ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রিদনের ‘রিদম’ থেমে যাচ্ছে ফেডারেশন কাপে

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

রিদনের ‘রিদম’ থেমে যাচ্ছে ফেডারেশন কাপে

রুমেল খান ॥ বড় ভাই শাহাদাত হোসেন। বয়স ৪৭। বাবা আবদুল আখের মিয়া (রামগতি পৌরসভার সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র)। বয়স ৭৫। এই দু’জন মানুষের উৎসাহ-অনুপ্রেরণাতেই ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া তার। ২০১৭ সালের ঘটনা। দুবাই থেকে অসুস্থ বাবাকে দেখতে এসে হঠাৎই স্ট্রোক করে মারা যান শাহাদাত। এর মাত্র দুই মাস পরই ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে মারা যান বাবা। তার ব্রেন টিউমার হয়েছিল। সেই বাবা-ভাইই যখন আর নেই তখন ফুটবল খেলে কি হবেÑ এমন ভাবনার কাছেই হেরে আত্মসমর্পণ করে ফেললেন আকবর হোসেন রিদন। ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেন। ঠিক করলেন আর নয়, এবার চিরতরে তুলে রাখবেন বুটজোড়া। সবুজ মাঠে ফরোয়ার্ড হিসেবে আর কখনও দাপিয়ে বেড়াবেন না প্রতিপক্ষের বক্সের আশেপাশে। ছড়াবেন না ডিফেন্ডারদের মনে ত্রাস। নোফেল স্পোর্টিং ক্লাবের অধিনায়ক রিদনের ২১ বছরের ‘রিদম’ এবার থামলো বলে। আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে ঢাকায় শুরু হওয়া মৌসুমসূচক টুর্নামেন্ট ফেডারেশন কাপ খেলেই থেমে যাবার সিদ্ধান্তটা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন ৩৮ বছর বয়সী এই সুর্দশন। লক্ষ্মীপুরের রামগতির সন্তান জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপনে জানান, ‘আমার ফর্ম-ফিটনেস এখন যে পর্যায়ে আছে তাতে করে অনায়াসেই আরও ৪/৫ বছর খেলতে পারতাম। কিন্তু মন আর টানছে না।’ তাই বলে ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ারের ইতি টেনে দিলেও ফুটবলকে ছাড়ছেন না রিদন। কোচ হিসেবে গড়তে চান পরবর্তী ক্যারিয়ার। অবশ্য খেলা ছাড়ার আগে কোচিং কার্যক্রম শুরু করেছেন বেশ ভালভাবেই। দুই বছরের মধ্যে করে ফেলেছেন ‘সি’ এবং ‘সি’ রিফ্রেশিং কোচিং কোর্স। এখন করছেন ‘বি’ লাইসেন্স কোর্স। নোফেল (নোয়াখালী-ফেনী-লক্ষ্মীপুর) স্পোর্টিং ক্লাবের সহকারী কোচ হিসেবে আছেন প্রায় বছরখানেক ধরে। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগীয় অনুর্ধ-১৭ দলেরও হেড কোচও তিনি। এছাড়া নোয়াখালীর মাইজদী শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম সংলগ্ন স্টার ফুটবল একাডেমির পরিচালক-কোচ দুই ভূমিকাতেই আছেন। চার বছর আগে যাত্রা শুরু করা এই একাডেমি থেকে এ পর্যন্ত ৮৪ ফুটবলার বেরিয়েছে, যারা দেশের সবধরনের লীগে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলেছেন এবং এখনও খেলছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সাদেকুজ্জামান ফাহিম, যিনি অনুর্ধ-১৫ জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ২০১৬ সালে। এছাড়া অনুর্ধ-১৯ দলে খেলেছেন মোহাম্মদ রকি, অনুর্ধ-২৩ দলে খেলেছেন মাহবুব হোসেন ঝুনু এবং মোজাম্মেল হোসেন নীরা (বর্তমানে শেখ জামাল ধানম-িতে)। এছাড়া ২০১৬ সালে শুরু করেছেন ব্যবসাÑ ‘রিদন স্পোর্টস স্টাইল’। মাইজদী শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে অবস্থিত তার দোকান। এখানে সুলভ মূল্যে সবধরনের খেলাধুলার সামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। যার প্রিয় ফুটবলার জুলফিকার মাহমুদ মিন্টু, আলফাজ আহমেদ, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, হারনান ক্রেসপো এবং ওয়েইন রুনি, সেই রিদন কোচ হিসেবে আদর্শ মানেন ফারুক হোসেন, মারুফুল হক এবং আবু ইউসুফকে। এছাড়া পেপ গার্ডিওলার প্রেসিং ফুটবল এবং জোসে মরিনহোর ডিফেন্সিভ ফুটবল ভাল লাগে তার। ’৬০-এর দশক থেকেই জমজমাট ফুটবল লীগ হতো লক্ষ্মীপুরে। অথচ এই জেলার মাত্র একজনই পরবর্তীতে ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় দলে। তিনি রিদন (পাঁচ ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট)। ২০০৭ সালে মারদেকা কাপে খেলতে জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন। ফরোয়ার্ড পজিশনে ক্লাব-ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু ১৯৯৭ সালে, তৃতীয় বিভাগে লালমাটিয়ার হয়ে। এরপর মুক্তিযোদ্ধায় ১৯৯৯ সালে, ২০০০-০৪ পর্যন্ত বিআরটিসিতে, ২০০৪-০৭ পর্যন্ত আরামবাগে, ২০০৭-০৯ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মোহামেডানে (২০০৮ সালে স্বাধীনতা কাপে চ্যাম্পিয়ন), ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমসে (অধিনায়ক), ঢাকা জেলা (জাতীয় লীগ চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ) ২০০৯-১০ পর্যন্ত ঢাকা মোহামেডানে, ২০১০-১১ পর্যন্ত ফরাশগঞ্জে, ২০১২-১৬ পর্যন্ত ফেনী সকারে (দুই বছর ক্লাবের অধিনায়ক, ২০১৪ সালে স্বাধীনতা কাপে রানার্সআপ) এবং ২০১৭ সালে সর্বশেষ যোগ দেন নোফেলে (২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নশিপে লীগে চ্যাম্পিয়ন)। জাতীয় সিনিয়র দলে খেলেছেন ২০০৭ সালে। ২০০৩ সালে অনুর্ধ-২০ (এএফসি বাছাইপর্বে রানার্সআপ) এবং অনুর্ধ-২৩ দলে খেলেন ২০০৭ সালে। ক্যারিয়ারে সবধরনের প্রতিযোগিতায় এ পর্যন্ত করেছেন ৫০ গোল। ঢাকা মোহামেডানে খেলার ১০ বছর আগে পর্যায়ক্রমে দু’বার ঢাকা আবাহনী রিদনকে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিল। সাইডবেঞ্চে বসে থাকতে হবে আবাহনীর অফার পায়ে ঠেলেছিলেন ২০০৩ সালে বিয়ে করা রিদন। স্ত্রী শাহনাজ আকবর বিউটি একসময় জাতীয় হার্ডলার ছিলেন। এক ছেলে, দুই মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার রিদনের। ছেলে গাউসুল আকবর সাবিন সাভার বিকেএসপিতে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। ছেলে ফুটবল খেলে ডিফেন্ডার হিসেবে। এখনই তার উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। ‘ও আমার একাডেমিতে ছয় মাস ট্রেনিং করে বিকেএসপিতে চান্স পেয়েছে’, গর্বিত উচ্চারণ বাবা রিদনের। ছেলে ফুটবলার হলে খুশিই হবেন তিনি। করবেন সহযোগিতাও। এক মেয়ে তাকওয়া আকবর সামিয়া চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। ছোট মেয়ে তাসওয়া আকবর তাইফার বয়স মাত্র ৪। এখন দেখার বিষয়, ২১ বছরের ফুটবলার অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আগামীতে ফুটবল কোচ হিসেবে কতটা ‘রিদম’ নিয়ে সফল হতে পারেন রিদন।
×