ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য টিকে থাকা নিয়ে সংশয়

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য টিকে থাকা নিয়ে সংশয়

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নামে শুরু করে এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হয়েছে। বর্তমানে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার প্রয়াসে এই ঐক্যফ্রন্ট গঠন হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ ফ্রন্ট নিয়ে বহুমুখী আলোচনা চলছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়টি আলোচনায় এসেছেÑ অতীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একবার এককভাবে এবং দ্বিতীয়বার জামায়াতের সঙ্গে জোটবেঁধে সরকার পরিচালনা করার পর এ দলটি এখন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণে গেছে। এ ঘটনা নিয়ে খোদ বিএনপিতে যেমন মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে তেমনি সাধারণ ভোটারের মনে দানা বেঁধেছে নানামুখী সন্দেহের। অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত বৃহস্পতিবার বলেছেন, জিরো জিরো জিরো মিলে একটি জিরো। তার বক্তব্যটি বেশ তাৎপর্যবহ বলে রাজনৈতিক অঙ্গনের বোদ্ধারা আলোচনায় এনেছেন। এছাড়া সরকারী দল আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই এ ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে নানামুখী সমালোচনায় মুখর। ঐক্য প্রক্রিয়ার শুরুতে ভাঙ্গন ধরার বিষয়টিও লক্ষণীয়। সঙ্গত কারণে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠছে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তৎপরতার সুফল নিয়ে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনেও আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে সর্বমুখী আলোচনা সরব হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট এ নির্বাচনে বিরোধী সকলের টার্গেট। এখন নতুন নামে পুরনো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এক হয়ে এ জোটের বিরোধিতায় নেমেছে। আগামী একাদশ নির্বাচন দ্রুত এগিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বহু আগে থেকে। আর সদ্য গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঘোষণা দিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম করতে যাচ্ছে মাত্র। যেহেতু হাতে খুব বেশি সময় নেই সেহেতু এই ঐক্যফ্রন্টের তৎপরতা দেশব্যাপী বিস্তৃত করার বিষয়টি এখনও এক ধরনের অন্ধকারে রয়েছে। সেক্ষেত্রে এ ফ্রন্টের ভবিষ্যত কি হতে যাচ্ছে তা নিয়েও জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। বিএনপি অন্যতম একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হলেও এখন দলটি ঐক্যফ্রন্টের বলয়ে চলে গেছে। বিএনপি নামে আগামী নির্বাচনে কোন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের কমতি নেই। তবে অনেকের মতে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যেহেতু নিবন্ধিত নয় সেক্ষেত্রে বিএনপি নামটি সর্বাগ্রে থাকার সম্ভাবনা বেশি। ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য যদি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে তাহলে বিএনপি রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনা থেকে হারিয়ে যাবে তা মনে করছেন না রাজনৈতিক বোদ্ধারা। তবে একে তো দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দ-িত হয়ে বর্তমানে জেলে। পাশাপাশি জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান দলীয় চেয়ারপার্সনের জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানও রয়েছেন বিদেশে পলাতক জীবনে। এই দুই নেতা দলটির মূল কা-ারি। কিন্তু বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে চেয়ারপার্সন জেল খাটছেন। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও অনুপস্থিতিতে দ-িত হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে বিএনপি নামের দলটির মূল বলতে যেটি বোঝায় তা এখন মাঠের রাজনীতির বাইরে। এ অবস্থায় অন্যান্য শীর্ষ নেতার অনেকে অতীতের বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে রয়েছেন চরম বেকায়দায়। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস, জঙ্গী তৎপরতা এবং রাজনীতির নামে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির বিরুদ্ধে অবস্থান রয়েছে কঠোর পর্যায়ে। ফলে রাজনীতির নামে জ্বালাওপোড়াও, মানুষ হত্যা, সরকারী, বেসরকারী জানমালের ক্ষতি করার সুযোগ মিলছে না। দলটিকে জনসভা ও বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু স্বাভাবিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার কার্যক্রমে রয়েছে সরকারের কঠোর নজরদারি। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচন এ দলটি কিভাবে মোকাবেলা করবে তা তাদের নিজেদের কাছেও অস্পষ্ট বলে প্রতীয়মান। এ অবস্থায় দলটি চলে গেল নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণে। সূত্রসমূহ জানায়, দলটির জন্মের পর এতে যারা যুক্ত হয়েছেন এদের সকলেই বিভিন্ন দল থেকে ছুটে আসা। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তি এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতদেরও এ দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। যা বর্তমান সরকারের দুই টার্মের শাসনে বিভিন্ন মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত। ইসলামী ব্যানার ব্যবহার করে দলটি ধর্মভীরু এবং ধর্মপ্রিয়দের অনেককে কাছে টানতে সক্ষম হয়। যে জামায়াত এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে সেই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে এরা সরকারও গঠন করেছে। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের দুইসহ তিন নেতাকে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানোর সুযোগও দিয়েছে। যা এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে। বর্তমান প্রজন্মের বড় একটি অংশ এখন ভোটার হয়েছে। এদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে বিএনপি নামের দলটি কাদের সঙ্গে জোট বেঁধে অতীতে ক্ষমতায় এসেছে এবং এদের মূল লক্ষ্য, আদর্শ কী তা এখনও পরিষ্কার নয়। অপরদিকে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বর্তমান কা-ারি হয়েছেন ড. কামাল হোসেন। তার নিজের একটি দল রয়েছে যার নাম গণফোরাম। তার এই গণফোরামের মতো অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক নামমাত্র দলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গাঁটছড়া বেঁধেছেন। তবে এই গাঁটছড়া বাঁধার বলয়ে বিএনপির প্রবেশ সবচেয়ে বিস্ময়কর। যেখানে বিএনপির নেতৃত্বে অতীতে জোট ছিল এবং আগামীতেও হবে এমন ধারণা রাজনৈতিক সচেতন মহলে বিদ্যমান সেখানে ঘটল উল্টো। আওয়ামী লীগের ফসল ড. কামাল হোসেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় কামাল হোসেন ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অপেক্ষাকৃত অন্যদের তুলনায় নবীন। বঙ্গবন্ধুই তাকে রাজনীতির অঙ্গনে পরিচিতি দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। অথচ, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যে আওয়ামী লীগ ড. কামাল হোসেনকে রাজনীতিতে পরিচিতি দিয়েছে তিনিই কিনা এখন দলটির বিরুদ্ধে নেমেছেন। বিষয়টি অনেকটা জন্মদাতাকে অস্বীকার করার মতো বলেই আলোচিত হচ্ছে। এছাড়া এ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে অন্যান্য যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না। আ স ম রব জেএসডি সভাপতি। আর মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক। আ স ম রব এবং মাহমুদুর রহমান মান্নাও মূলত আওয়ামী লীগের ফসল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকারে আ স ম আবদুর রব মন্ত্রীত্বের পদও পেয়েছিলেন। মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এ দলের মার্কা নিয়ে দু’দফা নির্বাচনও করেছেন। কিন্তু জিততে পারেননি। সব মিলে দেখা যায় বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য নিয়েই নতুন এই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, এরা সবাই মূলত বিএনপি নেতাদের মতো দলছুট। দলছুট অনেকের মধ্যে ড. কামাল হোসেন, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি নিজেকে তাদের পরিকল্পনায় মিশে আগামীতে লড়বে মূলত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই। ফল কি হবে তা আগাম বলা যেমন মুষ্কিল তেমনি এ ঐক্য টিকে থাকার বিষয় নিয়েও সন্দেহের কমতি নেই। ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে জানতে চাওয়া হলে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডাঃ শাহাদাত হোসেন বৃহস্পতিবার বিকেলে জনকণ্ঠকে জানান, আগামী ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমবেশের কর্মসূচী রয়েছে। লালদীঘি মাঠেই তারা সমাবেশটি করতে চান। এ ব্যাপারে প্রশাসনের অনুমতি চাওয়া হবে। চট্টগ্রামে ঐক্যফ্রন্টের কাঠামো কেমন হবে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এখনও ঠিক হয়নি। কেন্দ্র থেকেও নির্দেশনা আসেনি। তবে ঐক্যফ্রন্টভুক্ত গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য এবং জেএসডি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। শীঘ্রই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত মিলবে বলে মত ব্যক্ত করেন।
×