ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সৌদি আরবে পান রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

সৌদি আরবে পান রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের পানে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ‘স্যালমোনেলা’ পাওয়ায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে পান রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করেও বিষয়টির সমাধান করা যায়নি। এবার নতুন করে বাংলাদেশের পান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সৌদি আরব। সৌদি প্রশ্ন বাংলাদেশের পানে ‘বালাইনাশক’ এর মাত্রা নিয়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে দূতাবাসের মাধ্যমে সৌদি আরব মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছে। আগামীতে যে কোন সময়ে যে কোন একটি চালানে মাত্রার বেশি ক্ষতিকারক বালাইনাশক শনাক্ত হলে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে পান রফতানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দেশটির এই হুঁশিয়ারি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। কৃষি, উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, সৌদি আরব বাংলাদেশের পানের মান নিয়ে যেসব প্রশ্ন তুলেছে, তা স্বল্প সময়ে নির্ণয় করা এবং উৎপাদন পর্যায়ে তার ত্বরিত সমাধান করার সক্ষমতা আমাদের কম। নতুনভাবে পান চাষ করে পরবর্তীতে সৌদি আরবে পাঠানোর মতো সময় বা সুযোগও নেই। ফলে আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশটির পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে গত দুই মাসে বাংলাদেশের প্রস্তুতি বলতে শুধুমাত্র অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের একটি সভা হয়েছে। সেই সভায় সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে চারটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোন কাজ এখনও শুরুই করা যায়নি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কিছু সংস্থার পক্ষ থেকে সুপারিশ এসেছে মান নিশ্চিত করা পর্যন্ত সৌদি আরবে পান রফতানি সাময়িক বন্ধ রাখার। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভারতসহ অন্য রফতানিকারক দেশের হাতে রফতানির কাজ চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, সৌদি আরবে পানের চাহিদা অনেক। বাংলাদেশ পান রফতানি অব্যাহত রাখতে না পারলে তারা নতুন কোন দেশ কিংবা বর্তমানে পান রফতানি করা কোন দেশ থেকে আমদানি বাড়িয়ে নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে রফতানি করা পানে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি রাসায়নিক পাওয়া গেছে বলে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসকে অবহিত করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, সৌদি আরবে রফতানি হওয়া পানের ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় এমআরএল অপেক্ষা বেশি বালাইনাশক এবং ক্ষতিকর জীবাণু রয়েছে। পরবর্তী কোন চালানে পানে এ ধরনের কেমিক্যালের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেলে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ থেকে পান আমদানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে মানসম্মত পান উৎপাদন করে রফতানির পরিকল্পনা করছে সরকার। যেমন পরিকল্পনা করা হয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত এক সভায় চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে পান উৎপাদনের জন্য একটি গাইডলাইন আগামী এক মাসের মধ্যে প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিষয়টি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে। পান বাংলাদেশের একটি অন্যতম রফতানি পণ্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পানের অর্ধেকই যায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। পানের জন্য আলাদা কোন এইচএস কোড নেই। পান রফতানি হয় ফুল ও পাতা (কাট ফ্লাওয়ার এ্যান্ড ফলিয়েজ) বিভাগের আওতায়। রফতানিকারকরা বলছেন, ফুল ও পাতার আওতায় যত পণ্য রফতানি হয় এর ৯০ শতাংশই হচ্ছে পান। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ইইউতে রফতানি নিষেধাজ্ঞার পর পান রফতানি কমে গেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ফুল ও পাতার আওতায় পণ্য রফতানি হয়েছে তিন কোটি ৯৩ লাখ ডলারের। এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪ কোটি ১৪ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৫ কোটি ৪ লাখ, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৪ কোটি ২৮ লাখ এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়। কিন্তু বর্তমানে এর পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। ইপিবির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসে পানসহ অন্যান্য পণ্য মিলিয়ে কাট ফ্লাওয়ার এ্যান্ড ফলিয়েজ খাতের পণ্য রফতানি হয়েছে মাত্র ৯৬ হাজার ১২৬ ডলারের। আরো দুই বছর ইউরোপে নিষিদ্ধ পান ॥ ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশী পানের কয়েকটি চালানে স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পায় যুক্তরাজ্য। ইইউভুক্ত অন্য কয়েকটি দেশেও পানের চালানে এই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ থেকে পান আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইইউ। এরপর বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকবার চিঠি পাঠিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শও দেয় ইইউ। সেই পরামর্শ মানা না হলে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানো হবে, এমন সতর্কতা জারির পরও হুঁশ হয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। উল্টো রফতানি নিষেধাজ্ঞার পরও ইউরোপের দেশগুলোতে অন্তত ৯টি পানের চালান যাওয়ার প্রমাণ পায় ইইউর সংস্থা আরএএসএফএফ। এসব কারণে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। পানের কারণে নেতিবাচক প্রভাব সবজিতেও ॥ ইউরোপীয় বাজারে পান রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ২০১৪-১৫ অর্থবছরেই সবজি রফতানি আয় কমে ৩০ শতাংশ। পরের প্রতি অর্থবছরেই এ খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয়েছে। রফতানিকারকরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে আমদানিকারকেরা শুধু পান কিনতেন না। পানের সঙ্গে শসা, বেগুনের মতো সবজিরও ক্রয়াদেশ দিতেন। এখন পানের রফতানি বন্ধ থাকায় তারা অন্য দেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করছেন। এতে বাংলাদেশের রফতানি আয় কমছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখার উপ-পরিচালক (রফতানি) আনোয়ার হোসেন খান বলেন, চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ও স্যালমোনেলামুক্ত পান উৎপাদন করা সম্ভব হলে রফতানি করা যাবে। এজন্য এ্যাকশন প্ল্যান অনুসারে পান উৎপাদন, পরিবহনসহ যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ করা এবং সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত অবস্থায় প্যাকেজিং নিশ্চিত করতে হবে। নিষেধাজ্ঞার খড়গ খাদ্যপণ্য রফতানিতে ॥ বাংলাদেশ থেকে হালাল মাংস রফতানির সম্ভাবনাময় বাজার ছিল সৌদি আরব। বেশ কয়েকটি দেশীয় কোম্পানি হালাল মাংস রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছিল। কিন্তু যথাযথ মান নিশ্চিত না করায় এখন এই পণ্য রফতানিতেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের মাংস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সৌদি আরব। সৌদি ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অথরিটি (এসএফডিএ) কর্তৃক বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে রফতানিকৃত প্রায় ১২ হাজার কেজি খাদ্যপণ্যে ভৌত রাসায়নিক ও জীবাণুঘটিত ত্রুটি উদঘাটিত হয়েছে। বিষয়টির সমাধানে সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশী দূতাবাস দেশটির এসএফডিএর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সমস্যা রয়েছে মাছ ও সবজি রফতানিতেও ॥ ভুয়া সনদ দিয়ে সবজি রফতানি করায় বেশ কয়েকবার সতর্কতা ও সাময়িক নিষেধাজ্ঞাও আসে ইইউ থেকে। এ ধরনের অভিযোগের মুখে গতবছরের মার্চে মরিচ, বড়ই, করলা ও চিচিঙ্গা ইউরোপে রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কৃষি মন্ত্রণালয়। চট্টগ্রামের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান হিফস অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক ইউরোপে রফতানিকৃত সুপার জেলি কোনসে ‘ক্যারাগিনান’ এর উপস্থিতি থাকায় সতর্কতা জারি করেছে ইইউ। এক মাসের মধ্যে ওই নোটিফিকেশনের জবাব ইউরোপীয় কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে। এমনকি ব্রাসেলসের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে গন্ধযুক্ত চিংড়ি রফতানি করায় ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানাও দিতে হয়েছে বাংলাদেশের একটি কোম্পানিকে। সামগ্রিক বিষয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রৌফ বলেন, বিষয়গুলো বাংলাদেশের শাকসবজি ও পান রফতানির জন্য উদ্বেগজনক। একই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। তবে সবগুলো বিষয়েই আমরা সতর্ক এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সেসব বিষয় মাথায় রেখেই কাজ করা হচ্ছে। কিছু বিষয় সংযোজন করা হচ্ছে, কিছু সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করা হচ্ছে। কিছুক্ষেত্রে নতুনভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। যেমন: আমাদের দেশের পরীক্ষাগারগুলোর প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতি কম।
×