ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে...’

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২০ অক্টোবর ২০১৮

 ‘মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে...’

জীবনের পথে কত কিই তো চোখে পড়ে। কতটাই বা মনে থাকে। হৃদয়ের গেঁথে থাকে আরও কম। তবে কেউ সাধারণের মন স্পর্শ করে। তারা আসেন রোমান বাক্য ‘ভিনি ভিডি ভিসি’ হয়ে। যার অর্থ ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’। এমনই একজন মানুষ মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী। মাত্র এক বছর ৪ মাস বগুড়ার জেলা প্রশাসকের (ডিসি) দায়িত্ব পালন শেষে সচিবালয়ে বদলি হন। ৯ অক্টোবর তিনি এই শহর ছেড়ে চলে যান। রেখে যান তারুণ্য দীপ্তের কর্মময় জীবনে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছার অপার এক সুর। গীতিময় হয়ে কথা কয়- ‘কখনও বসন্ত কখনও শ্রাবণ সে কথা মনে রবে কি...’। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের স্বল্প ও মিষ্টভাষী, অল্প কথায় অনেক কথা বলায় শিল্পী এবং প্রতিটি মিনিটকে গুরুত্ব দিয়ে নিরলস কাজ করার এই মানুষ বগুড়াকে সাজাতে চেয়েছিলেন বর্ণিল নগরী করে। প্রতিটি উপজেলায় এমন কিছু গড়তে চেয়েছিলেন যা থাকবে নিসর্গের চিরন্তন হয়ে। এই ডিসি তার বাংলোর গাছাগাছালিতে পাখিদের বাসা বানিয়েছিলেন। সোনাতলা উপজেলার গড়তে চেয়েছিলেন পাখিদের অভয়ারণ্য। ইতিহাসখ্যাত কাতলাহার বিলের পুরনো রূপকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। শিশু ও তরুণদের নিয়ে কাজ করাই ছিল তার ব্রত। বলতেন, এরাই আগামীর বাংলাদেশ গড়বে। তরুণদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানোর কর্মসূচীর সঙ্গে জেলা প্রশাসনকেও যুক্ত করেছিলেন। শিশুদের অনুষ্ঠানে তিনি মঞ্চে না বসে শিশুদের সঙ্গে বসে গল্প করতেন। বগুড়ার উন্নয়নে তিনি অবদান রেখেছেন। বগুড়ায় তার শেষ কর্মদিবসের পর সকলকে বিস্মিত করে তার সকল কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন বগুড়ার তরুণদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন- মুগ্ধতা নিয়ে আজ একটা শহর ছাড়ছি। ভালবাসা তরুণের জন্য, যাদের চেতনা সাহস সৃজনশীলতা বিমোহিত করেছে। সকল শিশুর স্বর্গীয় সংস্পর্শ আমাকে অপার আনন্দ দিয়েছে। এসব তরুণ সুন্দরের স্বপ্ন দেখে। ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নামে। জঞ্জাল সাফ করে। মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখে। হাসপাতালে গিয়ে অসহায় রোগীদের রক্ত দেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণে পথে নামে। উৎসব পার্বণে পথশিশুদের হাতে নতুন জামা তুলে দেয়। সমাজের পিছিয়ে থাকা শিশুদের সুন্দর জীবনের স্বপ্ন তো তারাই দেখতে পারে। যে সুর মুগ্ধতা এনে ছড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার বিপুল আগ্রহ আমাকে আপ্লুত করে। এরাই হাজার বছর আগের পুন্ড্রনগরের সভ্যতাকে বুকের ভিতর লালন করে। তাদের সবাইকে চিনি না। সুযোগ হয়নি। তবে তাদের সুর খুব চেনা মনে হয়। ইচ্ছা করে তাদের সঙ্গে বারবার দেখা হোক। তাদের নিয়ে হেঁটে যাই প্রাচীন নগরীর শেষ সীমানা অবধি। প্রতœচোখে স্বপ্ন দেখি। শহরের মাঝখানে প্রবাহিনী প্রাচীন জলধারায় একদিন জোয়ার আসবেই। আমি এই শহরে থাকব না। সুর শুনব। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ কানে বাজবে। তোমরা হবে পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষ। একজন ব্যুরোক্র্যাট তার কাজগুলোর ক্রেডিটলাইনে দিয়ে গেলেন বগুড়ার তরুণদের। এত বড় হৃদয়ের মানুষ ক’জন হয়। এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে অশ্রæজল সংবরণ করা গেল না। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয় ‘সকলি নিবে কেড়ে/দেবে না তবু ছেড়ে/মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে... কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসার ঘায়ে, নীরব বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে।’ -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×