শ্যাওলা পড়া ভাঙ্গা দেয়াল, খড়খড়ি ও শিকবিহীন জানালা আর উঠোন বলতে ছোট বড় আগাছার জঙ্গল, এটি আমার রাজ্য। আমার সবটুকু বেড়ে ওঠা, ভাবনা, গল্প, স্মৃতি, এই বাড়িটি ঘিরে, এখন এটি ভাঙ্গা পুরনো দালান তবে এটি এমন ছিল না! এক-কালে জমিদার বাড়ি ছিল, আমি সেই জমিদার বাড়ির দাপুটে অহঙ্কার দেখিনি তবে আমার এখানে যখন জন্ম তখনও বাড়িটির দেয়াল চক চক করত। হঠাৎ সোরগোল সুরু হলো এ বাড়ির লোকজন সব বেরিয়ে পড়ল! দিন গেল রাত গেল, সপ্তাহ মাস এরপর বছর, এ বাড়ির লোকজন আর ফিরল না। চারদিক স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা জমে উঠেছে, কিছু আগাছা কোথাও কোথাও উঁকি দিচ্ছে, মাঝে মধ্যে কিছু কোলাব্যাঙ, সাপ, বেজির দেখা মেলে। কিছু দিনের জন্য কাকেরা বাসা বেঁধেছিল ওরাও থাকেনি, দূরে কোথাও নগর হচ্ছে ওখানে নাকি খাদ্যের প্রাচুর্য তাই এখন তাদের বসবাস ওখানেই। কখনও কখনও হাহাকার লাগলেও মাঝে মধ্যেই মনে হয় বেশ আছি, আমি আর এই বাড়ি অগাধ স্বাধীনতা। একাকিত্ব উপভোগ করলেও একঘেয়ে লাগে আর এই একঘেয়েমি কাটাতে কোথা থেকে নতুন অযাচিত অতিথি এসে জুটল, বিকেল থেকে সন্ধ্যা অব্দি থাকলেও ওরা রাত্রি-যাপন করত না। ওরা মোট চারজন ছিল মাঝে মধ্যে আরও একজন এসে যোগ দিত। একদিন ওরা অনেক রাত পর্যন্ত ছিল সেদিন কি গ-গোল শেষ রাতে চারজন মিলে একজনকে মেরেই ফেলল। আমার গা ঘেঁষে দুদিন ধরে নিথর যুবকটি পড়ে রইল এরপর সে কি কা- কত লোক নাকে কাপড় দিয়ে আসছে আর যাচ্ছে, কি যেন অবাক হয়ে দেখছে, চেনা কেউ চোখে পড়ছিল না দুজনকে চোখে পড়ল শ্যামল আর সলেমান এদের অনেক ছোট্ট দেখেছি এ বাড়ির লোকেরা এদের খুব আদর করত! এদের দুজনকে মনে হতো এক মায়ের পেটের দু’ভাই কিন্তু এবারে তা মনে হলো না দুজনের চোখে সেই সরলতা নেই! সলেমান এর মুখে দাড়ি গজিয়েছে আর শ্যামলের চাদির টিকিতে পুচ্ছ-গোছের চুল সে যাই হোক অবাক হলাম, কেউ কারও সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলল না যাকগে বড় হয়েছে কত সাংসারিক সমস্যাই থাকতে পারে। এমন পরিবর্তন হওয়া মানুষ আমি আগেও দেখেছি। এরপর ইউনিফর্ম পরা কিছু মানুষ নিথর যুবকটিকে নিয়ে গেল সেই থেকে এ বাড়িতে আর কেউ আসে না। কালে-ভদ্রে রাখাল বা পথচারী ঢুকে পড়ে এই-যা। বড্ড একা হয়ে গেলাম মাঝে-মাঝে ভাবতাম এতই হতভাগা-কপাল আমার যে বাড়িতে আমি জন্মেছি যার ঐতিহ্য কেউ রক্ষা করল না, কেউ জানল না এর দেয়ালে-দেয়ালে কত ইতিহাস, আবার নিজে নিজেই গর্ববোধ হয় এখানে আমিই রাজা বাড়িটি তার অহঙ্কারে দাঁড়িয়ে থাকলে আমার মহিমা হয়ত কমে যেত! ব্যাপারটা দ্বিধা তৈরি করে, দ্বিধায় দ্বিধায় জট, একি আমার মাথায় জট ধরা শুরু করেছে। জটা যখন ধরেছে বয়স ক্রমশ বাড়ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার জটা মাটি ছুঁই ছুঁই, আশপাশের দেয়ালজুড়ে পরগাছারা ভর করেছে। কিছু পরগাছা আমার জটার পাশে কু-ুলি পাকাচ্ছে। ওরা কেউ আমার কথা বোঝে না। আমি গাধার সামনে গান গাইবার মতো অবিরাম ওদের সঙ্গে কথা বলি! এরই মধ্যে কিছু পরগাছা আমার জটা বেয়ে ঘাড়ে উঠেছে ওরা আমার ভাষা পুরোপুরি না বুঝলেও অনেকটা ঠাহ্র করে নেয়। রাত-দিন ওদের সঙ্গে আলাপ হতো, একটি পরগাছা বেশ পরিপক্ব হয়ে উঠল ওকে একদিন বুদ্ধি দিলাম, আচ্ছা তুমি তো আমার ভাষা বোঝ, একটা কাজ কর তুমি বটগাছ হয়ে যাও। পরগাছা বন্ধুটি অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। পাশের বন্ধুরা খিল খিল করে হেসে উঠল। ও ফিস্ ফিস্ করে আমার কানে বলল আমি কি পারব। আমি ওর কথা শুনে হতবাক, এবার বকার সুরে বললাম আমি পারলে তুমি কেন পারবে না। ও বলল আচ্ছা বটগাছ হয়ে কি লাভ? আমি এবার হতাশ হলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে কি সব লাভের জন্য হতে হয়? ও বলল না মানে একটা কারণ তো আছে? আমি ...হু আছে। আমার মতো অন্যকে ছায়া দিয়ে আলগে রাখবে। আর আমার লাভ, তুমি দীর্ঘকালের জন্য আমার সাথী হয়ে রবে। আমি আমার সুখ-দুঃখে কথা তোমায় বলতে পারব। ওর মুখে আনন্দ দেখতে পেলাম, ও অবাক হয়ে বলল আমি দীর্ঘকাল বাঁচব! বেশ আমি বটগাছ হব। আমি আস্বস্ত হলাম, এবার একটা সঙ্গী পাওয়া গেল। এবার একটি বটগাছ আরেকটি বটগাছকে তার সহযাত্রী হিসেবে পাবে। পরগাছা বন্ধুটির স্বাস্থ্য বাড়তে থাকল, আমি প্রতিদিন দেখি আর মনে মনে খুশি হই, এবার হবেই। এক সময় লক্ষ্য করলাম ওর স্বাস্থ্য বাড়ছে কিন্তু ও দাঁড়াবার চেষ্টা করছে না। আরও কিছুদিন অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু নাহ্ ওর কোন চেষ্টাই নেই, বেশ বিরক্ত হয়ে ওকে বললাম- কি ব্যাপার বন্ধু তুমি শুয়ে থাকলে তো চলবে না একটু দাঁড়াবার চেষ্টা কর। পরগাছা উত্তরে বলল ওটাতো আমার জাতে নেই। এই প্রথম জাতের কথা শুনলাম খুব অবাক হলাম, এটা আবার কি বাবা, নাম আলাদা হয় জানতাম কিন্তু.. .. .. .. আমি জিজ্ঞেস করলাম- এই জাত জিনিসটা কি? পরগাছা মৃদু হেসে বলল এইযে তুমি একা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছ আর আমি স্বাধীন যেদিকে খুশি যেতেপারি,কাল-অব্দি তোমার ওপর আজ ছাদে। নিথর ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা তোমার ধর্ম তোমার জাত আর আমার ধর্ম কখনও এদিক কখনও সেদিক.. আমার ইচ্ছে মত আমি যায়গা বদল করতে পারি । যার সঙ্গে ইচ্ছে সর্ম্পক তৈরি করতে পরি আবার বিচ্ছেদটাও আমার কাছে তুচ্ছ, কারণ আমাদের বিভিন্ন সময় দাঁড়াবার আশ্রয় ভিন্ন আর তাই আমরা নিজ থেকে দাঁড়াবার চেষ্টাও করি না। ওর কথাতে যুক্তি ছিল তাই নিজেকে বেশ বোকা মনে হচ্ছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা তাহলে তুমি আমায় কথা দিয়েছিলে কেন।পরগাছা হাসতে হাসতে জবাব দিল ভেবেছিলাম বটগাছ হওয়ার ওছিলায় যদি একটু আয়ু বাড়ে তাতে দোষ কি, আর তা ছাড়াও তখন আমি তোমায় ভর করে ছিলাম, তোমাকে খুশি করা আমার দায়িত্ব ছিল। শুনে আমি একটু শান্তি পেলাম, আমি ভেবেই নিয়েছিলাম উত্তরটা এমনি হবে, এবারে নিজেকে বোকা ভাবার দায়টা একটু ঘুচল। মনে মনে রাগ হচ্ছিল তবুও জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা তাহলে এই বটগাছ বন্ধু আমি কোথায় পাব। পুনরায় পরগাছা হেসে বলল- তুমি তো দেখছি বোকা, তোমরা কালে ভদ্রে দূর-দূরান্তে জন্মাও তোমাদের কেউ বন্ধু হয় না, তোমরা একা, কালের সাক্ষীমাত্র। পরগাছা বন্ধুটির কথায় বেশ আহত ও অবাক হলাম। সেদিন আকাশে মেঘ করেছে, আকাশ দেখে বুঝলাম বেশ জোরেশোরে বৃষ্টি নামবে হঠাৎ সন্ধ্যায় দক্ষীণা ঝড় এল সারারাত কিছুই দেখলাম না শুধু বুঝলাম অনেক পরগাছা এসে জমেছে আমার পায়ের গোঁড়ায়। ভোর নাগাদ ঝড় থামলো, নীলাভ মৃদু আলোয় চারদিক বেশ তছনছ হয়েছে বুঝলাম একটু আলো বাড়তেই বন্ধুদের খুঁজছি কিন্তু আমার দুটো বন্ধুকে দেখছি না, চোখ ঘোরাতেই দেখলাম আমার সবচেয়ে কনিষ্ঠ বন্ধুটি ব্যথা পেয়ে কু-ুলি পাকিয়ে ভাঙ্গা ইটের স্তূপের পেছনে জায়গা করে নিয়েছে আর আমার প্রিয় তরতাজা হয়ে ওঠা বন্ধুটি আমার একটি শুকিয়ে যাওয়া ভাঙ্গা শাখার সঙ্গে পেঁচিয়ে দূরে পড়ে আছে। আহ্ ওর তো এমন হওয়ার কথা ছিল না, ছাদটা তো নিরাপদই ছিল। ওমা ছাদটাও নেই। বিষণœতা আবার আঁকড়ে ধরতে চাইছে, এরই মধ্যে চোখে পড়ল ভাঙ্গা দেয়ালের ওপাশে গোটা দশ-পনেরো পাতা নিয়ে একটি ছোট্ট গাছ চক-চক করছে। ছোট্ট গাছটির পাতা দেখে বুঝলাম ওটি আমার জাতের এই বিষণœতার মাঝেও মনের মধ্যে আলোর ঝলকানি দিয়ে উঠল, যাক অবশেষে কালে ভদ্রে জন্মানো গাছটি কাছে-কোলেই পাওয়া গেল। ওকে দেখে দেখে দিন কাটতে লাগল। ওর জন্য বড্ড মায়া হতো ভাবতাম ও বড় হবে ওর-ও অনেক পরগাছা বন্ধু হবে, বন্ধুটা মাঝ-পথে হারিয়ে যাবে হয়ত, নইলে আমার বন্ধুটির মতো প্রাণ হারাবে অথবা অন্যত্র আশ্রয় নেবে। ওকেউ তো কালের সাক্ষী হয়ে কষ্টের বোঝা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সে যাই হোক আমায় একা তো আর ঝড়-বাদলার ঝাপটা পোহাতে হবে না। ও বড় হলে আমার সহায়ক হবে বাকিটা আমার বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে সামলে নেব, সমস্যা হবে না। পাছে ভয়ও হয় আবার যদি ওকেও হারিয়ে ফেলি, নাহ্ আসলে এ বাড়িতে আমার রাজত্ব মানায় না। এটা জমিদার বাড়িই ভাল ছিল, না ছিল পরগাছা, না ছিল শ্যাওলা।
ইস্ কী আনন্দই না ছিল তখন, আজও সেই আনন্দ-কলরবের স্মৃতি মনে পড়ে, শ্যামল আর সলেমানের দাঁপিয়ে বেড়ানো, রাজা কাকুর বায়োসকোপ দেখানো, হরিপদের বাউল গান, আশরাফের ছড়া, আবুল হোসেনের নাট-সংলাপ, আহা ..কি দিন ছিল। পরগাছা আর ভাল লাগে না, এরা আপন হয় না আর শ্যাওলারা ঘাপ্টি মেরে থাকে, এদের কোন বিকার নেই। মাঝে মাঝে কোলা-ব্যাঙরা সোরগোল করে ওদের চেঁচামেচি সাপেদের আক্রমণে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। আহ্ এগুলো আর ভাল লাগে না। বহুদিন মানুষ দেখি না মানুষ দেখতে চাই। ছোট্ট বটটি বেড়ে উঠছে। প্রায় এ বাড়িটি এখন নিস্তব্ধই থাকে, নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে একদিন কেত্থেকে তিনজন লোক এল, পুরনো বাড়িটির ভুলভাল ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে করতে আমার হবুসাথী ছোট্ট বটগাছটির কছে এগিয়ে গিয়ে আনন্দে আলোচনা করতে লাগল ওটাকে ওরা বনসাই বানাবে। এ তো দেখছি নতুন শব্দ। আশপাশের পরগাছাদের জিজ্ঞেস করলাম বনসাই কী? কেউ বলতে পারল না। ওমা.. .. ওরা আমার ছোট্টগাছটিকে উপড়ে নিয়ে গেল, আমি নির্বোধের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম, কিছুই করতে পারলাম না। এও বড় শরীর আমার তারপরেও পারলাম না, আমি তো ভুলেই গেছিলাম আমি যে একটা বটগাছ... আবার সেই শূন্যতা। পুনরায় নতুন পরগাছা এসে জুটল আমার ডালে ..এবারে কিন্তু কাউকে বটগাছ হতে বলিনি ....
শীর্ষ সংবাদ: