ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কটিয়াদীতে ঢাকঢোলের হাট

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২০ অক্টোবর ২০১৮

 কটিয়াদীতে ঢাকঢোলের হাট

কারও কাঁধে ঝুলছে ঢাক। কেউ হাতে বয়ে বেড়াচ্ছেন সানাই, নানা জাতের বাঁশি, করতাল ও মঞ্জুরিসহ নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র। হঠাৎ করে দেখে মনে হতে পারে বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী দেখাতে এসেছেন সবাই। কিন্তু আদতে তা নয়। এদের সবাই এসেছেন শ্রম বেঁচতে। রীতিমতো হাট বসিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন তারা। জেলার কটিয়াদী উপজেলায় পূজা-পার্বণ উপলক্ষে পুরাতন বাজারে ৫শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাট বসে। আয়োজকরা জানায়, এখানে ছাড়া দেশের কোথাও এ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের হাট বসে না। তবে এ হাটে কোন কেনাবেচা হয় না। পূজামন্ডপে বাজনা বাজিয়ে আরতী দেয়া, দুর্গা মাকে খুশি করা আর দর্শক ভক্তদের আকৃষ্ট করতেই যন্ত্রী বা ব্যান্ড পার্টি চুক্তিভিত্তিকভাবে এখান থেকে ভাড়া দেয়া-নেয়া হয়। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক দুর্গাপূজার আয়োজকরা এ হাটে এসে দরকষাকষি শেষে চুক্তিতে বাধ্য-যন্ত্রিদের নিয়ে যায়। পরে দুর্গোৎসবের শেষদিন প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত বাদ্য বাজিয়ে যন্ত্রীদের বিদায় দেয়। মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের ভাটি অঞ্চল, কুমিল্লার হাওড়াঞ্চল থেকে শত শত বাদ্যযন্ত্রী এ হাটে আসেন। ঢাকঢোল, সাঁনাই, বিভিন্ন ধরনের বাঁশি, কাঁসি, কওালসহ হাজার হাজার বাদ্যযন্ত্রের পসরায় হাট উপচে পড়ে। যন্ত্রিরা দলে দলে দফায় দফায় বাজায় বাদ্যযন্ত্র। বাজনার তালে তালে নাচ আর রং ঢঙের অঙ্গভঙ্গিতে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে থাকে। একটি ঢাক ১০ হাজার, ঢোল ৭-৮ হাজার, বাঁশি প্রকারভেদে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার, ‘ব্যান্ডপার্টি’ ছোট ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার এবং বড় ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দেয়া হয়। বাদ্যযন্ত্রীরা পূজামৈন্ডপে বাজনা বাজিয়ে দর্শক ও ভক্তদের আকৃষ্ট করে থাকেন। দুর্গাপূজা শুরুর দিন থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত টানা ৫ দিন তাদের বাজনা বাজাতে হয়। জনশ্রæতিতে আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ই সর্বপ্রথম তাঁর রাজপ্রাসাদে দূর্গাপূজার আয়োজন করেন। উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। আজও রাজার আমলে খনন করা কোটামন দীঘিটির মনোরম দৃশ্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। পূজা উপলক্ষে রাজাপ্রাসাদ থেকে সুদূর মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের পরগনার বিভিন্ন স্থানে বার্তা পাঠানো হয়। ঢাকঢোল বাঁশিসহ বাদ্যযন্ত্রীদের আগমনের জন্য সে সময় নৌপথ ব্যবহার করা হতো। বাদ্যযন্ত্রীরা কটিয়াদী-মঠখোলো সড়কের পাশে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাট নামক স্থানে পূজার দুদিন আগে এসে পৌঁছাত। পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী মসুয়া গ্রামে বিশ্ব নন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ হরি কিশোর রায় চৌধুরীর বাড়িতে মহা ধুমধামে পূজা শুরু হয়। সেই সঙ্গে চলে বিভিন্ন পূজার বাদ্যযন্ত্রের প্রতিযোগিতা। দিন দিন পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জমিদারদের মধ্যে ঢাকের হাটের স্থান নির্ধারণ নিয়ে দ¦›দ্ব শুরু হয়। পরে যাত্রাঘাট থেকে স্থান পরিবর্তীত হয়ে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী আড়িয়াল খাঁ নদের তীরবর্তী কটিয়াদী পুরনো বাজারে ঢাকের হাট গড়ে ওঠে। এলাকাবাসী কটিয়াদী বাজারে এ ঢাকঢোলির হাট বসায় তারা গর্বিত। তবে তাদের দুঃখ প্রতি বছর এ হাটে আগত বাদকযন্ত্রীদের থাকার সুনির্দিষ্ট কোন সুব্যবস্থা নেই। নেই নিজস্ব স্থান। ফলে নানা সমস্যায় ভোগতে হয় তাদের। তারা সরকারের কাছে সকল সমস্যা সমাধানের দাবি জানান। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহাব আইনউদ্দিন বলেন, ৫শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোকের হাট উপজেলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এ হাটের গৌরব ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলেছে। উপজেলা প্রশাসন আগত বাদ্যযন্ত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন জানান, ঢাকঢোলের হাটের ঐতিহ্য ধরে রাখতে ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি শেড নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে। অচিরেই শেড নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। এতে হাটের সার্বিক সমস্যা সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। -মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ থেকে
×