ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ছোটন মামার অবসর

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২০ অক্টোবর ২০১৮

ছোটন মামার অবসর

ছোটন বাবুর বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু মনটা যেন এখনও চির তরুণ। সবাই ডাকে ছোটন মামা। ভাল ফুটবল খেলতেন। গোলরক্ষক হিসেবে তিনি ফুটবল খেলতেন। এক সময় তার সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলে তিনি বেশ সুনামও কুড়িয়েছিলেন। কত জায়গায় কত ম্যাচ যে খেলেছেন তার হিসাব নেই। এখনও পাড়ার কিশোর ছেলেদের সঙ্গে নানা সময় তিনি ফুটবল খেলায় মেতে ওঠেন। তার সমবয়সীরা এখন আর কেউ ফুটবল খেলে না। কিন্তু ছোটন মামা এখনও তার গ্রামের চৌদ্দ পনেরো বয়সী ছেলেদের সঙ্গে নিয়মিত ফুটবলে মেতে থাকেন। খেলা যেন তার নেশা। খেলাতে তিনি সবাইকে আনন্দ দেন, উৎসাহ দেন। তার উপস্থিতিতে সবাই এক ধরণের আনন্দও অনুভব করে। সেদিন গ্রামের দক্ষিণ পাড়া ও উত্তর পাড়ার ছেলেদের মধ্যে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ হবে সিদ্ধান্ত হয়। উভয় পাড়ার খেলোয়াড় যাচাই বাছাই করা হয়। গাঁয়ে টান টান উত্তেজনা। দক্ষিণ পাড়ার দলে গোলরক্ষক হিসেবে খেলবেন বলে গোঁ ধরে বসে আছেন ছোটন মামা। তিনি দক্ষিণ পাড়ার অধিনায়ক আলীকে বলেন, ‘আমিই গোলরক্ষক হিসেবে খেলব’। -‘মামা তোমার এ বয়সে খেলা কি ঠিক হবে’? -‘কী বলিস, দেখিস পুরান চাল ভাতে বাড়ে’। -‘দেখি মামা কী করা যায়। সবার সঙ্গে আলোচনা করে তোমার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে’। দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে উভয় পাড়ার চূড়ান্ত খেলোয়াড়দের নাম ঘোষণা করা হয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছোটন মামা দক্ষিণ পাড়ার গোল রক্ষক হিসেবে ঠাঁই পেলেন। দুই পাড়ারই খেলোয়াড়দের সবার বয়স প্রায় চৌদ্দ পনেরো বছরের কাছাকাছি। ছোটন মামার বন্ধু অয়ন বলে, ‘ছোটন তুই খেলিস না। তার চেয়ে বসে বসে আমাদের মতো খেলা দেখ’। কিন্তু ছোটন মামা নাছোড় বান্দা। খেলার মাঠে মাইক বেজে উঠেছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। গাঁয়ের একটি ধানকাটা বিলে এ আয়োজন। এলাকার চেয়ারম্যান সাহেব প্রধান অতিথি। দুই দলই প্রস্তুত। গোলরক্ষক হিসেবেও প্রস্তুত ছোটন মামা। তার নানা কসরৎ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। রেফারির বাঁশি। খেলা শুরু। দু’পক্ষের আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চলছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। ছোটন মামা বেশ কয়েকটি আক্রমণ দারুণভাবে প্রতিহত করেছেন। দর্শকদের কী যে করতালি! প্রথম অর্ধ গোলশূন্যভাবে কাটল। বিরতিতে যে যার সমর্থককে উৎসাহ জোগাল। অনেকেই ছোটন মামার গোল রক্ষক হিসেবে খেলার প্রশংসাও করল। দ্বিতীয়াধের্র খেলা শুরু হলো। চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ। মাইকে চমৎকার ধারা বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন পাড়ার ছেলে জুলহাজউদ্দিন। এর মধ্যে দক্ষিণ পাড়ার কামাল দ্বিতীয়ার্ধের দশ মিনিটের মাথায় একটি গোল করে। দক্ষিণ পাড়া এক গোলে এগিয়ে থাকে। খেলা শেষ হওয়ার মিনিট দশেক পূর্বে পরপর দুটি গোল খেয়ে বসে দক্ষিণ পাড়া। উত্তর পাড়ার মিঠু আর হারুন দুজনে দুটি চমৎকার গোল করে। আর গোল শোধ করার সুযোগই হয়নি দক্ষিণ পাড়ার। খেলা শেষ। চেয়ারম্যান সাহেব বিজয়ী দলের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করলেন এবং উভয় দলের খেলার বেশ প্রশংসা করেলেন। পুরস্কার বিতরণ শেষে উত্তর পাড়ার ছেলেদের আনন্দ মিছিল। খেলা শেষে সব দোষ গিয়ে পড়ে গোলরক্ষক ছোটন মামার ঘাড়ে। সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে আড্ডায় এ নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। ছোটন মামার বন্ধুদের অনেকেই বলে, ‘তুই খেলাটা শেষ করে দিলি, না হলে দক্ষিণ পাড়া অবশ্যই জিততো।’ কিন্তু তার মুখে কোন কথা নেই। খেলা হলেই মাঠে ছুটে ছোটন মামা। পাড়ার ছেলেরা একদিন ঠিক করল তাকে একদিন আনুষ্ঠানিকভাবে খেলা হতে বিদায় দেবে। ছোটন মামা রাজিও হয়। যেই বলা সেই কাজ। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একদিন ছোটন মামার খেলা থেকে বিদায়ের আয়োজন। ফুল, ক্রেস্ট দিয়ে ছোটন মামাকে খেলা থেকে বিদায় দেয়া হলো। ছোটন মামা অশ্রু সজল কণ্ঠে বলেন, ‘তোমাদের ভালবাসায় আমি অভিভূত। আগামীতে তোমাদের সঙ্গে আর খেলা না খেললেও আমি খেলা পরিচালনায় হলেও তোমাদের সঙ্গে মাঠে থাকব।’ ছোটন মামা এখন পাড়ার ছোট ছেলেদের খেলায় রেফারির দায়িত্ব পালন করেন। একদিন রেফারির দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও বিপত্তি ঘটে। তিনি একটি গোলের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। অপরপক্ষ বলে, ‘আমরা এ গোল মানি না, এটা পরিষ্কার অফসাইড গোল ছিল।’ কিন্তু ছোটন মামা তার সিদ্ধান্তে অটল। শুরু হলো হট্টগোল, মৃদু ধাক্কাধাক্কি। দু’একজন বলে ‘ওকে রেফারির দায়িত্ব থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর দেয়া হোক।’ সেদিন কোনমতে ছোটন মামা মাঠ ত্যাগ করে। খেলা প- হয়ে যায়। বেশ কয়েকদিন ধরে আর মাঠের ধারে কাছেও যাচ্ছেন না ছোটন মামা। ছেলেরা শুনেছে ছোটন মামার নাকি ভীষণ কঠিন অসুখ। একদিন ছেলেরা ছোটন মামার বাড়িতে উপস্থিত। ছোটন মামা সবাইকে দেখে বলে, ‘এখন অবসরের কথা ভাবছি রে’। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×