ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অস্থির ডলারের বাজার

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৪ অক্টোবর ২০১৮

অস্থির ডলারের বাজার

রহিম শেখ ॥ ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে ডলারের বাজার। দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন নগদ মার্কিন ডলারের মূল্য সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছে। আমদানি পর্যায়ের ডলারের দর উঠেছে ৮৩ টাকা ৮৫ পয়সা। এদিকে গত তিন মাস আটকে রাখার পর ডলারের বিপরীতে টাকার মান পড়তে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসে আন্তঃব্যাংক ডলারের দাম বেড়েছে ৮ পয়সা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলারের দাম বাড়ছে মূলত পাঁচ কারণে। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্রাতিরিক্তি আমদানি ব্যয়, পাচার, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহের নিম্নগতিকে ডলার সঙ্কটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি ব্যাপক হারে বাড়ছে। অনেক বড় বড় প্রকল্প কাজ চলছে। তাতে সামনের দিনগুলোতে ডলারের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, গত দুই বছর আগে এই দিনে ব্যাংকভেদে নগদ ডলারের দাম ছিল ৮১ থেকে সর্বোচ্চ ৮২ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। এদিকে তিন মাস আটকে রাখার পর ডলারের বিপরীতে টাকার মান পড়তে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসে আন্তঃব্যাংক ডলারের দাম বেড়েছে ৮ পয়সা। ফলে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৩ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে ৮৩ টাকার ৮৫ পয়সা হয়েছে। মূলত আমদানির দায় শোধ করতে এ হার বেঁধে দেয়া হয়েছে। তবে খোলা বাজারে ডলারের দাম ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা। এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গত তিন মাসে ডলারের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৫ থেকে ৬ রুপী বেড়েছে। ভারতে গত জুনে প্রতি ডলারের দাম বিনিময়মূল্য ছিল ৬৮ দশমিক ৮০ রুপী, গত শুক্রবার তা বেড়ে ৭৪ রুপী ছাড়িয়ে যায়। দেশটির মুদ্রানীতিতে নীতিনির্ধারণী সুদ হারের কোন পরিবর্তন না আসার পরই ব্যাপক হারে রুপীর দরপতন হয়। যেটা ভারতের ইতিহাসে রেকর্ড। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতে যেভাবে রুপীর মান হারাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ডলারের আয় হারাতে পারে। এজন্য রফতানি ও প্রবাসী আয় ধরে রাখতেই টাকার মান কিছুটা ছাড় দেয়া হচ্ছে। আরও কয়েকদিন এমন প্রবণতা চলবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নির্দিষ্ট করে দেয়। ব্যাংকগুলোকে মৌখিকভাবে জনিয়ে দেয়, ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সার বেশি দামে আমদানি দায় শোধ করা যাবে না। এজন্য ব্যাংকগুলোর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ডলার বিক্রি করে, তার দামও ছিল ৮৩ টাকা গত ২৮ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডলারের দাম এভাবেই আটকে রেখেছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। আর একই সময়ে বাজারের সঙ্কট সামলাতে ব্যাংকগুলোর কাছে ২০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে তারা। গত বুধবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১৯৭ কোটি ডলার। জানা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে বাংলাদেশে ডলারের সঙ্কট শুরু হয়। রফতানি ও প্রবাসী আয়ের তুলনায় আমদানি দায় বেশি হওয়ায় এ সঙ্কটের সূত্রপাত। এখন পর্যন্ত এই সঙ্কটের কোন সুরাহা হয়নি। এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলারের চাহিদার কারণেই দাম বাড়ছে। প্রচুর এলসির দেনা শোধ করতে হচ্ছে। তবে রফতানি ও রেমিট্যান্স খাত থেকে সে পরিমাণ আয় আসছে না। এ কারণেই ব্যাংকগুলোয় ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, আমদানি ব্যাপক হারে বাড়ছে। অনেক বড় বড় প্রকল্প কাজ চলছে। তাতে সামনের দিনগুলোতে ডলারের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে। ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণ খুঁজতে ও বাজার স্বাভাবিক করতে বাণিজ্যিক ব্যাংক অনুমোদিত ডিলার (এডি) ও মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এরপরও বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলসি খোলার ক্ষেত্রেও কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা প্রয়োজন। কে কোন পণ্য আমদানি করছেন। এলসি খোলার সঙ্গে আমদানি পণ্যের সামঞ্জস্য আছে কিনা এসব বিষয়ে অধিক যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সম্প্রতি দেশের পণ্য ও সেবা উভয়ের ক্ষেত্রেই বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। আমদানি ব্যয় রেকর্ড পরিমাণ বাড়লেও বাড়ছে না রফতানি আয়। আর এতে বেড়েই চলছে বাণিজ্য ঘাটতি। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর (জুলাই-জুন) শেষে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ সময় বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮২৬ কোটি ডলার। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্পগুলোর জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে। ফলে ব্যাপক হারে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। কিন্তু সে তুলনায় রফতানি আয় বাড়ছে না। তাই বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, উৎপাদনশীল খাতে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। কিন্তু দেখতে হবে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা। কারণ ভবিষ্যতে অর্থপাচরের ফলাফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে। মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে। এ কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় রফতানি আয় বাড়ছে না। তাই ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। তাই এখন রফতানি আয় বাড়াতেই হবে। এর বিকল্প নেই। তবে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যদি মূলধনী যন্ত্রপাতি বা পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি হয়ে থাকে তাহলে ভাল। কিন্তু আমদানির এই প্রভাব বিনিয়োগ খাতে দেখা যাচ্ছে না। তাই আমদানির নামে অর্থপাচার হচ্ছে কিনা তা সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে। এদিকে চলতি বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণত নির্বাচনী বছরে অর্থপাচার বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। সেই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে যায়। অতীতের বেশ কয়েকটি নির্বাচনী বছরের রিজার্ভের স্থিতি বিশ্লেষণ করে এমনটাই দেখা গেছে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৭৫১ কোটি ৫০ লাখ ডলার অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে। ওই ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় ২০১৩ সালে নির্বাচনের বছরটিতে। সে বছর ১ হাজার ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার পাচার হয়। এর আগে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকালীন বছর ২০০৮ সালে। ওই বছর পাচারের পরিমাণ ছিল ৯৭২ কোটি ১০ লাখ ডলার। সূত্র জানায়, কয়েকটি উপায়ে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার হয়। এর মধ্যে আমদানি-রফতানি, ক্যাশ ও হু-িতেই সবচেয়ে বেশি। যেসব পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক দিতে হয়, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রাংশ, শিল্পের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয় বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। সরকারী প্রণোদনা পেতে রফতানি পণ্যেও বেশি মূল্য দেখানো হয়। অথচ সেই আয় দেশে আসছে না। অন্যদিকে ভুয়া রফতানি আয় দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তার অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অর্থ পাচার, যার ৮০ শতাংশই হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। আমদানি-রফতানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং; আমদানি-রফতানিতে বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং; পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা, একইভাবে শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে।
×