ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তফসিলের পর কঠোর কর্মসূচীতে যাবে ঐক্যফ্রন্ট

ঐক্যফ্রন্টের ওপর ভর করে কর্মসূচী পালনের প্রস্তুতি বিএনপির

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২০ অক্টোবর ২০১৮

 ঐক্যফ্রন্টের ওপর ভর করে কর্মসূচী পালনের প্রস্তুতি বিএনপির

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি এখন ঐক্যফ্রন্টের ওপর ভর করে যাবতীয় কর্মসূচী পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর এ জন্যই নিজ দল ও ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচী নিয়ে কোন মনোযোগ নেই। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আপাতত ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় গিয়ে জনসংযোগ করবে। এ ছাড়া নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কঠোর কর্মসূচীতে যাবে ঐক্যফ্রন্ট। আর এ কর্মসূচী বাস্তবায়নে বিএনপিই চালকের আসনে থাকবে। এ জন্য প্রস্তুতি জোরদার করতে সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তফ্রন্ট ও বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বি চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাসদ সভাপতি আসম আব্দুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে একমঞ্চে তুলে শীঘ্রই বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট ‘জাতীয় ঐক্য’ গঠনের ঘোষণা দেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক বি চৌধুরী। পরে এ জোট গঠন নিয়ে নানা মেরুকরণ হয়। এক পর্যায়ে ১৩ অক্টোবর অধ্যাপক বি চৌধুরীকে বাদ দিয়েই তড়িঘড়ি করে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনের ঘোষণা দেন ড. কামাল হোসেন। তবে জোটের নাম পরিবর্তন করে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামকরণ করা হয়। জোটে জামায়াতকে রাখা যাবে না বলে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণের কারণেই বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট করা হয়। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর শরিক দলগুলোকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৭ দফা দাবি ও ১১টি লক্ষ্য নিয়ে দেশব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ২৩ অক্টোবর সিলেটে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু সমাবেশের অনুমতি না পাওয়ায় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তবে অনুমতি না পেলেও সিলেটে গিয়ে যেকোনভাবে কিছু একটা করার চেষ্টা করা হবে বলে ঐক্যফ্রন্ট নেতা আসম রব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। ২৩ অক্টোবর সিলেটে ঐক্যফন্ট সমাবেশ করতে পারবে কি পারবে না এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম ও ৩০ অক্টোবর রাজশাহীতে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়া হয় এ জোটের পক্ষ থেকে। আর ঐক্যফ্রন্টের সিনিয়র নেতারা কয়েক দফা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে কঠোর কর্মসূচীতে যাবেন। এ বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, আপাতত গণসংযোগমূলক কর্মসূচী পালন করা হলেও তফসিল ঘোষণার পর কঠোর কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামা হবে। এ জন্য প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনকালে সেনা মোতায়েনসহ ৭ দফা দাবি আদায়ে সরকারকে চাপ দেয়া হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে কঠোর থেকে কঠোরতর কর্মসূচী দেয়া হবে। এদিকে ঐক্যফ্রন্ট রাজপথের কর্মসূচী শুরুর আগেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে নানা মেরুকরণ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রতিবাদে জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভাসানী ও খন্দকার গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বাধীন এনডিপি ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে অধ্যাপক বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে যোগ দিয়েছে। বিএনপি জোট থেকে আরও ক’টি দল এ জোটে যোগ দেয়ার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। অপরদিকে যুক্তফ্রন্ট নেতা বি চৌধুরীকে শায়েস্তা করতে বিএনপির ইন্ধনে বিকল্পধারার কিছু নেতা ওই দল ত্যাগ করে বিকল্প ধারা নামেই ব্রাকেটবন্দী দল গঠন করেছে। নতুন বিকল্প ধারার সভাপতি নুরুল আলম ব্যাপারী ও সাধারণ সম্পাদক শাহ আহমেদ বাদল অধ্যাপক বি চৌধুরী, মেজর (অব) মান্নান ও মাহি বি চৌধুরীকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে নতুন বিকল্প ধারার সভাপতি নুরুল আলম ব্যাপারী ও সাধারণ সম্পাদক শাহ আহমেদ বাদলসহ আরও ক’জনকে আগেই মূল বিকল্প ধারা থেকে বেশ ক’দিন আগেই বহিষ্কার করা হয়েছে বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জানাতে ১৮ অক্টোবর ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এ জোটের সিনিয়র নেতারা। এ সময় ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সেই সঙ্গে তিনি তার লিখিত বক্তব্যে কূটনীতিকদের কাছে ৭ দফা দাবি ও ১১ লক্ষ্য তুলে ধরেন। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে কি কি করা উচিত তা কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরেন। কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠককালে ড. কামাল হোসেন তার বক্তব্যে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশেষ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে কি কি করা উচিত তা তুলে ধরেন। এ সময় বিদেশী কূটনীতিকরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের কাছে জানতে চান আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট জয়ী হলে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। এ প্রশ্নের উত্তরে ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন জানান, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। কূটনীতিকরা ঐক্যফ্রন্ট একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে কি না জানতে চাইলে জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমরা অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। তবে বর্তমান সরকারের আমলে কোন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তাই আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ চাই। কূটনীতিকরা আরও জানতে চান নবগঠিত এই জোটের মূল নেতা কে? এ প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল বলেন, এখানে কোন একক নেতৃত্ব নেই। যৌথভাবেই এই জোট পরিচালিত হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বর্তমানে কারাগারে থাকলে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে কি না সেটাও জানতে চান কূটনীতিকরা। এ প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল কূটনীতিকদের জানিয়েছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হলে তারা অবশ্যই নির্বাচনে যাবেন। তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থাকা জামায়াত প্রসঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান কি হবে জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কূটনীতিকদের কাছে সদুত্তর দিতে পারেননি। জানা যায়, ৫ বার ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল বিএনপি এখন নিজ দল ও ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচী নিয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছেন না। দলের চেয়ারপার্সন কারাগারে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে থাকায় রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকা বিএনপি এখন ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টের ওপর ভর করে সামনে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ যাবতীয় কর্মকা- ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বেই চালিয়ে যেতে চাচ্ছে দলটি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশেই দলীয় এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, বিএনপি, ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন। তাই ঐক্যফ্রন্ট যে কর্মসূচী দেবে তা এগিয়ে নেবে বিএনপি ও ২০ দল। কারণ, ঐক্যফ্রন্টভুক্ত কোন রাজনৈতিক দলই আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সবাই চায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করতে। নির্বাচন কমিশনের নেয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। তাই এর আগ পর্যন্ত দেশব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচী চালিয়ে তফসিল ঘোষণার পরই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে কঠোর কর্মসূচী পালন করবে। এ জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতিও জোরদার করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ইতোমধ্যেই ঐক্যফ্রন্টভুক্ত প্রতিটি রাজনৈতিক দল কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে রাজপথের কর্মসূচী পালনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে।
×