ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রি অব সরো পেয়েছে নতুন প্রাণ

শরতের বেদনা ধুয়ে নিচ্ছে হেমন্তের শিশির

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২৪ অক্টোবর ২০১৮

শরতের বেদনা ধুয়ে নিচ্ছে হেমন্তের শিশির

মোরসালিন মিজান ॥ এবার একটু কি দেরি করেই ফুটলো শিউলি? শরতের ফুল। ঋতু শুরুর পর থেকেই আপন মনে খুঁজছি। শহর ঢাকায় যেসব গাছের অবস্থান জানি, কারণে অকারণে নিচ দিয়ে যাই, খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি, না, শিউলি তো নেই। মালা গেঁথে যে ছেলে মেয়েগুলো বিক্রির জন্য ছুটত, তাদের হাতে অন্য ফুল। তহালে কি শিউলির মিষ্টি ঘ্রাণ না নিয়েই ‘বাই’ বলতে হবে শরতকে? ভেবে যখন মন খারাপ হচ্ছে শুধু, ঠিক তখনই শিউলি ফোটার খবর পাওয়া গেল। শরতের একেবারে বিদায় লগ্নে শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে দেখা হলো শিউলির সঙ্গে। বাগানের মাটিতে অনেকগুলো ফুল উপুড় হয়ে পড়েছিল। কুড়িয়ে হাতের মুঠোয় নিতেই পরিচিত ঘ্রাণ। ¯িœগ্ধতা। মন সত্যি ভরে গেল। কত কিছুর জন্য ছোটাছুটি আমাদের। বড় বড় চাওয়া। অথচ পথের ধারে পড়ে থাকা সামান্য শিউলি দিনটাকেই কেমন বদলে দিল! সুন্দর করে দিল! অবশ্য তারও আগে ফুলটি দেখার কথা জানিয়েছেন দু’একজন। শরীর ঠিক রাখতে প্রতিদিন রমনা পার্কে যান এমন একজনের মতে, আশ্বিনের প্রথম ভাগে ফুলটি কাকে যেন কুড়াতে দেখেছেন তিনি। তার মানে, কোন কোন গাছে সময় মতো ফোটে থাকতে পারে। সে যাই হোক, এখন ফুলপ্রেমীরা শিউলির ঘ্রাণে বুঁদ হয়ে আছেন। হ্যাঁ, শরত বিদায় নিলেও ফুলটিকে উপহার হিসেবে হেমন্তের কাছে রেখে গেছে। নতুন ঋতু কী যে আদর দিয়ে আগলে রেখেছে শিউলিকে! শিশিরে জল দিয়ে প্রতিদিন ধুয়ে দিচ্ছে। সাদা ফুলের পাপড়িগুলোকে তাই আরও বেশি সাদা, আরও বেশি আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। শিউলির প্রধান বৈশিষ্ট্যÑ এটি রাতে ফোটে। সকাল হতে না হতেই ঝরে পড়ে যায়। এত সৌন্দর্য, এত যার ঘ্রাণ, তার কিনা এত ছোট জীবন? বিরহ কাতর সেই রাজকন্যার গল্পটি করা যাক। অপরূপ সুন্দরী দেখতে ছিলেন রাজকন্যা। তার রূপের কথা কী বলবো! বর্ণনা যে করবে, কার আছে সেই সাধ্য? সবাই তাকে চায়। চাইতো। কিন্তু রাজকন্যা মজেছিলেন সূর্যে। দূর আকাশে থাকা সূর্যকে তিনি সবটুকু দিয়ে ভালবেসেছিলেন। কিন্তু হায়, সূর্য বোঝে না! সূর্য থেকে যায় দূর আকাশে। অধরা। প্রত্যাখ্যাত হন রাজকন্যা। বুক ভেঙে খান খান হয়ে যায় তার। না পাওয়ার ব্যথা সইতে না পেরে নিজেকে নিঃশেষ করে দেন তিনি। বেছে নেন আত্মহননের পথ। পুরাণ বলে, শাস্ত্র মেনে দাহ করা হয় রাজকন্যাকে। কিন্তু কী আশ্চর্য! মৃত্যুতে শেষ হয় না সব। রাজকন্যার দেহভস্ম থেকে জন্ম নেয় একটি গাছ। গাছে চমৎকার ফুল ফুটে। তবে স্বল্প আয়ু। রাতে ফোটে। সকালে সূর্যের স্পর্শ পাওয়া মাত্রই গুটিয়ে নেয় নিজেকে। অশ্রুবিন্দুর মতো ঝরে যায়। রাজকন্যার নামে এই ফুলের নামকরণ করা হয় ‘পারিজাতিকা।’ পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, এ ফুল বেদনার প্রতীক। ব্যর্থ প্রেমের আলেখ্য। সাদা সুগন্ধী ফুল পারিজাত, পারিজাতা, পারিজাতাকা নামেও পরিচিত। প্রচলিত অন্য নামগুলোর মধ্যে রয়েছে শেফালি, শেফালিকা, নাইট ফ্লাওয়ার জেসমিন, হারসিঙ্গার, কোরাল জেসমিন, রাগাপুষ্পি, খারাপাত্রাকা ও প্রজক্তা। তবে যে নামটি বললে চট করে চিনে ফেলা যায় সেটিÑ শিউলি। এই নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি। এর বৈজ্ঞানিক নাম নিক্টান্থেস আরবর-ট্রিসটিস। ল্যাটিন শব্দ নিক্টান্থেস অর্থ সন্ধ্যায় ফোটা। আরবর-ট্রিসটিস হচ্ছে বিষণœ গাছ। চোখ জোড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে জন্মাবার পরও অল্প সময় বেঁচে থাকে বলে এমন নামকরণ। একই কারণে শিউলি গাছকে বলা হয় ট্রি অব সরো। দেশের বিভিন্ন স্থানে আছে শিউলি গাছ। পরিমাণে খুব বেশি হবে নয়। তবে আছে। এর যেমন সৌন্দর্য, তেমনি মিষ্টি ঘ্রাণ। এ কারণে বহুকাল ধরে সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে শিউলী। কবি, সাহিত্যিক শিল্পীরা বরাবরই বিশেষ ভালবাসা দেখিয়েছেন শিউলির জন্য। কবিতা, গান, নাটক, চলচ্চিত্র সর্বত্রই এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাণের আরেকটি গল্প উল্লেখ করা যেতে পারে। উল্লেখ করার মতো। গল্পটি এরকমÑ কৃষ্ণের দুই স্ত্রী সত্যভামা ও রক্তকমিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগান পারিজাতের ঘ্রাণে ভরে উঠুক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা! তবুও কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন তিনি। এর ফুল রক্তমিণীর বাগানেও ঝরে পড়ে সুগন্ধ ছড়ায়। এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র তো ঘটনা জেনে ভীষণ রেগে যান। তিনি বিষ্ণু অবতারের ওপর গোপনে ক্রুদ্ধ ছিলেন। এ কারণে কৃষ্ণকে শাপ দেন, কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই। কোনদিন ফল আসবে না, তার বীজে কখনও নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না। ঘটনা তাই ঘটেছিল কিনা, সেটি অন্য আলোচনা। তবে শিউলির মতো চমৎকার একটি ফুল ঠিকই পাওয়া হয়েছিল। কবিতায় আসা যাক। শিউলির কথা বেশি এসেছে নজরুলের কবিতায়। সকালে সবুজ ঘাসের ওপর অজ¯্র শিউলি পড়ে থাকে। কবি একে বলেছিলেন ‘শিউলি-বিছানো পথে’। বিরহের কথা ব্যক্ত করতে গিয়েও শিউলিকে আশ্রয় করেছেন তিনি। লিখেছেনÑ শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই...। অন্যত্র লিখেছেনÑ দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...। অভিন্ন দৃশ্য দেখে কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘শিউলিতলার পাশে পাশে/ঝরা ফুলের রাশে রাশে/শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে/অরুণ-রাঙা-চরণ ফেলে/নয়ন-ভুলানো এলে...।’ নয়ন-ভুলানো ফুল অবশ্য বেশি সময় পরে থাকে না। চোখের সামনেই কুড়িয়ে নিয়ে যায় ছিন্নমূল শিশুরা। চোখে মুখে ধরা পড়ার ভয়। কিন্তু মুঠো ভর্তি করে তবেই গাছতলা ত্যাগ করে তারা। এদের দেখে মন গুন গুন করে গেয়ে ওঠেÑ শিউলি তলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা...। গ্রমে মেয়েরা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে শিউলি কুড়োতে যায়। আঁচল ভর্তি ফুল থেকে একটি একটি করে নিয়ে মালা গাঁথে তারা। খোঁপা সাজায়। রাজধানী শহরেও প্রচুর বিকোয় শিউলি ফুলের মালা। দূরন্ত ছেলে মেয়েদের ‘মালা কিনবেন আপা’ আহ্বানে সারা না দিয়ে উপায় আছ থাকে কারও? শিউলির ছয়টি শুভ্র সাদা পাপড়ি। বৃন্তটি কমলা রঙের টিউবের মতো দেখতে। তবে গাছটি সাদামাটা। এটি নরম ধূসর ছাল বা বাকল বিশিষ্ট হয়। লম্বায় ১০ মিটারের মতো। গাছের পাতা ৬ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী সাজানো থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকাজুড়ে শিউলি ফুটে। শুধু তাই নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গ ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের রাষ্ট্রীয় ফুল। সৌন্দর্য উপভোগ ও ঘ্রাণ নেয়া ছাড়াও শিউলির আরও কিছু ব্যবহার আছে। ফুলটি থেকে হলুদ রং তৈরি করা হয়। বোঁটাগুলো শুকিয়ে গুঁড়ো করে হাল্কা গরম পানিতে মেশালেও তৈরি হয় চমৎকার একটি রং। এ ছাড়া বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে শিউলির বীজ, পাতা ও ফুল ব্যবহার করা হয়। শেষ করা যাক আবিদ আজাদের সেই বিখ্যাত কবিতা দিয়ে। ঠিক ফুল নয়, মরা শিউলি গাছ দেখেছিলেন কবি। লিখেছিলেন: যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সে শহরে জনহীন কোন/পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে/একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি...। কেন মরা শিউলি গাছ? কেন এভাবে বলা? এমন ভবিষ্যদ্বানী কেন? ভেবে দেখার মতো বৈকি!
×