ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড্রেজড আর্থ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা হচ্ছে

শিল্পপার্ক সড়ক মহাসড়ক নির্মাণে ব্যবহার হবে নদীর তলদেশের মাটি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৪ অক্টোবর ২০১৮

শিল্পপার্ক সড়ক মহাসড়ক নির্মাণে ব্যবহার হবে নদীর তলদেশের মাটি

তপন বিশ্বাস ॥ দেশে এই প্রথমবারের মতো ‘ড্রেজড আর্থ’ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা করছে সরকার। নদ-নদীসমূহের নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং নদী ভাঙ্গনরোধে চলমান নদীখনন থেকে পাওয়া ‘ড্রেজড আর্থ’(ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর তলদেশ থেকে পাওয়া বালু, মাটি ও পলি) ব্যবস্থাপনায় এই নীতিমালা করা হচ্ছে। ‘ড্রেজড আর্থে’র সঠিক ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে শিল্পপার্ক, টাউনশিপ, হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন, সড়ক, মহাসড়ক, রেলপথ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ এবং সম্প্রসারণ করা হবে। এটি ড্রেজড আর্থ এর মাধ্যমে পুনরুদ্ধারকৃত ভূমিতে শিল্প পার্কসহ টাউনশিপ হাউজিং নির্মাণ ও অন্যান্য ব্যবহার নীতিমালা ২০১৮ নামে অভিহিত হবে। সরকারের অনুমোদনের তারিখ থেকে এ নীতিমালা কার্যকর হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে নীতিমালাটির খসড়া প্রস্তুত করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞ এবং অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) মতামত নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষাকোষ থেকে ভাষাগত বিশুদ্ধতা নিরূপণ শেষে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে অনুমোদনের জন্য প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন এবং অনুমোদন শেষে এই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে। নদীখনন থেকে পাওয়া ড্রেজড আর্থ ব্যবস্থাপনায় এটি দেশে প্রথম নীতিমালা হচ্ছে বলে নীতিমালা তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা জানান। খসড়া নীতিমালায় দেশের নদ-নদীর সার্বিক চিত্রতুলে ধরে বলা হয়েছে, ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ নদ-নদী বেষ্টিত পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। দেশে ৪০৫টি নদ-নদী শাখা প্রশাখা বিস্তার করে বহমান রয়েছে। তার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা অন্যতম। এ সকল নদ-নদী প্রতিবছর উজান হতে প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মেট্রিক টন পলি বহন করে সমুদ্রে ফেলে। বয়ে আনা এ বিপুল পরিমাণ পলির প্রায় ৪০ শতাংশ নদীর তলদেশে জমা হয়। প্রাকৃতিক বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত নদীর তলদেশে জমা হওয়ার ফলে নদীর বুকে প্রচুর চর জেগে ওঠে। ফলে নদীর প্রবাহমান স্র্রোত নদীর তীরে বার বার আঘাত হানে এবং তীব্র নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়। নদী ভাঙ্গনের ফলে প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় এবং প্রতিবছর ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। এছাড়া নদীর তলদেশে পলি ভরনের কারণে দেশের নদ-নদীগুলোর গভীরতা ও নাব্য আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় নদীর পানি ধারণ ক্ষমতাও উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে নদ-নদীসমূহের পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ দেশের বিপুল পরিমাণ এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে জান মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। যা জাতীয় উন্নয়নের জন্য বিরাট অন্তরায় এবং কৃষি, সেচ, মৎস্যচাষ, বনায়ন, নৌ চলাচলের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। নদীর তলদেশে জমা হওয়া পলি অপসারণ করে নদ নদীর নাব্য পুনরুদ্ধার, নিষ্কাশন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নদীর তীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে নদী খনন করা হয়। খনন থেকে প্রাপ্ত ড্রেজড আর্থ বিভিন্ন কারণে নদীর নিকটবর্তী চর এলাকায় বা নদীর ভেতরেও ফেলা হয়। ড্রেজড আর্থ বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে পুনরায় তা নদীতেই ফেরত আসে। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাছাড়া অপিরকল্পিতভাবে ড্রেজড আর্থ যত্রতত্র ফেলার কারণে পরিবেশ দূষণ, কৃষিজমি হ্রাস, আবাসনসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। উল্লেখিত সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য দেশের নদীসমূহে পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি প্রাপ্ত ড্রেজড আর্থ নদী তীরবর্তী এলাকার অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে নিক্ষেপ বা স্তুপীকরণের মাধ্যমে ভূমি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। ক্রমবর্ধমান বিপুল জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে বিশেষ করে খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন চাহিদা মেটানোর জন্যও নতুন ভূমির প্রয়োজন রয়েছে। নীতিমালায় ড্রেজারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এক ধরনের নির্ধারিত বিশেষ যন্ত্র বা যান্ত্রিক জলযান যা নদীর তলদেশ বা পানিতে নিমজ্জিত যে কোন স্থান থেকে মাটি, বালু খনন ও অপসারণপূর্বক নিক্ষেপে সক্ষম। ড্রেজিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ড্রেজার দিয়ে সুইংয়ের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে নদীর তলদেশের বালু, মাটি ও পলি অপসারণে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা। ড্রেজড আর্থের মালিকানার বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, যে সরকারী সংস্থা সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিং কাজ বাস্তবায়ন করবে উত্তোলিত ড্রেজড আর্থের মালিকানা যে স্থানে রক্ষিত হোক না কেন এর মালিকানা ওই সংস্থার তথা সরকারের হবে। এ নীতিমালার আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে অপেক্ষাকৃত নিচু ও ব্যবহার অনুপযোগী ভূমি উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ দারিদ্র্য বিমোচন করা হবে। দেশের নদ-নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠা অপিরকল্পিত শিল্প কারখানা স্থানান্তর করে ওই অঞ্চলসমূহে পরিকল্পিত উপায়ে শিল্প পার্ক স্থাপনের মাধ্যমে জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি আর্থ সামাজিক উন্নয়ন করা হবে। ব্যবহার উপযোগী ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে ওই ভূমিতে শিল্প কারখানা, আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিদ্যমান কৃষি জমির ওপর চাপ কমানো হবে। ড্রেজড আর্থ ব্যবহারের মাধ্যমে সড়ক ও রেলপথ উচুকরণ ও প্রশস্তকরণ করে উন্নয়ন ব্যয় কমানো হবে। নিচু জমি ভরাট করে কৃষি জমি উদ্ধার, স্থানীয় নিচু হাট বাজার, খেলার মাঠ, ভরাট করে ঈদগাহসহ যাবতীয় সামাজিক কাজে ব্যবহার করা হবে। এগ্রোফার্ম করার উপযোগী জমি উদ্ধার করা হবে। যেসব স্থানে ড্রেজড আর্থ ফেলা হবে সেই সকল স্থানের মালিকানা নিশ্চিত করা হবে। যদি সরকারী জমি হয় তা হলে ডিসির পূর্বানুমতি নিতে হবে। ব্যক্তি মালিকানাভুক্ত জমি হলে অধিগ্রহণ করতে হবে। ভরাটের ক্ষেত্রে পতিত ও চাষের অযোগ্য জমি অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়া ভূমি পুনরুদ্ধারে সরকারী অকৃষি খাস ও নিচু জমি অগ্রাধিকার পাবে। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট মতামতে বলেছে, এ ধরনের পরিকল্পনা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে বাস্তবায়ন হলে সুফল বয়ে আসবে এবং নীতিমালায় সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট গাইড লাইনস থাকা দরকার। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনা করে ড্রেজড আর্থ দিয়ে ভূমি উন্নয়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে।
×