ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আন্তর্জাতিক মানে গড়ার উদ্যোগ

কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাস হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাস হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের

ওয়াজেদ হীরা ॥ নানা সমস্যায় জর্জরিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিকমানের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর সে লক্ষ্যে সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় নতুন একটি ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নে ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ টাকার মেগাপ্রকল্প অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০০ একর জায়গায় নির্মিত হবে আন্তর্জাতিকমানের আধুনিক সুবিধা সংবলিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাবে উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ। শিক্ষকরা পাবেন গবেষণার সুযোগ আর পুরান ঢাকাবাসী পাবেন যানজট থেকে কিছুটা স্বস্তি। এমন প্রকল্প পেয়ে খুশি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। ছোট ক্যাম্পাস, একাডেমিক ভবনের ক্ষেত্রেও রয়েছে স্বল্পতা। এমনকি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আবাসন সঙ্কটও চরমে। রাজধানীর পুরান ঢাকা নানা ধরনের ব্যবসা আর মানুষের কারণে এমনিতেই ঘিঞ্জি পরিবেশ। তার ওপর রয়েছে সদরঘাট টার্মিনাল। হাজারও মানুষের চলাচল যে সড়কে প্রতিনিয়ত সেখানেই অবস্থিত জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ও। নানা শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর চাপে প্রতিনিয়ত যানজট এই জনসন রোডে। একই সঙ্গে বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়ন বা বর্ধিত করার জন্য জায়গাও স্বল্প। এমন অবস্থায় জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জে। সেখানে ২০০ একর জায়গায় নির্মিত হবে উচ্চশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই বিদ্যাপীঠটির স্থায়ী ক্যাম্পাস। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও জগন্নাথ বিদ্যালয় প্রশাসন ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন : জমি অধিগ্রহণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। গত ৯ অক্টোবর একনেক সভায় এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এর আগে গত ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়ে বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেরানীগঞ্জে আন্তর্জাতিকমানের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এ জন্য যত কিছু লাগে সব সরকার থেকে নিশ্চিত করা হবে। সেই সভায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নে একটি প্রকল্প পেশ করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাত একর বা দশ একর দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আবাসনসহ অন্যান্য সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কমপক্ষে ১০০ একরের মতো জমি লাগবে। কেরানীগঞ্জে সে জমির ব্যবস্থা করতে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ বিপুকে দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরি করে তা উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। এর পর গত ৯ অক্টোবর একনেক সভায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন একটি ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নে ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। জানা গেছে, মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নতুন ক্যাম্পাসে একাধিক একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ছাত্রছাত্রীর জন্য হল, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আবাসন ব্যবস্থা, চিকিৎসা কেন্দ্র, কাফেটারিয়া, খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, মসজিদ এবং পরিবহন ও আধুনিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়টি ৭.৫ একর জমির ওপর সরকারী জগন্নাথ কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ২০০৫ সালে সরকারী প্রজ্ঞাপনে পূর্ণাঙ্গ বিশ^বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পেয়ে ২০০৫-২০১১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারী জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এরপর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা স্থান সঙ্কট। বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৪০টি একাডেমিক বিভাগে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। শিক্ষক রয়েছেন ৭শ’ জনের বেশি। বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে বিপুল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। সঙ্কট নিরসনে জুলাই মাসের ১১ তারিখে অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে কেরানীগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। এর আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন এবং ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন, অবকাঠামো স্থাপন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের জন্য প্রকল্পটি নেয়া হয়। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য উন্নত শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত হবে, মৌলিক ও প্রায়োগিক শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ-সুবিধা তৈরি হবে। জানা গেছে, সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে চলতি বছর থেকে ২০২০ জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়িত হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাস হলেও পুরান ঢাকার চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী পুরনো ক্যাম্পাসও থাকবে। সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে এটির বিদ্যমান স্থাপনাগুলো ব্যবহৃত হবে। এদিকে, একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে আধুনিক ক্যাম্পাস হওয়ার খবরে তারা বেশ খুশি। মূলত একটি বিশ^বিদ্যালয়ের যে কাজ পড়াশোনা ও গবেষণা এটি ভালভাবে করা যাবে। রাহাত আদনান ও তার বন্ধুরা বলেন, আমরা চাই ভাল পরিবেশে মানসম্মত শিক্ষা। এখানে নানা ধরনের সঙ্কট। আর সকল শিক্ষার্থীর সমস্যা হয়। সঙ্কটের মধ্যে মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। আমাদের পরে যারা আসবে তারা বিশ^বিদ্যালয়ে ভাল পরিবেশ পাবে। সাংবাদিকতায় মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সুলতানা জাহান বলেন, যদিও আমরা পাব না তবে আমার মনে হয় বিষয়টি লেখাপড়ার জন্য অনেক ভাল হবে। শিক্ষার্থীরা আবাসিক সুবিধা পাবে সবার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে। স্মৃতি রক্ষার্থে প্রশাসনিক কার্যক্রম এখানে চলতে পারে। তবে সার্বিকভাবে জগন্নাথের জন্য এত বড় প্রকল্প একটি স্বপ্নই বটে। শিক্ষার্থীদের খাওয়ার চিন্তা করলেও তখন হয়ত থাকার চিন্তাটা থাকবে না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি তরিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এখানে আমাদের অনেক স্মৃতি আছে। আমরা চাই কিছু না কিছু স্মৃতি থাকুক। তবে সরকার যে প্রকল্প নিয়েছে আমাদের নেত্রী যে প্রকল্প দিয়েছে এটি অন্ধের চোখে দৃষ্টি দেয়ার মতো। কেননা, এই বিশ^বিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধা নেই। সেখানে উন্নয়ন চাওয়ার পর শুধু হল নয় অনেক কিছুই করে দিচ্ছেন, এই তৃপ্তিটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জয়নুল আবেদীন রাসেল বলেন, জগন্নাথের এমন প্রকল্পের জন্য জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে অভিনন্দন। এই আনন্দের ভাষা কিভাবে প্রকাশ করব, জানি না। যদিও এই যে নতুন নতুন ভবন, হল হবে সেসময় আমরা থাকব না; তবে জগন্নাথের উন্নয়ন হবে, ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা সুবিধা পাবে সেটি আমাদের প্রিয় নেত্রীর হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি ভাবতেই ভাল লাগছে। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাসটি হবে। আমরা জানি, এখানে জায়গার স্বল্পতা, তাই নতুন জায়গা দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পাস এখানে থাকবেই না এ রকম শুনিনি। আর নতুন ক্যাম্পাস হতে আরও কয়েক বছর লাগবে। দশ বছর পর কি করা হবে সেটি নিয়ে এখনই ভাবতে চাই না। নতুন ক্যাম্পাস হলে বিষয়টি পরে দেখা যাবে। পুরাতনের বিনিময়ে নতুনের গুঞ্জন ॥ পুরাতন জগন্নাথ ক্যাম্পাসের বিনিময়ে নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন প্রকল্প অনুমোদনের গুঞ্জন উঠেছে। প্রকল্প পাশের পর থেকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে এই গুঞ্জন চলছে। তবে এমন কোন শর্ত হয়নি বলে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। এই গুঞ্জন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেলে অনেক শিক্ষার্থী ক্ষোভও প্রকাশ করছেন। জবির শিক্ষার্থী দ্বারা পরিচালিত জবিয়ান’স পেজে লেখা হয়েছে, উন্নয়নের নামে জগন্নাথকে পঙ্গু করার পাঁয়তারা আমরা ভাল করেই রোধ করতে পারি। পুরাতন ক্যাম্পাসের ঐতিহ্য আর ভালবাসা নিয়েই জগন্নাথ এ দেশে মাথা উঁচু করে থাকবে। ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ পেজে লেখা হয়েছে. স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, ঐতিহ্যবাহী জবির বর্তমান ক্যাম্পাস জবির মূল ক্যাম্পাসই থাকবে, কেরানীগঞ্জে ক্যাম্পাসের নাম হবে জবি আউটার ক্যাম্পাস বা ২য় ক্যাম্পাস বা অন্য কোন নামে। এখানে(বর্তমান ক্যাম্পাসে) অবশ্যই একটি / দুটি ফ্যাকাল্টি বা ইনস্টিটিউট রাখতে হবে। মূল ক্যাম্পাস পুরান ঢাকাতেই থাকবে। জবিকে ঢাকার বাইরে পাঠানোর চক্রান্ত করে লাভ নেই। ঢাকার বাইরে আছে জাহাঙ্গীরনগর, এখন জবিকে ঢাকার বাইরে কিক করে ঢাকায় সাম্রাজ্য বানানোর চক্রান্ত করে লাভ নেই। যেভাবে ২৭/৪ বাতিল করতে বাধ্য করা হয়েছিল সেভাবেই বাধ্য করা হবে। সরকারে বা জবি প্রশাসনে যারাই থাকেন, এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার কথাও বলা হয়েছে ঐ স্ট্যাটাসে। তবে জবির শিক্ষক এমনকি উপাচার্যও জানিয়েছেন, কোন শর্তের বিনিময়ে কোন প্রকল্প হয়নি। একাধিক শিক্ষক কান কথায় গুরুত্ব না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
×