ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাশকতা চালাতে মাঠে নামার প্রস্তুতি জামায়াত-শিবিরের

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

নাশকতা চালাতে মাঠে নামার প্রস্তুতি জামায়াত-শিবিরের

শংকর কুমার দে ॥ আবার নতুন করে সংগঠিত হয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াত-শিবির। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট যোগদানের পর থেকেই আনন্দ উল্লাসের জোয়ার বইছে সংগঠনটিতে। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কারণে এতদিন অস্তিত্ব সঙ্কটের কবলে পতিত হওয়া এই সংগঠনটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০ দলীয় জোটভুক্ত দল হিসেবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের সভা-সমাবেশের শক্তি জোগাবে। লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাকের গোপন বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তড়িঘড়ি করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট থেকে ল্যাং মেরে বাদ দেয়া হয় ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারাকে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, লন্ডনে অবস্থানকারী জামায়াতের শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের গোপন বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। লন্ডনে গোপন বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারাকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। বিকল্প ধারার প্রধান ডাঃ বি চৌধুরী জামায়াত-শিবির ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে বাদ দেয়ার শর্তারোপ করায় মারাত্মক ক্ষুব্ধ হয় লন্ডনে অবস্থানকারী জামায়াতের শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক ও লন্ডনে বসবাসরত বিএনপির তরুণ নেতা তারেক রহমান। কারণ জামায়াত-শিবির স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী দল হলেও তাদের ভোট ব্যাংককেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে লন্ডন গোপন বৈঠকে। এ ছাড়াও ঐক্যফ্রন্টের জোটভুক্ত দল বিএনপির খুবই বিশ্বস্ত জামায়াত-শিবির। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বিকল্প ধারার প্রধান ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী ঐক্য প্রক্রিয়ার শর্ত হিসেবে জামায়াত-শিবির ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে বাদ দিতে বলায় মারাত্মক ক্ষুব্ধ হওয়া জামায়াত-শিবির প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। জামায়াত-শিবিরের তৎপরতায়ই লন্ডনে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে জামায়াতের শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এমনিতেই লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান বিকল্প ধারার মাহি বি চৌধুরী ও তার পিতা ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীরও ওপর মারাত্মক ক্ষিপ্ত ছিলেন। তার ওপর জামায়াত-শিবিরকে বাদ দিতে বলায় লন্ডন গোপন বৈঠকে বসে ব্যারিস্টার রাজ্জাক ও তারেক রহমান তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। এরপরই ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গোপনে তৎপরতা চালায় যুদ্ধাপরাধী পরিচিতি এই সংগঠনটি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে তারা বুঝাতে সক্ষম হয় যে তাদের ভোট ব্যাংক পেতে হলে ডাঃ বি চৌধুরীর বিকল্প ধারাকে বাদ দিয়েই ঐক্যফ্রন্ট করতে হবে। এতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট মরিয়া হয়ে মাঠে নেমে তৎপরতা চালিয়ে তাদের পক্ষে টানতে সক্ষম হয় গণফোরাম প্রধান ড. কামাল হোসেনকে। এরপর ডাঃ বি চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে সেখান থেকে জেএসডির রব, নাগরিক ঐক্যের মান্নাকে নিয়ে আসার কূটকৌশল চালানো হয়। কূটকৌশল সফল হলে বিকল্প ধারা একা ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। এটাও জামায়াত-শিবিরের গোপন তৎপরতার সফলতা বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, লন্ডনে গোপন বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের যেখানেই সভা-সমাবেশ হবে সেখানেই বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের হয়ে সভা-সমাবেশে শক্তি জোগাবে জামায়াত-শিবির। এই সংগঠনটির আন্তর্জাতিক লবিংও খুবই শক্তিশালী। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে ব্যাপক লবিং করানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, যাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসতে না পারে। ঐক্যফ্রন্টের সভা-সমাবেশে জামায়াত-শিবিরের নিজস্ব কোন সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন না থাকলেও তারাই যে জামায়াত-শিবির তাদের পরিধেয় টুপি-পাঞ্জাবী সংখ্যা দিয়েই বুঝানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট গঠনে মহানগর নাট্যমঞ্চে যেদিন প্রথম সভা হয় সেদিন টুপি-পাঞ্জাবী পড়া মানুষজন দিয়েই জামায়াত-শিবির ও তাদের জোটভুক্ত দলের মানুষজনকে বুঝানো হয়েছে এমনটা মনে করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের জনসভা সফল করতে রাজধানী ও আশপাশের এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী যোগ দেয়ানোর জন্য ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মাঠের শক্তি বৃদ্ধিতে জামায়াত-শিবিরের যেসব নেতা-কর্মী, ক্যাডারের বিরুদ্ধে খুন, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ, বিজিবি সদস্যদের হত্যা, অস্ত্র লুট, পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ, নাশকতার মতো গুরুতর অভিযোগের মামলা রয়েছে তাদেরও প্রকাশ্যে এনে মাঠে নামানো হতে পারে। দীর্ঘদিন আড়ালে-আবডালে থাকার পর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন করতে জামায়াত-শিবিরের মহানগর, জেলা ও থানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা গোপনে ঘরোয়া মিটিং শুরু করেছে। যেহেতু নির্বাচন কমিশনে জামায়াত-শিবিরকে নির্বাচনের অযোগ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে, সে কারণেই তাদেরকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে ঐক্যফ্রন্টের শক্তি প্রদর্শন করানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের সম্প্রতি কয়েকজন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য বের হয়ে এসেছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গী সম্পৃক্ততায় মদদদানে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কারণে দীর্ঘদিন অনেকটা আড়ালে আবডালে থাকলেও ছিল তারা। এখন আবার ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বেনামে যুক্ত হতে পেরে প্রকাশ্যে আসতে পেরে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা খুশি। এতদিন মামলা মোকদ্দমা, গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে জামায়াত-শিবির কর্মীদের দীর্ঘদিন ধরেই রাজপথে প্রকাশ্যে দেখা মেলেনি। এমনকি তাদের বাড়িতে গিয়ে পুলিশী অভিযান চালিয়েও পায়নি। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির ২০ দলীয় জোটযুক্ত হওয়ায় জোটভুক্ত দল হিসেবে জামায়াত-শিবির খুবই লাভবান বলে মনে করছে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ফাঁসি হয়েছে দলের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য মীর কাশেম আলীর। সর্বশেষ জামায়াতের অর্থের জোগানদাতা মীর কাশেমের ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময় থেকেই অদৃশ্য হয়ে যায় জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা। এমনকি ফাঁসির রায় কার্যকরের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান করা হলেও মাঠে দেখা যায়নি তাদের কোন তৎপরতা। কিন্তু ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটযুক্ত হওয়ার পর থেকেই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী, ক্যাডারদের মধ্যে চাঙ্গাভাব ফিরে এসেছে, যার কারণে তারা গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে নানা ধরনের নির্দেশনা পাচ্ছে এবং পালন করে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, জামায়াত-শিবিরের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী, ক্যাডার ঘাপটি মেরে ছিল। এখন আবার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের যুক্ত দল বিএনপির ২০ দলীয় জোটের ছাতার তলে এসে জড়ো হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী, ক্যাডাররা। এমনকি জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্যদেরও বিএনপির অদৃশ্য মহল থেকে মদদ দেয়া হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদের একটা বিরাট অংশ জঙ্গীবাদ বা উগ্রপন্থায় জড়িয়েছে। একইভাবে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতেও জায়গা করে নিয়েছে একাংশ। জামায়াত-শিবিরের একাংশ বিএনপির সঙ্গে মিশে গিয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার নামে মাঠে নেমে সহিংস সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে পারে, যা দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। কারণ এর আগে সরকারবিরোধী সহিংস সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে যেসব রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করা হয়েছে তার অগ্রভাগে ছিল জামায়াত-শিবির। এখন আবার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই জামায়াত ও শিবিরের তালা ঝোলানো কার্যালয়গুলো খোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। জামায়াতের ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থা, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন ও চাষী কল্যাণ সমিতি নামের সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনী প্রস্তুতি সামনে রেখেই জামায়াত-শিবিরের মূলত এই ধরনের তৎপরতা ও প্রস্তুতি রয়েছে, যা পরবর্তীতে সহিংস সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে নির্বাচন ভ-ুল করার উদ্দেশ্যে নাশকতা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হতে পারে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার আশঙ্কা।
×