ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

বিশঙ্ক ব্রত

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২১ অক্টোবর ২০১৮

বিশঙ্ক ব্রত

খুলনা শহরের একটি স্কুলে অধ্যয়নরত নবম শ্রেণীর ছাত্র বিশঙ্ক ব্রত আমাকে খুবই দৃঢ়চিত্তে জানালো বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর নিচে সে কোন ইংরেজী শব্দ দেখতে চায় না। এর মানে হলো বিশঙ্কের মতে আমরা বাংলায় কেন আমাদের আবেগ, শ্রদ্ধা ও সংস্কৃতিকে সাজাতে পারছি না। বাংলা তো আমাদের মাতৃভাষা ও আমাদের বাঙালী সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ভিত্তি। আর বিশঙ্ক এ-ও মনে করে আমাদের ভাষাই হতে হবে দেশের উন্নয়নের মূলমন্ত্র। ১৫ বছরের বিশঙ্ক বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধুর তর্জনী এদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রধান প্রতীক। তার আশপাশে আমাদের আকৃষ্ট করতে কোন বিদেশী ভাষা থাকুক আমি তা দেখতে চাই না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য (২০১৭) ও বয়সের শ্রেণী বিভাজন অনুযায়ী বিশঙ্ক ব্রতের এখন যে বয়সের যাত্রা (১৫ বছর) তার সংখ্যা ২৪ বছর পর্যন্ত ১৯.৩৬ ভাগ। বিশঙ্ক ব্রতের কাছাকাছি বয়সী জনসংখ্যা (২০-২৪ বয়সী) মোট জনসংখ্যার ১৮.১৬ ভাগ। এর সঙ্গে আগের বিভাজন যোগ করলে (১০-১৪ বছর বয়সী যা ১১.৫৬ ভাগ) এই কিশোর ও প্রাক-কৈশোর বয়সের হার দাঁড়ায় ২৯.৭২ ভাগ। এর মধ্যে ভোটার হয়ে গেছে এমন বয়সের (২০-৩৪ বয়সী) জনসংখ্যা ৩৪.৮১ ভাগ। আর মোবাইল ফোন, ফেসবুক ও তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত এবং ব্যবহারকারী মিলিয়ে দেখলে স্মার্ট জনগোষ্ঠী (১০-৩৪ বয়সের) মোট ৫৬.৩৭ ভাগ। ডিজিটাল বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশঙ্কের ব্যক্তিগত চিন্তা কতখানি ব্যাপৃত হয়েছে সে পরিসংখ্যান আমাদের হাতে এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু দেশের সম্ভাব্য ও অনুমিত স্মার্ট জনগোষ্ঠীর হার যদি সব মিলিয়ে হয় ৫৬.৩৭ ভাগ আর তার অর্ধেকও যদি জ্ঞান সমাজের অংশ হয়ে যায় তাহলে আমাদের ভাবনার বিষয় হলোÑ এই জনগোষ্ঠীর জন্য আমরা কোন্ বাংলাদেশ নির্মাণ করব, যাতে ইতিহাসের দায় আমরা পালন করেছি এই কথা সবার আগে জোর গলায় বলে যেতে পারব। যারা সক্রিয়ভাবে দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত সে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বয়স হারে ১৮.১৯ ভাগ (৪৫-৬০ উর্ধ বয়সী)। ইতিহাস বিবেচনা করবে এদের ভূমিকা, সেখানে অনেক বিস্ময়ও আছে, দুনিয়ার ইতিহাসে যা বিরল। বঙ্গবন্ধু কিন্তু জাতির পিতা হয়েছিলেন ৫০ বছর বয়সেই। বিশঙ্ক ব্রতের চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আমাদের ভাবনা আন্দোলিত হয় এই ভেবে যে, আমরা এখন যে বাংলাদেশে আছি তার স্বপ্নপূরক মুখ্যত শেখ হাসিনা। তিনি যে বাংলাদেশ গঠন করছেন তা একটি ‘মানবিক রাষ্ট্র’, যা আমাদের সংবিধানে প্রতিশ্রুত মূল নীতিগুলোর সম্পূরক। বিশঙ্ক মনে করে এই সংবিধান জাতির পিতা যখন দিয়েছিলেন তিনি কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিকে সবার ওপরে রেখে জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তাহলে সেখানে আমরা বাদ কেন? আমাদের বয়সী বন্ধুদের এই মালিকানা অনুভূতি প্রকাশের কারণ আমরা বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসি, এই দেশের নাগরিক হিসেবে গর্ববোধ করি আর বঙ্গবন্ধুকে বাংলায় দেখতে চাই। কারণ সেখানেও আমাদের মালিকানা আছেÑ তিনি আমাদের পিতা, এই দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। যদি আমরা এই ভাবনাগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে ভাবতে বসি আমাদের করণীয় কি তা হলো হাজার রকমের মানবসৃষ্ট সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশের আঁতুড় ঘরের মৌলিক কাঠামোর ওপরে আঘাত করা হয়। আমার ধারণা, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ দেশের চলমান ইতিহাস। শিশু বাংলাদেশকে মন ভুলিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয় ঘুর পথে অন্য কোথাও এক অনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। কারণ মূল উদ্দেশ্যই ছিল সদ্যজাত দেশের ইতিহাস বিকৃত করে, মন ভোলানো ছড়া শুনিয়ে তাকে তার মূল থেকে সরিয়ে রাখা। এমন এক পরিবেশ তৈরি করা হয় যেন সেই শিশু দেশের পিতাও অপরাধী, মাতা বুঝি কুলনাশী! ফলে এদেশে শুরু“হয় মিথ্যা দিয়ে সাজানো বিকৃত সত্য শিক্ষাদানের প্রচেষ্টা। আমি তার জীবন্ত প্রত্যক্ষদর্শী। ১৯৭৫ সালে আমার বয়স ছিল বিশঙ্ক ব্রতের এখনকার বয়সের চেয়ে এক বছর বেশি। আমার মাতামহ আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নের নেতা ও বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোগী ছিলেন। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় সংগঠকদের অন্যতম। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঘটনাচক্রে সে সময় আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নানাবাড়ি ছিলাম। ১৫ আগস্ট সকালে এই খবর পেয়ে আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি কষ্টে, অপমানে ও ঘটনার বিহ্বলতায় তিনি কী রকম কুঁকড়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন, দুইদিন কিছু খাননি। তৃতীয় দিন কাকডাকা ভোরে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন। পরে জেনেছিলাম কেন্দ্র্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে করণীয় ঠিক করতে বের হয়েছিলেন। বিশঙ্কের বয়সী আমি তখন যা যা প্রত্যক্ষ করেছি তা লিখতে গেলে হাজার পৃষ্ঠা হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি কিশোরের জীবনে এই ইতিহাস আছে যারা আমার মতো ১২ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে, ১৬ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা ও তার পরের ঘটনা সাদা চোখে দেখেছে। যখন আমাদের নিজ হাতে পাতা উল্টিয়ে পড়ার বয়স তখন রাতে কারফিউ আর দিনে ভয়। প্রতিদিন নতুন ঘটনার জন্ম হচ্ছিল। সেসব নিয়ে এখনকার বিশঙ্কদের জন্য ইতিহাস লেখার দরকার নেই; কিন্তু তথ্যগুলো ঠিকভাবে হাজির রাখা দরকার। না হলে বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর নিচে ইংরেজী কেন তার সদুত্তর আমরা দিতে পারব না। ১৯৭৪ সালের প্রথম আদম শুমারি থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৭টি শুমারির পরিসংখ্যান ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ (২০১৭) তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দেখা যায় দেশের কিশোরের গড় (নারী-পুরুষ মিলে) বার্ষিক শতকরা হার ১২.৬৪ বা প্রায় ১৩ বছর। ১৯৭৫ সালে যার বয়স ছিল ১৩ এখন সে ৫৬ বছরের প্রবীণ। এর আগে উল্লিখিত দেশ পরিচালনার মুখ্য ভূমিকার এরা অংশ। ফলে বিশঙ্ক ব্রতের মতো যাদের মনে নানারকম প্রশ্ন তাদের সেসব প্রশ্নের উত্তর এখন আমাদের দিতে হবে। বাবা-মায়ের কাছে গল্প শুনে আর গত দশ বছরে দেশের অগ্রগতি দেখে যারা এখন বড় হচ্ছে তাদের সংখ্যা কিন্তু পরিসংখ্যানের হিসাবে বেশি। এর মধ্যে নতুন ভোটার হয়েছে ৪৩ লাখের বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। আর ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা মোট ভোটের ১৫ শতাংশের মতো। ফলে সে হিসাবে ৩০০ সংসদীয় আসনে এই বয়সী তরুণ ভোটারের সংখ্যা আসনপ্রতি ৫০ হাজারের কিছুটা বেশি। কেন এই হিসাব প্রাসঙ্গিক? কারণ ’৭৫-এর পরে গত ৪৩ বছরে যে কিশোর ১৩ থেকে এখন ৫৬ বছর বয়সী হয়েছে তাকে পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে প্রথমে ২১ বছর (৭৫ থেকে ৯৬) ও পরে ৮ বছর (২০০১ থেকে ২০০৯) ইতিহাস বিকৃতির বাংলাদেশ দেখে দেখে। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। তাদের সামনে এই দেশে তৈরি করা হয়েছে মিথ্যা ও প্রহসনের শাসনব্যবস্থা, দেয়া হয়েছে যে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে তার বিপরীত আদর্শ। এই দেশ দখল করেছে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী এলিট, যারা বাঙালী সংস্কৃতির সামান্য ধারকও নয়। ফলে এখনকার নেতৃত্বের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে বিজাতীয় সংস্কৃতির রাজনীতি, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার। আজকের যুগের বিশঙ্কদের এসব অনাচার থেকে বাঁচাতে হলে সত্য ও সাহসের সংস্কৃতি আমাদের সামনে এনে দিতে হবে। এখন যখন যাদের ভূমিকা রাখার সময় তখন তাদের পেছনের কিশোর ও তরুণরা নানা প্রশ্ন নিয়ে আসছে। তারা জানতে চাইছে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া এই দেশটার অপরাধ কি ছিল? কেন ইতিহাসের চাকা পেছনে ঘুরেছিল? আর সেসবের উত্তর ধৈর্য ধরে আমাদের তো দিতে হবেই। প্রয়োজনে কৈফিয়তও। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×