ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণগ্রস্ততায় চরাঞ্চলের তাঁত শিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ২২ অক্টোবর ২০১৮

 ঋণগ্রস্ততায় চরাঞ্চলের তাঁত শিল্প  বন্ধ হওয়ার উপক্রম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল চরকাজাইকাটা গ্রামের নিজ বাড়িতে নিজের তাঁতে গভীর মনোযোগে মহিলাদের শীতের চাদর বুনছেন জামাল উদ্দিন (৫৫)। বাপ-দাদার হাত ধরে শেখা তাঁত শিল্পের এ কাজটাই তিনি করছেন ছোট বেলা থেকেই। কিন্তু দুই দশক আগেও শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, চাদর, নিত্য ব্যবহার্য কাপড় তৈরি করতেন এখন জীবন-জীবিকার তাগিদে তৈরি করছেন শুধু মহিলাদের শীতকালীন চাদর। তার সঙ্গে কাজ করছেন আরও দু’জন শ্রমিকও। আর পাশে বসে চরকায় চাদর বুননের সুতা গুটিয়ে দিচ্ছেন তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম। জামাল উদ্দিন জানান, প্রায় দুই দশক আগে ২০টি তাঁতে কাপড় বুনেও চাহিদা মেটানো যেত না। আর এখন সব বন্ধ করে দিয়ে মাত্র তিনটি তাঁতে শুধু মহিলাদের চাদর তৈরি করেও ভাল দামে বিক্রি করতে পারছি না। ক্রেতা নেই। তিনি আরও বলেন, বর্তমান বাজারে সুতার দাম বেশি, জড়ির দাম বেশি, শ্রমিকের হাজিরা বেশি। অথচ বেশি দামে উপকরণ কিনে কিস্তির টাকার চাপে একজোড়া চাদর মাত্র তিন শ’ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তাতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা লোন নিয়ে সুতা কিনে চাদর তৈরি করছি। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে ১৩শ’ টাকা কিস্তি দিতে হয়। সরকার যদি আমাদের অল্প সুদে লোনের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে আমরা চাদর মজুদ করে শীতকালে বিক্রি করে লাভ করতে পারতাম। একই গ্রামের তাঁত মালিক লেবু (৩৫) ও আব্দুস সালাম (৬০) তাদের কষ্টের কথা বললেন। আর পার্শ্ববর্তী চরশৌলমারী গ্রামের বন্ধ করে রাখা তাঁত মালিক মোসলেম উদ্দিন জানান, আমাদের নিজস্ব কোন তহবিল নাই। এনজিও থেকে লোন নিয়ে সুতা কিনে আনি। কাপড় তৈরি করে মজুদ করতে পারি না। কিস্তির চাপে কম দামে বিক্রি করতে হয়। ফলে লাভের জায়গায় লোকসান গুনতে হয়। তাছাড়া বাকিতে কাপড় বিক্রি করে সময় মতো টাকাও পাওয়া যায় না। এজন্যই বর্তমানে তাঁত বন্ধ করে রেখেছি। এলাকাবাসী জানায়, প্রায় এক থেকে দেড় শ’ বছর আগে চরাঞ্চলের এই এলাকায় বসত গড়ে তাঁতে কাপড় বুনতে শুরু করেন কয়েকটি পরিবার। তখন চরের জমিতে চাষাবাদ করা ফসল দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে সময় এই তাঁতে কাপড় বুনে জীবিকা নির্বাহ করা পরিবারগুলোর দেখা দেখি ঘরে ঘরে তাঁতের প্রসার ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে রৌমারী উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার তাঁত শিল্প গড়ে উঠে। বর্তমানে এই তাঁতের সংখ্যা কমতে কমতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার প্রায় এক থেকে দেড় শ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প। রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ও বন্দবের ইউনিয়নের চরকাজাইকাটা, ফুলকারচর, খেওয়ারচর, গেন্দার আলগা, সোনাপুর, চরশৌলমারী, বাঘমারা ও পালেরচর গ্রামের বেশির ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেলেও অল্প কিছু তাঁত সচল রয়েছে। যার সংখ্যা দুই হাজারের বেশি হবে না। চরশৌলমারী ইউপি চেয়ারম্যান কে এম ফজলুল হক ম-ল বলেন, আমার ইউনিয়নের চরকাজাইকাটা, ফুলকারচর, খেওয়ারচর, গেন্দার আলগা, সোনাপুর, চরশৌলমারী ও বন্দবেড় ইউনিয়নে বাঘমারা, পালেরচরে প্রায় বিশ হাজার তাঁত ছিল। তা বন্ধ হতে হতে এখন সব গ্রাম মিলে সচল তাঁত আছে দুই হাজারের মতো। তিনি আরও বলেন, তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য উপজেলা সমন্বয় সভায় সল্প সুদে ঋণের জন্য রেজুলেশন করে জেলায় পাঠানো হয়। কিন্তু তার কোন অগ্রগতি নেই। ফলে আমার ইউনিয়নের তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। কুড়িগ্রাম বিসিক নগরীর ডিএম রহিদুল ইসলাম খান জানান, আমি এক বছর ধরে কুড়িগ্রাম বিসিক শিল্প নগরীর দায়িত্বে আছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত রৌমারী উপজেলার কোন তাঁত মালিক আমার কাছে আসেনি। এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছাঃ সুলতানা পারভীন বলেন, আমি রৌমারী উপজেলার তাঁত শিল্পের বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছি। সরেজমিনে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে যে রকম সুবিধা দিলে তারা এই তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখে স্বাবলম্বী হতে পারবে আমরা সে রকম সুবিধাই প্রদান করব।
×