ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কবীর চৌধুরী তন্ময়

রাজনৈতিক প্রচারে ফেসবুকের প্রভাব

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২২ অক্টোবর ২০১৮

রাজনৈতিক প্রচারে ফেসবুকের প্রভাব

তথ্যপ্রযুক্তির তৃতীয় বিশ্বের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে আসছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এটা শুধু যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক অনেক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তর হয়েছে। ২০০০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছিল মাত্র ৫৩৭ ভোটে। এর ফলে জিতে আসা রিপাবলিকানদের আমলে ইরাক ও আফগানিস্তানে দুটো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু সে সময় যদি ডেমোক্র্যাটরা জিতত তাহলে হয়ত ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হতো। মার্কিন নির্বাচন উপলক্ষে ডেমোক্র্যাটদের তৈরি করা একটি ভিডিওচিত্রে এমন মন্তব্য করে সবাইকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। আবার ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের সময় পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ফেসবুকের কারণে ওই নির্বাচনে ৬০ হাজার ভোট বেশি পড়েছে। এই দুটো তথ্য একসঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করলে ফেসবুক তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে একটা ভাল ধারণা পাওয়া যায়। তবে যে কোন নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক কী ধরনের প্রভাব বা রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হতে পারে সেটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের সময় দেখা গেছে। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে করা সব জরিপ মিথ্যা প্রমাণ করে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর এমন জয়ে ‘দিস ইজ মাই ডিজিটাল লাইফ’ নামক একটি ফেসবুক এ্যাপ ভূমিকা রেখেছিল বলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ওঠে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক আলেক্সান্ডার কোগান এটি তৈরি করেছিলেন। নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করা ব্রিটিশ সংস্থা ‘ক্যামব্রিজ এ্যানালিটিকা’র হয়ে এ্যাপটি ডেভেলপ করেছিলেন কোগান। এই ‘দিস ইজ মাই ডিজিটাল লাইফ’ এ্যাপটি ২০১৫ সালে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ওপর একটি জরিপ চালায়। ফেসবুকের এই এ্যাপ ছিল মূলত একটি কুইজ। এর মাধ্যমে কুইজে অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিত্বের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে ক্যামব্রিজ এ্যানালিটিকা। প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই কুইজে অংশ নেন। অর্থাৎ ক্যামব্রিজ এ্যানালিটিকা এই এ্যাপের মাধ্যমে ৩ লাখ ২০ হাজার জনের বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ফেসবুকের সেই সময়কার নীতি অনুযায়ী এ্যাপটির মাধ্যমে ওই ৩ লাখ ২০ হাজার জনের বন্ধুদের বিস্তারিত তথ্যও ক্যামব্রিজ এ্যানালিটিকার হাতে চলে আসে। সব মিলিয়ে ৫ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য পায় গবেষণা সংস্থাটি। আর এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই নানা ধরনের বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়। ভিন্ন ভিন্ন ভোটারের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা-চেতনা, মনমানসিকতা আর ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভর করে ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্য বার্তা তৈরি করে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ্যাপের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা শিবির এত বেশিসংখ্যক ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য হাতে পেয়েছিল, যা ইতিপূর্বে এমনটি ঘটেনি বা কেউ পায়নি। এ্যাপের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাজানো কৌশলের কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। আর বিশ্লেষকদের কথার প্রমাণ দিলেন খোদ ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ। ফেসবুক থেকে তথ্য বেহাত হওয়ার কেলেঙ্কারির জবাব দিতে হয়েছে তাকে। ৪৪ জন সিনেটরের সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন কংগ্রেসে আইন প্রণেতাদের বাণিজ্য বিষয়ক ও বিচারক কমিটির যৌথ শুনানিতে হাজির হতে হয় জাকারবার্গকে। সেখানে তথ্য সুরক্ষা, বিজ্ঞাপন, সন্ত্রাস নির্মূল ও নানা ক্ষতিকর কর্মকা- ঠেকাতে ফেসবুকের পরিকল্পনা বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয় জাকারবার্গকে। সেখানে জাকারবার্গ বলেন, ‘২০০ জনের একটি দল কাউন্টার টেররিজম বিষয়টি দেখে। যেসব কনটেন্টকে ব্যবহারকারীরা ফ্ল্যাগ দেখান সেগুলো বিবেচনা করেন দলের সদস্যরা। ৩০টি ভাষায় কাজ করে ওই টিম। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর টুল আছে, যা বিতর্কিত কনটেন্ট শনাক্ত করতে পারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ্যাকাউন্ট মুছে দিতে পারে।’ শুধু তাই নয়, মার্ক জাকারবার্গ নিজের দোষ স্বীকার করে কয়েকবার মাফও চেয়েছেন এবং ফেসবুক ইনকরপোরেটেড যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছে, রাশিয়ার এজেন্টরা ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সামাজিক মাধ্যমটিতে ১২৯টি ইভেন্ট ক্রিয়েট করেছিল আর ৩৩৮৩৩০টি ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই ইভেন্টগুলোর পোস্ট দেখেন। তাদের মধ্যে ৬২৫০০ জন ওইসব ইভেন্টে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করে ‘এ্যাটেন্ড’ বাটনে ক্লিক করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক যে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এটা উল্লেখ করে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটটি জানায়, রাশিয়ার ‘ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি (আইআরএ)’-এর বিভিন্ন ট্রল এ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ১২টি ফেসবুক পেজে ওইসব ইভেন্ট ক্রিয়েট করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম। ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি নিয়ে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ তার উদাহরণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য আন্দোলন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। দল-মত নির্বিশেষে রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ফাঁসির দাবি নিয়ে শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধসহ সকল বয়সের নারী-পুরুষের সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে। কারণ, পৃথিবীর যে সব শহরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ‘ঢাকা’ হচ্ছে দ্বিতীয়-এ কথা বলা হয়েছে এক জরিপে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশ্যাল’ আর কানাডাভিত্তিক ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান ‘হুটস্যুইট’ নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথভাবে চালানো এক বৈশ্বিক জরিপে প্রকাশিত ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের হিসাব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী আছেন ব্যাংকক শহরেÑ ৩ কোটি। এর পরই রয়েছে ঢাকা শহর। এখানে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২২ মিলিয়ন বা ২ কোটি ২০ লাখ। ওই জরিপের হিসাব মতে দেশের দিক থেকে হিসাব করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২১ কোটি ৪০ লাখ আর ১৯ কোটি ১০ লাখ ব্যবহারকারীর দ্বিতীয় দেশ ভারত। জরিপ অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটছে চীনে, সেখানে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি। প্রবৃদ্ধির হার ২১ ভাগ। দ্বিতীয় স্থানে ভারত, সেখানে সাড়ে ৫ কোটি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী। প্রবৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশ। আট নম্বরে আছে বাংলাদেশ। এখানে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। এর প্রবৃদ্ধি ঘটছে ৭৩ শতাংশ হারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ফেসবুক, যার সক্রিয় ইউজার এ্যাকাউন্ট ১৮০ কোটিরও বেশি। এর ৮৭ শতাংশই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার করেন। আবার মোবাইল ফোনে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেনÑ এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির তালিকাতেও বিশ্বে ১০ নম্বরে আছে বাংলাদেশ। জরিপ অনুযায়ী এটা ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের হিসাব। বাংলাদেশে এই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৬৯ শতাংশ হারে, যার ৫৫ শতাংশই প্রতিদিন ফেসবুক ব্যবহার করে। ব্যবহারকারীদের ৪৪ শতাংশ নারী এবং ৫৬ শতাংশ পুরুষ। অন্যদিকে ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ জানায়, বাংলাদেশে পৌনে সাত কোটি ইন্টারনেট গ্রাহকের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারী আড়াই কোটি। খুব সহজে ফেসবুক এ্যাকাউন্ট খোলা, সহজ অপারেটিং সিস্টেম থাকায় আজকের দিনে ফেসবুক এ্যাকাউন্ট নিশ্চয়ই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দেয়া সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশে এই সংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়ে। এখন তথ্যপ্রযুক্তি তৃতীয় বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে কী ধরনের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটি বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বাংলাদেশের ইউজারের মনমানসিকতা আর ব্যক্তিত্বকে গুরুত্ব দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা, স্থিরচিত্র, ভিডিও ভাইরাল করে থাকে। এখানে বিশেষ একটি এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ কাজ করে, কাজ করছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্লাটফর্ম এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। জঙ্গী হামলা এবং সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ বন্ধ করতে ২০১৫ সালের ১৮ নবেম্বর থেকে ২২ দিন বাংলাদেশে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বেশ কয়েকটি এ্যাপ বন্ধ রাখার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মিথ্যাচার বা গুজব রটিয়ে বাংলাদেশের একশ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে তাৎক্ষণিকভাবে বিভ্রান্ত করা যায়। এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চেহারা চাঁদে দেখা গিয়েছে মর্মে অপপ্রচার চালিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী মহল পরিকল্পিতভাবে অগ্নিসংযোগসহ মানুষ হত্যার মতো বর্বর কর্মকান্ড চালায়। এই গুজবের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। এরই ধারাবাহিকতায় ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাইয়ে শিশু হত্যা, কক্সবাজার রামুর বৌদ্ধমন্দির থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ও রংপুরে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল এই ফেসবুক ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক এই ফেসবুক ব্যবহার করে একুশ বছরের বিকৃত ইতিহাসে বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীকে দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে সরকার পতনের ষড়যন্ত্র করেছিল। তারাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যাচার-গুজব রটিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবি সিদ্দিক নামের এক শিক্ষার্থীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে, এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে ফেলা হয়েছে মর্মে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে বৈশাখের আয়োজনগুলোতে আগুন লাগিয়ে পরে ভিসির বাসভবনে ইতিহাসের বর্বরতম ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সর্বশেষ নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে ভিন্নখাতে অর্থাৎ সরকার পতনের দিকে নিয়ে যেতেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক প্লাটফর্মকে ব্যবহার করেছে। এখানেও কিছু সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, মডেল, অভিনেত্রী, শিক্ষার্থী পরিকল্পিতভাবে ফটোশপে ছবি এডিট করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে একটি বানোয়াট বার্তা পৌঁছে দিতে ফেসবুক ব্যবহার করে। একদিকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উসকে দিতে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এমন কিছু ভিডিও ভাইরাল করেছে, সেখানে আওয়ামী লীগের অফিসে ছাত্রীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, হত্যা করে লেকের পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে উল্লেখ করে গুজব ছড়িয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে দেশে কোথাও কোন গণতন্ত্র নেই, অবৈধ ভোটারবিহীন সরকার জোর করে ক্ষমতায় আছে, মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে বলেও প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কী ধরনের ভূমিকা রেখেছিল এটা বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার। সামনে বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যেই নানাবিধ ষড়যন্ত্র বাসা বেঁধেছে। আর টার্গেট করা হচ্ছে ফেসবুক ও ফেসবুক ইউজারকে। ২ কোটি ৩৩ লাখ নতুন ভোটারের প্রায় অধিকাংশ ফেসবুকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই নির্বাচনে তাদের কিভাবে বিভ্রান্ত করা যায় সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পরিবেশ তৈরি করতে দেশ-বিদেশ থেকে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে কাজ করছে। আরেকটি মহল তাদের পৃষ্ঠপোষণ করছে। বাংলাদেশে মিথ্যাচার আর গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন রকমের সহায়তা ছাড়াই যতটুকু সম্ভব সঠিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে গুজব রটনাকারী মহল ফেসবুকে বিজ্ঞাপন আকারে তাদের বার্তা দ্রুত পৌঁছে দিতে বুস্ট করে থাকে। তাই অনেক সময় গুজব খুব দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আমাদের সামনে দৃশ্যমান। মনে রাখতে হবে আগেরকার নির্বাচনগুলোতে মানুষে মানুষে যোগাযোগ, বিজ্ঞাপন, লিফলেট বা রেডিও, টিভিতে এক ধরনের প্রচারণা থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিকল্পনা একেবারেই ভিন্ন। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ইতোমধ্যেই ইন্টারন্টে ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন আকারে বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আবার বিভিন্ন দলের ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে রাজনীতি করতে ইচ্ছুক বিশেষ করে নতুন নেতৃত্ব ও নেতা তৈরি করতে বিভিন্ন পরিকল্পনার আহ্বানগুলো এই ফেসবুকের মাধ্যমে নতুনদের হাতে হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ফেসবুককে। সেইসঙ্গে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তার বিতর্কিত কর্মকা- তুলে ধরার পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধীদের অপপ্রচারও যোগ হচ্ছে। গুজব বা অপপ্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা থেকে শুরু করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে ফেসবুক ইউজারের ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী পছন্দের বার্তা পাঠানো শুরু করেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় ফেসবুক, ব্লগ নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে, তরুণদের ফেসবুক ও ব্লগের লেখায় জোট সরকারের দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে সেসবের একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। এবার তো ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ফলে এবার আরও বড় আকারে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। আমি মনে করি শুধু নির্বাচনই নয়, দেশ ও জাতির স্বার্থে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্য তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তা একান্তভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বিতর্কিত কনটেন্ট রিমুভ করা, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করা এবং ফেসবুকে গুজব ছড়ানো, তথ্য বিকৃত করা বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা তথ্য এবং এডিট করে ছবি প্রচার করা- এই ধরনের ফেসবুক ও ফেসবুক পেজ, গ্রুপ, ইভেন্টগুলো চিহ্নিত করে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং পাশাপাশি সত্য তথ্য-উপাত্ত বিজ্ঞাপন আকারে ভাইরাল করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্লাটফর্ম। এটাকে জনসচেতনতা, শিক্ষা এবং জনকল্যাণকর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত। আবার তথ্য বিকৃত ও গুজবের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সত্য তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে ফেসবুক ব্যবহার হোক- এটা সবার প্রত্যাশা। লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×