ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষক মায়ের নিজেকে তৈরি করা

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

শিক্ষক মায়ের নিজেকে তৈরি করা

শিক্ষকতা মহান পেশা- এই চিরায়ত বোধকে এখনও লালন করেন অনেক শিক্ষিত নারী। আধুনিকতার দুর্বার স্রোতে, তথ্যপ্রযুক্তির নিরন্তর অগ্রগামিতায় নারীর কর্মক্ষেত্র আজ আর কোন সীমাবদ্ধ আলয়ে আটকে নেই। বিমান চালনা থেকে শুরু করে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সময়োপযোগী অংশীদারিত্ব, যুগের আবেদনে সম্পৃক্ত হতে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা আজ নারীদের অবারিত কর্মক্ষেত্র দেশে-বিদেশে সম্প্রসারিত। এরপরও শিক্ষকতাই সর্বোত্তম পেশাÑ এমন চেতনা ধারণ করা নারীর সংখ্যাও হাতে গোনার মতো নয়। মোহসেনা আক্তার সুমিও মনে করেন সবচাইতে পছন্দের কাজ শিক্ষকতা নিয়ে তিনি তৃপ্ত, আনন্দিত। বিস্তারিত জানাচ্ছেন নাজনীন বেগমÑ মোহসেনা আক্তার সুমি একজন শিক্ষকই শুধু নন তিন সন্তানের জননীও। বাবা সরফুদ্দিন আহমদ। মা হোসনেয়ারা বেগম। পুরান ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা সুমি। ফলে পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ কোনভাবে নারী শিক্ষার অনুকূলে ছিল না। কিন্তু মায়ের অনুপ্রেরণা সমাজ সংস্কারের রক্ষণশীল মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষার মতো অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গনটিতে অনুপ্রবেশ করতে তাকে বেগ পেতে হয়নি। মা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হলেও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় বেশি দূর এগুতে পারেননি। উদীয়মান কিশোরী মার বিয়ে হয়ে যায় অল্প বয়সে। যৌথ পরিবারে গড়ে ওঠা সুমি অতি বাল্যকাল থেকে প্রত্যক্ষ করতেন মায়ের কি অদম্য ইচ্ছে মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে সুমি সন্দিহান ছিলেন শেষ অবধি মায়ের লক্ষ্যে নিজেকে তৈরি করতে পারবেন কিনা। সব ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে নিজের অনমনীয় মনোবল আর মায়ের প্রত্যাশার সম্মান রাখতে জোর কদমে সামনেই এগিয়ে চললেন। আকাক্সিক্ষত ফল আসতেও দেরি হলো না। অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ১৯৯৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উইমেন ফেডারেশন কলেজ, ধানম-িতে ভর্তি হন। ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে ইডেন গার্লস কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে (সম্মান) এর ছাত্রী হিসেবে শিক্ষার্থী জীবনের সুবর্ণ সময়গুলো পার করতে থাকেন। স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করার পর জীবনে শুরু হলো আর এক নতুন যাত্রা। জিএম মেজবাহ উদ্দিন রনকের সঙ্গে পারিবারিক গ্রন্থি বন্ধনে ভিন্ন এক জগতে পা রাখলেন। আরম্ভ হলো আর এক অভিযাত্রা। বিবাহিত জীবন কোন বাধা প্রতিবন্ধকতা তো তৈরিই করল না বরং নবোদ্যোমে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জিত হলো নির্বিঘœ আর নিঃসংশয়ে। শ্বশুর-শাশুড়ি দু’জনই উচ্চশিক্ষিতই শুধু নন ঢাকার বিখ্যাত দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকও। শ্বশুর ড. গোলাম মহিউদ্দিন বুয়েটের এবং শাশুড়ি এএন রাশেদা নটর ডেম কলেজের অধ্যাপক। ফলে মায়ের স্বপ্ন আর শাশুড়ি মায়ের স্নেহাশীবাদে নিজের শিক্ষা জীবন শেষ করতে কোন বেগ পেতে হয়নি। শিক্ষক পরিবারে বিয়ে হওয়া সুমি পরবর্তী সময়ে জীবন চলার পথকে যেভাবে মসৃণ আর অবারিত করেছেন তা উল্লেখ করার বিষয়। শাশুড়ি বউমার চিরায়ত টক-ঝাল সম্পর্কের যে বাঙালিত্ব ধারা সেখানে সুমির ব্যাপারটি একটু ভিন্ন মাত্রার। দুই প্রজন্মের যে নতুন সম্পর্ক গ্রথিত হয় বিয়ের মাধ্যমে বিশেষ করে শাশুড়িÑ বউ এর পথ পরিক্রমা সেখানে ছেলে পর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সব সময় মাকে মানসিকভাবে অসহায় করে রাখে। শাশুড়ি এএন রাশেদা শুধু শিক্ষকই নন একজন বিশিষ্ট গুণীজনও। ফলে চেতনায় আদর্শে সমতাভিত্তিক সমাজের যে সমৃদ্ধ বোধকে লালন করেছেন পুত্রবধূর বেলায় সেখান থেকে সামান্যতমও চ্যুত হননি। ফলে বধূ হিসেবে নয় মেয়ে এবং মানুষ হিসেবে সুমি তার সমস্ত প্রাপ্তি আর অধিকার পেয়েছে। বাংলার ঘরে ঘরে যদি এমন চিত্র দেখা যেত তাহলে নারী প্রগতির দ্বার রুদ্ধ করার ক্ষমতা ও সাহস কারও ছিল না। বাঙালী মেয়েদের বিয়ের আগে আর পরের জীবনে এত ফারাক থাকে যে কেউ তাদের আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যেতে অনেক সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। এক্ষেত্রে সুমি উচ্ছ্বসিত এবং আনন্দিত যে বিয়ের পর তাকে কোন সঙ্কটে পড়তে হয়নি পারিবারিক সীমাবদ্ধতায়। তিনি বলেন, শৈশবে এক মা তাকে স্বপ্নের ভিত তৈরি করে দেন বিয়ের পর অন্য মা তার প্রত্যাশাকে পূর্ণ করে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেত সব ধরনের চেষ্টা করে যান। সন্তান এবং নিজের কারণেই শিক্ষকতার মতো পেশাকে বেছে নিতে হয়। তিন সন্তানের জননী সুমি সাউথ পয়েন্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজ, বারিধারা শাখার সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বড় ছেলে ও মেয়ে যথাক্রমে নবম ও তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে একেবারে শিশু। ছেলেমেয়ে সামলিয়ে, সংসারের প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সম্পন্ন করে কর্মজীবনকেও সুষ্ঠু স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারছেন। এখনও সুমির মনে হয় শিক্ষকতাই মেয়েদের জন্য সবচাইতে উপযোগী পেশা সমাজ সংস্কারের রক্ষণশীল মনোভাবের জন্য। তবে অন্যান্য পেশায় মেয়েদের যে অবাধ ও সময়োপযোগী অংশগ্রহণ তাকেও আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান মোহসেনা আক্তার সুমি। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×