ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন

আইয়ুব বাচ্চুর শেষ বিদায়ে মানুষের ঢল

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২০ অক্টোবর ২০১৮

আইয়ুব বাচ্চুর শেষ বিদায়ে মানুষের ঢল

মনোয়ার হোসেন ॥ হাতে হাতে ঘুরছিল ভালবাসার গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। অনেকের মুখেই ছিল বেদনার ছাপ। কেউ বা আবার সংবরণ করতে পারেননি বুকের ভেতর চেপে থাকা আবেগটুকু। তাদের চোখের কোল গড়িয়ে ঝরেছে অশ্রুজল। অনুরাগীরা অনুসরণ করেনি তার গানের কথা ‘সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে’। এমন উজাড় করা ভালবাসার সুন্দরতম দৃশ্যে দেখা মিলল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। রকস্টার আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি নিবেদিত হলো সেই ভালবাসা। এভাবেই প্রিয়জনদের শ্রদ্ধার সঙ্গে পরম মমতায় সিক্ত হলেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। অতিপ্রিয় শিল্পীকে এক নজর দেখতে কিংবা ফুলেল ভালবাসা জানাতে দলে দলে এসেছিলেন অনুরাগীরা। বিপুলসংখ্যক ভক্তের পদচারণায় ধুলোয় ধূসর হয়েছে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। উড়ে যাওয়া সেই ধুলোবালি যেন শিল্পীর পক্ষ নিয়ে বলেছে- আর কত এভাবে আমাকে কাঁদাবে/আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে ...। শুক্রবার হেমন্ত সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সর্বসাধারণ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শিল্পীকে। সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বে নেমেছে সাধারণ মানুষের ঢল। সহযাত্রীকে বিদায়ী ভালবাসা জানাতে জড়ো হয়েছিলেন সঙ্গীত ভুবনের নবীন থেকে প্রবীণ কিংবা প্রখ্যাত শিল্পীরা। এসেছিলেন অভিনেতা-নির্মাতাসহ সংস্কৃতি অঙ্গনের নানা শাখার মানুষেরা। তবে সেসব বিশিষ্টজনকে ছাপিয়ে যায় ভক্তের কাছে এবি নামে পরিচিত আইয়ুব বাচ্চুকে ভালবাসা সাধারণ মানুষের জনস্রোত। মিনারের চত্বর ছাড়িয়ে সেই জনস্রোত বিস্তৃত হয়েছে আশপাশের সড়কে। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে প্রিয় শিল্পীর কফিনে তারা বিছিয়ে দিয়েছে শ্রদ্ধার স্মারক পুষ্পাঞ্জলি। শ্রদ্ধা জানাতে এসে বেদনার অশ্রুর গোপন রাখতে পারেননি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিল্পী সুমনা হক, ফোয়াদ নাসের বাবুসহ অগণন ভক্ত-অনুরাগী। অপরকে আড়াল করে বারবার চোখ মুছেছেন অনেকেই। মিরপুর থেকে এসেছিলেন চাকরিজীবী নারী ফাতেমা আহসান। ২৮ বছরের এই সঙ্গীতানুরাগী ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন দীর্ঘ লাইনের এক সারিতে। বললেন, ‘ছোট থেকে বড় হয়েছি আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনে। তিনি আমার অনেক অনেক পছন্দের একজন শিল্পী। তার দরাজকণ্ঠ আর গিটারের সুরে কেটেছে জীবনের বহু আনন্দঘন সময়। বৃহস্পতিবার সকালে তার আকস্মিক মৃত্যুর খবরে চমকে গিয়েছিলাম। চেপে রাখতে পারিনি কষ্টমাখা ভেতরের কান্নাটাকে। আজ একগুচ্ছ ফুলে প্রাণপ্রিয় শিল্পী জানাব চিরবিদায়’। মিনারের উল্টোপাশের গগন শিরিশ বৃক্ষতলে রাখা ছিল সাদা কাফনে শিল্পীর কফিন। শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় সেই কফিনের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন শিল্পীর সহযাত্রীরা। সেখানে ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফসহ তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, সাফিন আহমেদ, মানাম আহমেদ, রবি চৌধুরী, কবির বকুল, আইয়ুব বাচ্চুর ছোট ভাই ইরফান চৌধুরী প্রমুখ। এক মিনিটের নীরবতা পালনের মাধ্যমে শেষ হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠে। সেখানে বাদ জুমা অনুষ্ঠিত হয় প্রথম নামাজে জানাজা। সেখানেও নামে মানুষের ঢল। বিশাল মাঠের প্রায় পুরোটাই ভরে যায় জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের উপস্থিতিতে। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় আইযুব বাচ্চুর অনেক সৃষ্টির সাক্ষী মগবাজারের রেকর্ডিং স্টুডিও এবি কিচেনে। সেখানকার পার্শ্ববর্তী সড়কে দ্বিতীয় জানাযা শেষে নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁওয়ের চ্যানেল আই ভবনে। সেখানেও শিল্পী, শুভার্থী ও সহকর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাদ আসর তৃতীয় জানাজা হয়। এরপর এবির নিথর দেহখানি রাখা হয় স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে। আজ শনিবার ভোরে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাপ্রবাসী তার দুই ছেলে-মেয়ের ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। তারা আসার পর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে শিল্পীর জন্মভূমি চট্টগ্রামে। সেখানে চতুর্থ জানাজা শেষে এনায়েত বাজারের পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন শিল্পী। পারিবারিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। শহীদ মিনারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আইযুব বাচ্চুর শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। আইয়ুব বাচ্চুর সহশিল্পীসহ সঙ্গীত ও সংস্কৃতি জগতের বিভিন্নজনের কথায় উঠে আসে দেশের সঙ্গীত ভুবনে আইয়ুব বাচ্চুর অবদানের কথা। আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ব্যান্ডসঙ্গীতে তিনি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। এ কারণেই তিনি সবার ভালবাসা পেয়েছেন। শিল্পী হিসেবে তিনি পরিণত হয়েছেন এ দেশের সম্পদে। তার চলে যাওয়া একেবারেই আকস্মিক। সঙ্গীত ভুবনে তিনি শূন্যতা রেখে বিদায় নিলেন। আমার বিশ্বাস, নতুন প্রজন্ম তার দেখানো পথে চলে নবচেতনায় উজ্জীবিত হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, সঙ্গীতে তিনি নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন। গানের মাধ্যমে কষ্ট, বেদনাসহ জীবনের নানা অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তার গিটারের সুরে উচ্ছ্বসিত হয়েছে লাখো শ্রোতা। জীবনভর মগ্ন ছিলেন সঙ্গীত সাধনায়। নতুন প্রজন্ম বয়ে নিয়ে যাবে তার এই সুরের সাধনাকে। নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, শিল্পী হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তরুণ প্রতিনিধি। এই শিল্পী সঙ্গীতে নতুন ভাষা দিয়েছেন। আগামী প্রজন্ম তার সঙ্গীত ধারাকে অনুসরণ করবে। সুরের আম্রয়ে তিনি জাতীয় ঐক্য গড়েছেন। তার এই মৃত্যু আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে ও শক্তি দিয়েছে। তপন চৌধুরী বলেন, এই শহীদ মিনারে এত মানুষ ভালবাসা জানাতে এসেছেন- এটাই একজন শিল্পীর জীবনে অনেক বড় প্রাপ্তি। ব্যান্ডদল ফিডব্যাকের ফোয়াদ নাসের বাবু বলেন, গানের জন্য তার পরিশ্রম, সাধনা ও প্যাশন ছিল সর্বক্ষণিক। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে একজন আইয়ুব বাচ্চু। গিটারের অবিরাম সুরের মুর্ছনায় আইয়ুব বাচ্চু ভক্তদের মাতিয়ে তুলতেন। তার গিটার বাজানো শুনে দেশের হাজার হাজার তরুণ গিটার বাজাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, গিটার বাজানো শিখেছে। জিঙ্গেল কন্যাখ্যাত সুমনা হক বলেন, আশির দশক থেকে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে কাজ করেছি। কত শত স্মৃতি! সব স্মৃতি একটি একটি করে হৃদয়ে বাজছে। সঙ্গীত সাধনা ও জনপ্রিয়তার চূড়ায় থাকতে থাকতে তিনি চলে গেছেন। এই যে হাজার হাজার মানুষের ভালবাসা, শ্রদ্ধা জানাতে তাদের উপস্থিতি এটাই তার অনেক বড় প্রাপ্তি। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, এই দেশে আইয়ুব বাচ্চুর কোটি কোটি ভক্ত রয়েছে। তার গিটারের সুরে মুগ্ধ হয়েছে অগণিত শ্রোতা। যে গানগুলো তিনি রেখে গেছেন সেইসব গান এদেশের চিরকালের সম্পদ হয়ে থাকবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুনবে সেই গান। আইয়ুব বাচ্চুকে সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), বাসদ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ (জাসদ), ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী, যুবমৈত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন, সিলেট সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড এ্যাসোসিয়েশন (বামবা), স্থপতি ’৭১, ফেসবুক গ্রুপ ‘দুষ্টু ছেলের দল’, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম সমিতি ঢাকা, পটিয়া সমিতি ঢাকা, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদ, সমস্বর, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, একতা কালচারাল সোসাইটি, উদীচী, পথনাটক পরিষদ, প্রাচ্যনাট, বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিষদ, যুবসংহতি, ব্যান্ড দল ‘কিংবদন্তি’, মিউজিশিয়ান্স ফাউন্ডেশন, কুমিল্লার কাগজ, স্রোত আবৃত্তি সংসদ, ছাত্রলীগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখাসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদ একাংশের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য শিরীন আখতার, মুক্তিযদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর, অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফা, সাংবাদিক মুন্নী সাহা, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অনিমা রায়, আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ, ম. হামিদ, নাট্যজন ইনামুল হক, সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, অভিনয়শিল্পী শংকর সাঁওজাল, ফিডব্যাকের ফোয়াদ নাসের বাবু, শিল্পী সুমনা হক, অর্থহীন ব্যান্ডের লড ভোকাল সুমন, বামবার সাধারণ সম্পাদক মনিরুল আলম টিপু, অবসকিউরের সাইদ হাসান টিপু, তানযীর তুহিন, আইয়ুব বাচ্চুর অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী প্রমুখ। আজ চট্টগ্রামে সমাহিত হবেন এবি ॥ নিজ জন্মস্থান চট্টগ্রামের আজ শনিবার নামাজে জানাজা শেষে মায়ের কবরের পাশে সমাহিত হবেন আইয়ুব বাচ্চু। জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) তত্ত্বাবধানে। ঢাকা থেকে মরদেহ চট্টগ্রামে আসার পর সকালে প্রথমে নিয়ে শবদেহ যাওয়া হবে নগরীর মাদারবাড়ি এলাকায় এবির নানার বাড়িতে। সেখানে তাকে শ্রদ্ধা জানাবেন ওই এলাকার মানুষ। এরপর বাদ আসর নামাজে জানাজা সম্পন্ন হবে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ ময়দানে। জানাজার পর স্টেশন রোডের চৈতন্য গলি বাইশ মহল্লা কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে চিরশায়িত হবেন আইয়ুব বাচ্চু। এ তথ্য জানিয়েছেন জনকণ্ঠের চট্টগ্রাম অফিস। চসিক মেয়র আ জ ম নাছির বলেন, জনপ্রিয় সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব আইয়ুব বাচ্চু চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান। এই নগরীতেই তার বেড়ে ওঠা। চট্টগ্রামবাসী এই শিল্পীর জন্য গর্বিত। সেই গর্বিত সন্তানের শেষ যাত্রায় পাশে থাকবে সিটি কর্পোরেশন। ঢাকা থেকে মরদেহ আনা থেকে শুরু করে জানাজা এবং দাফন পর্যন্ত সকল কাজই কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হবে। ঢাকার পর চট্টগ্রামের মানুষও সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে শেষবার দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। প্রিয় মানুষটির মরদেহ এলে মাদারবাড়ি এবং জমিয়তুল ফালাহ মাঠে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে হাজারো মানুষ। সেজন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চসিক।
×