ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল হাওয়া

রেডিও শোনার সেই দিনগুলো আজ আর নেই...

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২৩ অক্টোবর ২০১৮

রেডিও শোনার সেই দিনগুলো আজ আর নেই...

সমুদ্র হক ॥ রেডিও শোনার সেই দিনগুলো আজ আর নেই। সময়ের ব্যবধানে এসেছে কত বিবর্তন। বাংলাদেশ বেতারসহ বিশে^র অন্যান্য দেশের বেতারের খবর ও অনুষ্ঠান শোনার জন্য রেডিও সেটের দরকার। কোন কোন বেতার অনুষ্ঠান ইন্টারনেটে শোনা যায়। হালে দেশে ফ্রিকোয়েন্সি মডিউল (এফএম) ব্যান্ড রেডিওর কিছু শ্রোতা আছেন। এফএম ব্যান্ড রেডিও শোনার ব্যবস্থা সেল (মোবাইল) ফোনেও আছে। কমিউনিটি রেডিওগুলোর অনুষ্ঠান শুনতে হয় সেটে। তবে বড় প্রশ্ন : বর্তমানে কতজন রেডিওর অনুষ্ঠান শোনেন! উত্তর পাওয়া কিছুটা কঠিন। এ দেশে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে টেলিভিশন কেন্দ্র চালু হওয়ার পরও অনেকটা সময় পর্যন্ত রেডিও ছিল বেশ দাপটে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে দেশ বিদেশের খবর শোনা ও বিনোদনের বড় উপকরণ ছিল এই রেডিও। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে টেলিভিশন উপকেন্দ্র চালু হয়ে সারা দেশের মানুষ ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেখতে পায়। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এ দেশের মানুষের অনেকের ঘরে রেডিও সেট ছিল। এরপর বেসরকারী টেলিভিশন কেন্দ্র চালু এবং ক্যাবল নেটওয়ার্ক সংযোগ শুরু হলে সাধারণ মানুষ দেশ বিদেশের টিভি অনুষ্ঠানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বেতারের অনুষ্ঠান শোনার পালা কমতে থাকে। আগে সাধারণ মানুষ রেডিওতে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি), ভয়েস অব আমেরিকার (ভিওএ) খবর শোনার জন্য যেভাবে উদগ্রীব হয়ে থাকত তা থাকছে না। ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবের আগমনে রেডিও শোনার যে টুকু দিন ছিল তাও আর রইল না। এখন কেউ রেডিওর অনুষ্ঠান শুনতে চাইলে স্মার্ট ফোন ও ট্যাব যথেষ্ট। নেটে গিয়ে গুগল সার্চ দিলে বেতারের কত অনুষ্ঠান। এফএম ব্যান্ডের রেডিও স্টেশনগুলো বাংলা ইংরেজী মিশিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষায় বিনোদনের নামে ভাঁড়ামিতে যে অনুষ্ঠান প্রচার করে শ্রোতাদের কাছে টানার চেষ্টা করছে। তাও ব্যর্থ। ঢাকার পথঘাটে কোথায় কখন জ্যাম লেগেছে, বিকল্প কোন পথে যাওয়া যাবে এই খবরগুলো এফএম ব্যান্ড প্রচার শুরু করলে যানবাহনের অনেক চালক তা শুনে উপকৃত হয়ে রুট পরিবর্তন করতেন। এই ব্যবস্থাও প্রযুক্তিতে উন্নত ও আধুনিকায়ন হয়েছে। স্মার্ট ফোনে গুগল ম্যাপ এখন অনেক আপডেট। গুগল ভয়েসে কথা বলে জানতে চাইলে উত্তর মেলে। কেমন ছিল সেদিনের রেডিও প্রচার- প্রবীণদের কাছে আজও সেদিনের বেতার অনুষ্ঠান মধুময় স্মৃতির অধ্যায় হয়ে আছে। রেডিও সেট ছিল তিন ধরনের। মিডিয়াম ওয়েভের সঙ্গে শর্ট ওয়েভ-১, ২, ৩ সহ যে রেডিও তাকে বলা হতো চার ব্যান্ডের রেডিও। এর কম ব্যান্ডেরও ছিল। আজও এমন রেডিও সেট আছে। তবে শ্রোতা হাতেগোনা। বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান, ভারতের আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠানসহ কয়েকটি দেশের অনুষ্ঠান শোনা যেত মিডিয়াম ওয়েভে। বিবিসিসহ বিশে^র উন্নত দেশগুলোর শর্টওয়েভে। শর্টওয়েভের ১৩, ১৬, ১৯, ২৫, ৩১ ও ৪১ মিটার জ্যামে ভরা। বিশে^র বেশিরভাগ দেশের বেতারের অনুষ্ঠান এই লিংকে। ফলে শর্টওয়েভের এই মিটারে কাঁটা ঘোরালে সামান্য এদিক সেদিক হলেই অনেক ধরনের কথার জ্যাম লাগে। হালে এই লিংকগুলো উন্নত প্রযুক্তিতে আধুনিকায়ন হয়েছে। রেডিওর খবরের পাশাপাশি নাটক, গান ও বিনোদনের নানা আয়োজন ছিল। কোন গান শোনার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখলে সেই গান শোনানো হতো। বাংলাদেশে বেতার ঢাকা কেন্দ্রের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস, বাণিজ্যিক কার্যক্রমে নানা ধরনের গান ও অনুষ্ঠান শ্রোতদের কাছে টানতো। সেদিনের বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ পাঠকদের বেশিরভাগের কণ্ঠ এতটাই শ্রুতিমধুর ছিল যে তাদের কণ্ঠে খবর শোনার জন্য শ্রোতারা অপেক্ষায় থাকত। আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অলইন্ডিয়া রেডিওর ইভা নাগ, সুরজিত সেন, সিলন (বর্তমানের শ্রীলঙ্কা) রেডিওর ভরাট কণ্ঠ আমিন শেয়ানীর উপস্থাপনার কথা রেডিওর প্রবীণ শ্রোতাদের মনে আজও গেঁথে আছে। সেদিনের তরুণ-তরুণীদের অনেকেই রেডিও টেবিলে অন রেখে অনুষ্ঠানও শুনতো, লেখাপড়ার করত। আজ আর সেই দিনগুলো নেই। তবে রেডিও আছে। কোন বেতারের কোন অনুষ্ঠান কখন প্রচার তা এখন বলতে পারে ক’জনা। বেতার আবিষ্কারক ইতালির বিজ্ঞানী জুগলিমো মারকোনি ১৮৯৫ সালে রেডিও আবিষ্কার করেন। পৃথিবীতে আসে রেডিও ওয়েভ (বেতার তরঙ্গ), প্রযুক্তির এগিয়ে চলার যাত্রা। শব্দের এই রেডিও ওয়েভ থেকে আবিষ্কার হতে থাকে নতুন পৃথিবীর কোটি কোটি পথের বহুমাত্রিক প্রযুক্তি। ষাটের দশকের রেডিও শুনতে প্রয়োজন হতো এরিয়াল। যার আরেক নাম এ্যান্টিনা। যা জাদুঘরে চলে গেছে। মাইক্রোওয়েভ লিংকও এখন অনেক এগিয়েছে। শব্দ তরঙ্গ থেকে অনু তরঙ্গের কিলোবাইট, মেগাবাইট, গিগাবাইট, মাইক্রো গিগাবাইট পৃথিবীকে অনেক দূরের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
×