্দ নিয়েছে তারা। এর বাইরে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারত ও যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি চেয়েছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০১৮ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৭ সালে মাত্র ২১৬ কোটি ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ পেয়েছে, যা প্রতিবেশী ও সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় নগণ্য। আলোচ্য বছর মিয়ানমারও ৪৩০ কোটি ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ পায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১ সালে মধ্যম ও ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য পূরণে বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ দরকার। এর মধ্যে শুধু বিদেশী বিনিয়োগই দরকার হবে বছরে ১ হাজার কোটি ডলার। এজন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি বিদ্যমান গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাব, অবকাঠামো সমস্যা, জমি সঙ্কট, দলিলপত্র প্রক্রিয়াকরণে অনিয়ম ও দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করছেন তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নিজ দেশের বাইরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশীরা অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ডুইং বিজনেস সূচক, ব্যবসার ছাড়পত্র, জমি ও শ্রমের সহজলভ্যতা অন্যতম। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে নিট বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ১৪১ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা)। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছিল ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিদেশী বিনিয়োগ বেশি এসেছে ৪২ কোটি ৮৮ লাখ ডলার বা ৪৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসের চেয়েও এ সময়ে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে; বৃদ্ধির হার প্রায় সাড়ে ২১ শতাংশ। গত বছরের শেষ ছয় মাসে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসে ১১৬ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে যে পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে তার মধ্যে নতুন বিনিয়োগ বা ইক্যুইটি মূলধন রয়েছে ৩৩ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে এর পরিমাণ ছিল ২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ সময়ে বহুজাতিক কোম্পানির পুনর্বিনিয়োগ হিসেবে এসেছে ৬১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। ২০১৭ সালের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৬৪ কোটি ২৯ লাখ ডলার। এছাড়া প্রথম ছয় মাসে আন্তঃকোম্পানি ঋণ হিসেবে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ৪৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৭ সালের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। চলতি বছরে যেসব দেশ থেকে বেশি বিনিয়োগ আসছে তার মধ্যে রয়েছেÑ চীন, যুক্তরাজ্য, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মরিশাস, মালেশিয়া, ইন্ডিয়া, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, নেদারল্যান্ডস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, বার্মুডা, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স ও সৌদি আরব অন্যতম। অন্যদিকে যেসব খাতে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে তার মধ্যে রয়েছেÑ বিদ্যুত, টেক্সটাইল এ্যান্ড ওয়েরিং, ব্যাংক, খাদ্য, বাণিজ্য, নির্মাণ, গ্যাস ও জ্বালানি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, টেলিকমিউনিকেশন, রাসায়নিক ও ওষুধ, বীমা, কম্পিউটার সফটওয়্যার ও আইটি, সার, সিমেন্ট এবং গাড়ি ও পরিবহন সামগ্রী অন্যতম।
×